নোয়াম আব্রাহাম চমস্কি একজন মার্কিন তাত্ত্বিক ভাষাবিজ্ঞানী, শিক্ষাবিদ, দার্শনিক ও সমাজ সমালোচক। চমস্কি রাজনৈতিক ভিন্নমতাবলম্বী হিসেবে মার্কিন অভ্যন্তরীণ রাজনীতি, বৈদেশিক নীতি ও বুদ্ধিজীবী সংস্কৃতির উপর তথাকথিত মার্কিন ‘অর্থনৈতিক অভিজাতদের’ ক্ষতিকর প্রভাব বিশ্লেষণ করেন। ১৯৬৭ সালে তিনি রাজনৈতিক অ্যাক্টিভিজমে প্রচার শুরু করেছিলেন এবং ভিয়েতনাম যুদ্ধে আমেরিকার সম্পৃক্ততার সম্পূর্ণ বিরোধিতা করেছিলেন। এই সাক্ষাৎকারে বিখ্যাত এই বুদ্ধিজীবী নোয়াম চমস্কি সমালোচনামূলক চিন্তাভাবনার গুরুত্ব, জলবায়ু বিপর্যয়ের কারণে তৈরি হওয়া অস্তিত্বের সংকট, নিউক্লিয়ার শক্তির সম্ভাবনা এবং যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে আলোচনা করেছেন। পাশাপাশি চমস্কি ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিগুলোর দৌরাত্ম বন্ধ করে কোভিড-১৯ টিকার প্রযুক্তি সবার জন্য উন্মুক্ত করার কথা বলছেন। সাক্ষাৎকারটি অনুবাদ করেছেন সরকার শুভ্র।
জর্জ ইয়ান্সি: এমন মনে হওয়া স্বাভাবিক যে দ্য রিপাবলিকান পার্টি ইচ্ছাকৃতভাবে মানব সমাজের টিকে থাকাকে কম গুরুত্ব দিয়ে দেখছে। যখন আমি এটা নিয়ে ভাবি, এটা আমার কাছে সুস্পষ্ট যে রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতা অর্জনকে সবকিছুর থেকে এগিয়ে রাখে। এইক্ষেত্রে কি রিপাবলিকান পার্টি কোন প্রকার ‘ডেথ উইশ’ গ্রহণ করেছে অথবা গভীর ধ্বংসবাদ?
নোয়াম চমস্কি: এখানে অনেকগুলো ফ্যাক্ট আছে। প্রথমত, এক্ষেত্রে ট্রাম্পের প্রভাব সুবিশাল। পার্টিতে অসংখ্য সমস্যা ছিল। কিন্তু ট্রাম্প এই সমস্যাকে আরও সমৃদ্ধ করেছে। আর এই পার্টিটা তার হয়ে গেছে। তিনি এই সমস্ত সমস্যাকে আমেরিকার নাকের নিচে প্রতিপালন করেছেন। যার মধ্যে আছে শ্বেতাঙ্গদের আধিপত্য এবং আছে কন্সপিরেসি থিওরি ‘গ্রেট রিপ্লেসমেন্ট’। তিনি জানতেন কীভাবে এই সমস্যাগুলোকে ভয়াবহ রূপ দেয়া যায়, আকারে বড় করা যায় এবং মানুষকে, যারা ভাবে পৃথিবী ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গেছে, তাদের কীভাবে এগুলো দিয়ে আতঙ্কিত করে তোলা যায়, প্ররোচিত করা যায়। এটা এমন ধরনের প্রতিভা, যা এডলফ হিটলারের ছিল, বা তাদের আছে যারা সমাজের চোখে খুব একটা সুবিধার নয়। এবং ট্রাম্পের পেছনে এখনও মানুষ সংঘবদ্ধ। পার্টির কর্তৃত্ব তাদের হাতে। ডেভিড ব্রুকস দীর্ঘদিনের নিবেদিত রিপাবলিকান, তিনি তর্ক করেছিলেন যে, জিওপি আমাদের চিন্তার থেকে বেশি খারাপ।
জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে কথা বলা যাক। যখন আপনি জলবায়ু নীতি কাছ থেকে দেখবেন, এটা আমাদের আমেরিকার রাজনীতি নিয়ে অনেককিছু বলে দেবে। যদি আপনি কিছুটা পেছনে যান। বেশি না, ট্রাম্পের আগের সময়ে, তখন রিপাবলিকানদের প্রধান বিষয়গুলো খুঁটিয়ে দেখা বেশ কৌতূহলের হবে। আমি সেই সময়ের কথা বলছি, যখন রিপাবলিকান নেতৃত্ব ভাবা হতো বলিষ্ঠ এবং ধারালো। তখনও ট্রাম্প কোথাও ছিল না। যারা ছিল তারা প্রত্যেকেই হয় জলবায়ু পরিবর্তনকে অস্বীকার করেছে, না হয় স্বীকার করলেও তাদের কোন মাথাব্যথা ছিল না। কোন রিপাবলিকান ছিল না এ নিয়ে চিন্তিত। ওয়াইও’র সাবেক রাজ্যপাল জন কাসিককে বিবেকবান ভাবা হতো। তাকে এতোটাই যোগ্য ভাবা হয়েছিল যে ২০২০ সালের ডেমোক্রেটিক কনিভেনশনে কথা বলার জন্য তাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। তাকে একজন যোগ্য রিপাবলিকান ভাবা হতো। কিন্তু তিনি তা ছিলেন না। তার প্রমাণ পাওয়া যায় তিনি এ বিষয়ে কী বলেছিল তা থেকে। তিনি বলেছিলেন, ‘হ্যাঁ, বিশ্ব উষ্ণায়ন ঘটছে। মানুষ এজন্য দায়ী, এবং বিজ্ঞান ঠিক বলছে এ প্রসঙ্গে।’ কিন্তু ওহাইও অঙ্গরাজ্যের রাজ্যপাল হিসাবে তিনি বলেন, ‘ওহাইওতে আমরা কয়লা ব্যবহার করবো এবং এজন্য আমরা ক্ষমাপ্রার্থীও নই’। তিনি সচেতন ছিলেন যে তারা পৃথিবী ধ্বংস করছেন, সমগ্র মানব জাতির সম্ভাবনা নষ্ট করছেন এবং এ-ও বলছেন তিনি এটা করবেন এবং সেজন্য সামান্য দুঃখিতও নন। তাহলে এই হচ্ছে সবথেকে বিবেকবান মানুষের নমুনা, যাকে বাইডেনের ডেমোক্রেটিক ন্যাশনাল কনভেনশনে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল, এই ঘটনাটা আপনাকে শুধু রিপাবলিকান নয়, সমস্ত আমেরিকানদের মানসিকতা সম্পর্কে ধারণা দেবে।
কিন্তু কেন রিপাবলিকান দল এমন নিবেদিত অস্বীকারববাদী হয়ে উঠলো? এটা সবসময় সত্য ছিল না। ২০০৮ এ এমন ছিল না, যখন জন ম্যাককেইন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অংশ নেন। জলবায়ু নিয়ে তার একটি পরিকল্পনা ছিল। যদিও বড় কিছু নয়। তবে সেনেটে অন্যান্য রিপাবলিকানরা এটা নিয়ে ভাবতে শুরু করেছিল। তারা মাঝারি ধরনের কিছু পদক্ষেপ নিতে সম্মত হয়েছিল বিশ্ব উষ্ণায়নের বিরুদ্ধে। তবে রিপাবলিকানদের এই চেষ্টা সম্পর্কে কোচ ভ্রাতৃদ্বয় জানতে পেরে যায়। তারা দীর্ঘদিন ধরে চেষ্টা করে আসছিল, যাতে রিপাবলিকান পার্টি জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে মাথা না ঘামায়, যাতে তাদের ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সম্ভবত কিছু রিপাবলিকানরা ‘ট্রু বিলিভার’ ছিলেন, কিন্তু তাতে কী আসে যায়? হয়তো হিটলারও সত্যিই বিশ্বাস করতেন তাদের জাতিকে বিষ প্রয়োগে হত্যা করা হবে এবং তাদের বাঁচাতে হবে নিজেদের। কিন্তু এটা সত্যিই যায় আসে না, তারা বিশ্বাস করে, নাকি করে না। কোচ ভ্রাতৃদ্বয় পার্টিকে নিয়ন্ত্রণের অনেক চেষ্টা করেছে, নিশ্চিত করেছে যাতে পার্টি জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে মাথা না ঘামায়। কিন্তু তারা যখন এর অন্যথা দেখল, তারা তাদের চেষ্টা দ্বিগুণ করে দিল এটা রুখতে। তারা তদবির করলো, হুমকি দিলো, সিনেটরদের কিনে নিলো, আপনি যা কল্পনাও করতে পারবেন না, তার সবকিছুই তারা করেছিল। এরপর রিপাবলিকান পার্টি মত বদলালো: ‘সেখানে আর গুরুতর জলবায়ু সমস্যা নেই’ এবং তখন থেকেই অস্বীকারবাদীদের পার্টি হলো এটা। নেতৃত্বও সেজন্য নিবেদিত।
সাম্প্রতিক পিউ রিসার্চ ইনস্টিটিউট পোলের একটি ফলাফল বেশ কৌতূহল তৈরি করেছে। তারা মানুষকে প্রধান সমস্যা বেছে নিতে ১৫টি অপশন দিয়েছিল। এবং তারা অপশনগুলো ডেমোক্রেটিক ও রিপাবলিকানদের মধ্যেও কতটা গুরুতর, সেটা জানার চেষ্টা করেছিল। আমি অবশ্যই বলবো, ডেমোক্রেটিকরা অতোটা ভালো ছিল না। তবে রিপাবলিকানরা ছিল জঘন্য। তাদের কাছে সবথেকে কম গুরুতর ছিল জলবায়ু পরিবর্তন, যা কিনা মানব ইতিহাসের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হয়ে উঠেছে। আমাদের এই প্রজাতি কি টিকে থাকবে?— এই প্রশ্নের উত্তর এখনি প্রয়োজন। যাই হোক জলবায়ু পরিবর্তন এবং পুরুষের আধিপত্য ছিল তাদের কম গুরুতর সমস্যা। লিস্টের প্রথম দিকে কোনগুলো ছিল? বেশ, ছিল অবৈধ অভিবাসী এবং বাজেটের ঘাটতি। ভেবে দেখুন, এই জানুয়ারিতে এসে বাজেট ঘাটতি সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর আগে এটি সমস্যাই ছিল না।
সবকিছু বিচার করলে আপনি বুঝতে পারবেন, কেন ৪০ শতাংশ রিপাবলিকানরা যা ঘটছে তা থেকে দেশকে রক্ষার জন্য ‘পলিটিক্যাল ভায়োলেন্স’কে সঠিক বলে মনে করে। কিন্তু আপনি এটাকে সমর্থন করতে পারবেন না। এটা পৃথিবীর বাইরের কিছু। মার্জোরি টেইলর গ্রিনের কথাই ভাবুন। সব হাস্যকর ঘটনা সামনে আসার পর, তার সব ফান্ডিং প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। অথচ এখন সে অন্য যে কারও থেকে বেশি সাহায্য পাচ্ছে। এবং আপনি দেখতে পাবেন, এটা ওইসব মানুষ থেকে যারা বিশ্বাস করে টেইলরকে। প্রসঙ্গত, তারা ধনী। দ্য রবার্ট পেপ’র (ইউনিভার্সিটি অব শিকাগো’র পলিটিক্যাল সায়েন্সের অধ্যাপক) গবেষণা এবং অন্যান্য গবেষণা, উদাহরণস্বরূপ, এন্থনি ডিম্যাগিও’র (লেহাই ইউনিভার্সিটির পলিটিক্যাল সায়েন্সের সহকারী অধ্যাপক) গবেষণা থেকে জানা যায়, মূল রিপাবলিকান তুরুপের তাস আসলে পরিমিতভাবে যারা ধনী, তারাই। এর মানুষজন মধ্যবিত্ত শ্রেণীর উপরে বাস করে। চোখে পড়ার মতো ধনী নয়, কিন্তু দোকানের মালিক, কনস্ট্রাকশানের ব্যবসা আছে, বীমার সেলসম্যান। এদের মূলত বলা হয় ক্ষুদ্র বুর্জোয়া। মধ্যবিত্তের উপরে, কিন্তু বিশাল কিছু একটা নয়। এই মানুষগুলো ভাবে তাদের ঐতিহ্যগত জীবন, তাদের থেকে কেড়ে নেয়া হচ্ছে। নিওলিবারেল নীতিগুলো দ্বারা তারা ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। এমনকি তাদের কমিউনিটি ভেঙে যেতে পারে। আমেরিকার কোন একটি গ্রামীন শহরে যান, দেখবেন তাদের ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। যুবকেরা তাদের পুরুষানুক্রমিক সুখী শেতাঙ্গ খ্রিস্টান কালচার এবং শেতাঙ্গ আধিপত্যবাদের পরিবেশ থেকে বেরিয়ে আসছে। বেশ, তাদের কাছে এগুলো যেন বিলীন হয়ে যাচ্ছে। এই ঘটনাকে ‘গ্রেইট রিপ্লেসমেন্ট’ হিসেবে আপনি প্রতিষ্ঠা করতে পারেন, যেখানে তাদের সব ঐতিহ্য কেড়ে নেয়া হচ্ছে, তাদের মেরে ফেলা হচ্ছে। এই সবকিছু একে অন্যের সাথে সম্পর্কিত। কিন্তু এসবের একদম উপরে খুবই দুর্নীতিবাজ, কঠোর নেতৃত্ব আছে; যা কিনা চাইছে আমাদের চারপাশে ঘটা সবকিছুর প্রতি মানুষকে অস্বীকার প্রবণ করে তুলতে এবং এটা ঘটছে মানব জাতির ধ্বংসের কিনারে দাঁড়িয়ে।
এবং প্রসঙ্গক্রমে, এটাই প্রথমবার নয়। বছর পঞ্চাশ আগে রিচার্ড নিক্সন এবং দ্য সাউথার্ন স্ট্রাটেজির দিকে তাকান। খুব বেশি পার্থক্য নেই। নিক্সন বুঝেছিল, আফ্রিকান আমেরিকানদের জন্য খুব সীমিত নাগরিক অধিকার থাকা উচিত, খুবই সীমিত। একই কাজ করএ দক্ষিণের শ্বেতাঙ্গদের বিচ্ছিন্ন করে দিতে চলেছিলেন। এইভাবে একটি বর্ণবাদী পার্টি গড়ে তোলা হয়, যা কিনা দক্ষিণবাসী শেতাঙ্গদের ভোট নিশ্চিত করবে। এটা বেশ খোলাখুলিভাবে ঘটেছিল। গোপন কিছু ছিল না। কয়েক বছর পর ১৯৭০ দশকের মাঝামাঝি, রিপাবলিকান কৌশলবীদ পল ওয়েরিক অনুধাবন করলেন, যদি রিপাবলিকান পার্টি গর্ভপাতের বিরোধিতা করার ভান ধরে তাহলে তারা ধর্মের প্রতি অনুগতদের একটি বড় অংশের ভোট নিশ্চিত করতে পারবে, এমনকি উত্তরাঞ্চলের ক্যাথলিকদের ভোটেও ভাগ বসাতে পারবে যাদের অধিকাংশই ডেমোক্রেটিক। অথচ রোনাল্ড রিগান যখন ক্যালিফোর্নিয়ার রাজ্যপাল ছিলেন, সেই ১৯৬০ এর দশকে তিনি অন্যতম জোরালো আইন প্রণয়ন করে, যা কিনা নারীদের এই ক্ষেত্রে নিজের সিদ্ধান্ত নেয়ার অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছিল। এরপর জর্জ হারবার্ট ওয়াকার বুশ (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৪৩তম রাষ্ট্রপতি যিনি ২০০১ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন) এবং অন্যান্যরাও একই পথে হেঁটেছেন। কিন্তু রিপাবলিকানরা এই সবকিছুকে তুচ্ছ জ্ঞান করেছেন। তারা মনে প্রাণে গর্ভপাতের বিপক্ষে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু এই পুরো ব্যাপারটাই ছিল ওদের প্রতারণা। এর পক্ষে কোনভাবেই সাফাই দেয়া যায় না। আমি জানি না কোন শব্দট এর সাথে যায়। এটি অসৎ চিন্তার ফল এবং এটাই সমস্তটা জুড়ে ছিল।
এবং আপনি শুধু রিপাবলিকানদের দোষারোপ করতে পারেন না। টিকার সাম্প্রতিক অবস্থাটা ভাবেন। যদি দক্ষিণের গরিব দেশগুলোতে টিকা না পৌঁছায়, আফ্রিকা, এশিয়ায় যদি দ্রুত গণটিকাকরণ সম্ভব না হয়, তাহলে করোনা ভাইরাস নিজের ধরন বদলে নেবে, মিউটেড হবে। এটা হচ্ছে, আপনি আরও মারাত্মক সব স্ট্রেইনের মুখোমুখি হচ্ছেন। আপনার ইবোলার মতো প্রাণনাশক কিছু হতে পারে। খুব শীঘ্রই এটা য়ুরোপে ছড়িয়ে পড়বে। আপনারা সবাই মরতে বসেছেন। তারা কী করছে? টিকা মজুদ করছে, আফ্রিকা এবং এশিয়ায় টিকা দিতে অস্বীকার করছে। এটা শুধু অমানবিক নয়, আত্মহত্যাও। এটা নিশ্চিত করা যে, আমার যা প্রয়োজন, তা আমার আছে এবং সেটা বাকী সবকিছুকে অসহায় করে তুলছে, এটা লোভের একটা গুরুত্বপূর্ণ দিক। এর বড় একটা অংশ হচ্ছে সুবিশাল ফার্মাসিউটিক্যাল করপোরেশনের লাভের কথা ভাবা। আমাদের নিশ্চিত করতে হবে, তারা যেন যথেষ্টর বেশি লাভ করতে সক্ষম হয়, গলাকাটা লাভ যাকে বলে, এমনকি যদি এটা নিশ্চিত করতে যেয়ে আমরা মারাও যাই, তবুও। এটি একটি ব্যাধি যা গভীরে প্রোথিত। এর মধ্যে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের একটা গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ ছিল, যে তিনি ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশনকে সাহায্য করার ঘোষণা দিয়েছেন। এটা অসংখ্য ফাঁদযুক্ত দীর্ঘ আলোচনার প্রক্রিয়াকে শুরু করতে সাহায্য করবে। যা কিনা ভারতে ঘটে যাওয়া মারাত্মক বিপর্যয় কাটানো এবং টিকার অভাবে তৈরি সমস্যা মেটানোর জন্য দরকার। দেরী না করে এমন আরও অনেক পদক্ষেপ প্রয়োজন।
জর্জ ইয়ান্সি: আমার মনে হয় এটা শিক্ষার চরম গুরুত্বের মতো বিষয়কে সামনে নিয়ে আসে। আপনার একটা আলাপ আছে যে শিক্ষা প্রায় অন্যের উপর মত চাপিয়ে দেয়া; যার সাথে আপনি সমাজে সংকটপূর্ণ প্রশ্ন না তোলার বিষয়টি যুক্ত করেছিলেন; যেখানে এই সমাজ ব্যবস্থায় অবাধ্য মানুষ খুব কমই আছে। আপনি কি এখনও ওই অবস্থানে আছেন? আমার ধারণা আপনি আছেন ওই অবস্থানে কারণ এখনও আমাদের মধ্যে ওই রকম প্রশ্ন করা মানুষের সংখ্যা খুব একটা বেশি নয়। এবং আমরা অবাধ্যও নই; বিশেষ করে আমাদের এই পৃথিবীকে কীভাবে আমরা ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গেছি সেক্ষেত্রে। শুধুমাত্র জলবায়ু পরিবর্তন, জীবাশ্ম জ্বালানির ক্ষেত্রে নয়, নিজেদের পারমাণবিক যুদ্ধের কিনারে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রেও আমরা প্রচলিত ব্যবস্থার অবাধ্য হতে পারিনি।
নোয়াম চমস্কি: বিশ্ব উষ্ণায়নের পাশাপাশি মানুষের অস্তিত্বের জন্য আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ হুমকি পারমাণবিক যুদ্ধ; যা নিয়ে আলোচনাও পর্যন্ত করা হয় না। কেউ যদি নথিপত্র ঘেঁটে দেখে; জানতে পারবে, গত ৭৫ বছর ধরে যে আমরা ধ্বংস হইনি এটা এই সময়ের মধ্যে ঘটা সবথেকে অলৌকিক ঘটনা। একের পর এক ঘটনা আছে, কখনোসখনো দুর্ঘটনাও; যেখানে মিসাইল ছোঁড়ার থেকে আমরা কেবল সুইচ চাপার দূরত্বে ছিলাম; যার মানে গোটা পৃথিবীই ধ্বংস হতে পারতো, যেকোন একটি সম্ভাবনা বাস্তবে রূপ নিলে। মানবিক হস্তক্ষেপই প্রতিবার শেষ মুহূর্তে এই ধ্বংস থামিয়েছে। এখানে নেতাদের অনেক বেপরোয়া পদক্ষেপ আছে; যাদের অনেকেই সম্মান করে, যদিও আমি করি না। জন এফ. কেনেডির (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৩৫তম রাষ্ট্রপতি) কথা ধরা যাক। তার বেপরোয়া পদক্ষেপে আমরা ধ্বংসাত্মক এক যুদ্ধের কিনারে পৌঁছে যাই। আপনি নথিপত্র দেখলে, স্তব্ধ হয়ে যাবেন। কিন্তু পরিস্থিতি প্রতিনিয়ত আরও খারাপের দিকে যাচ্ছে। ট্রাম্পের সবথেকে বড় অপরাধ ছিল তার পরিবেশেগত নীতি এবং পারমাণবিক নীতি। ক্ষমতায় এসে ট্রাম্প সবথেকে ভালো যা বুঝেছিলেন তা হলো, ‘চলো ধ্বংস করি। আমি খবরের প্রথম পাতায় থাকতে চাই এবং আমি জানি না আমায় কী করতে হবে। তাই আমি ধ্বংস করবো।’ এটাই ছিল তার মূল নীতি। এবং সে অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাকে ধ্বংস করেছিল পুরোপুরিভাবে। সে শুধু ধ্বংসই করেনি, সে ঘোষণা দিয়ে ধ্বংস করেছিলো। ‘আমি চাই আপনারা আসুন এবং আমার সাথে যোগ দিন’- সে ঘোষণা দেয়। ২০১৯ এর আগস্টে ‘ইন্টামিডিয়েট-রেঞ্জ নিউক্লিয়ার ফোর্সেস’ চুক্তি ভেঙে সে এই ঘোষণা দেন; এটা মূলত রেগান-গরবাচেভ চুক্তি যা কিনা য়ুরোপে যুদ্ধের সম্ভাবনা কমাতে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ট্রাম্প মিসাইল ছুঁড়ে এই চুক্তি ভঙ্গ করে। সে রাশিয়ানদের বলছিল, আমাদের সাথে ধ্বংসের এই খেলায় যোগ দাও। ট্রাম্প উন্মুক্ত আকাশ চুক্তি ভেঙেছে। বাইডেন এমন এক সময়ে ক্ষমতায় এসেছিলেন যখন নতুন এসটিআরটি চুক্তি প্রায় শেষ হবার পথে ছিল; কারণ চুক্তি নবায়নে রাশিয়ার প্রচেষ্টায় ট্রাম্প কোনো মাথা ঘামায়নি তখন। এবং এরমধ্যে ট্রাম্প নতুন প্রযুক্তির, আরো ধ্বংসাত্মক অস্ত্র বানিয়েছে। এটা আত্মহত্যা। অস্ত্র নিয়ন্ত্রন কমিউনিটি এটা সম্পর্কে সচেতন ছিল এবং সতর্কও করেছিল কিন্তু তার কোনো উল্লেখ নেই।
বাইডেন দুর্ভাগ্যজনকভাবে সামরিক কার্যক্রমকেই বেছে নিয়েছে। এটা আমরা যা আশাকরি, তা থেকে অনেক পিছিয়ে। আপনার অবাধ্যতা নিয়ে আলাপে ফিরে যাই। একটু ভিন্নভাবে দেখাবো ব্যাপারটা। আমি প্রশ্ন করা নিয়ে বলবো। এটা শৈশব থেকে গড়ে ওঠা উচিত। যদি সবাই কোনকিছুতে একমত হয়, তাহলে সেটা বিষয়কে জটিল করে তোলে। কোন কিছু তখন আর দুই যোগ দুই চারের মতো থাকে না। কিঞ্চিত জটিলতা থাকলেও, সেখানে মানুষ পুরোপুরি একমত হতেই পারে না। যদি হয়, এটা গভীরভাবে মানুষের মতামতকে নিয়ন্ত্রণ করা এবং বুঝতে হবে এর পেছনে একটা চক্রান্ত চলছে। এটা আপনাকে মানতে হবে; সাধারণ জীবনযাপনে, রাজনৈতিক জীবনে তো অবশ্যই।
কোন বিষয়গুলো প্রত্যেকটা সঠিক চিন্তা করা মানুষ বিশ্বাস করে? আমরা চীন ও ইরানের হুমকির মুখোমুখি হয়েছি। সবাই এটা বিশ্বাসও করে এবং এজন্যই এটা জটিল হয়ে উঠেছে। তাই নিজেকে জিজ্ঞেস করুন: চীনের হুমকি কী এবং ইরানের হুমকি কী? বেশ, আপনি যখন এই প্রশ্ন করতে শুরু করবেন, তখন পুরো আদর্শগত অবস্থান ধ্বসে যাবে। ইরানের সরকার যথার্থ নয়, তবে আমরা যাদের পক্ষ নিই; সেই সৌদি আরবের মতো অতোটাও খারাপ নয়। কিন্তু এটা কি আমাদের জন্য হুমকি? ধরুন, ইরান পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করছে; যেটা আমাদের বিশ্বাসের কোন কারণ নেই। এটা আমাদের জন্য কীভাবে হুমকি হতে পারে? যদি ইরানের পারমাণবিক অস্ত্র থেকে থাকে, তারা কি সেটা ব্যবহার করতে পারবে? তারা কী এটা দিয়ে মিসাইল তৈরি করতে পারবে? যদি তারা করে, দেশটা বাষ্পে পরিণত হবে। দেশটার ক্ষমতায় থাকা আলেমদের, যারা আমার খুব একটা প্রিয় নয় বা আপনারও, কোনো ইচ্ছে নেই এখনি আত্মহত্যা করার বা নিজদের যা আছে তা হারানোর। আমেরিকার গোয়েন্দাবিভাগও একই কথা বলছে। তারা অতীতে বলেছে, যদি ইরানের পারমাণবিক প্রকল্প থেকে থাকে, তবে তা নিজেদের রক্ষার জন্য। কেন একটা দেশ নিজেদের রক্ষার জন্য পারমাণবিক শক্তি অর্জন করবে? কারণ কেউ তাকে আক্রমণ করতে পারে। কেউ তাদের সাথে ইতিমধ্যেই যুদ্ধে জড়িয়ে আছে; সেই দেশগুলো হল যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরায়েল। যখন যুক্তরাষ্ট্র সাইবার হামলা নিয়ে অহংকার করছিল, যা কনা ইরানের বিভিন্ন ফ্যাসিলিটিস ধ্বংস করে; সেটা যুদ্ধের পদক্ষেপ ছিল। যখন ইসরায়েল ইরানের পারমাণবিক বিজ্ঞানীকে হত্যা করে এবং ইরানের ফ্যাসিলিটিস উড়িয়ে দেয় বোমা হামলা চালিয়ে, সেটা যুদ্ধের পদক্ষেপ ছিল। আমরা প্রকাশ্যে এবং অহংকার করে ইরানের সাথে যুদ্ধ করছি। তাই তাদের কি আত্মরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলা উচিত নয়? যদি তারা তা করে, তবে তা কি আমাদের জন্য হুমকি? হ্যাঁ এটা হুমকি, তবে সেই দেশের জন্য; যারা স্বাধীনভাবে থাকতে চায় কিন্তু যাদের আত্মরক্ষার কোনো ব্যবস্থা নেই।
আরও বেশি অনুসন্ধান করলে, আপনি আরও জানতে পারবেন। এমন অনেককিছু আছে যা চীনের করা উচিত নয়। চীনের অভ্যন্তরীণ দমনপীড়ন প্রবল। আমরা যা করছি, অতোটা জঘন্য না হলেও, ওখানে অবস্থা বেশ খারাপই। এবং দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমরা চীনের এই দমনপীড়নের কোন প্রতিকার করতে পারছি না। এদিকে, আমরা আমাদের করা দমনপীড়ন নিয়ে অনেককিছুই করতে পারি কিন্তু এগুলো নিয়ে আমরা কথাই বলতে চাই না। দক্ষিণ চীন সাগরে, যেটা কিনা চীনের জন্য বাণিজ্য ও নিরাপত্তার ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, সেখানে তারা আন্তর্জাতিক আইন অমান্য করছে। কিন্তু এর প্রতিউত্তরে আমরা সেখানে রণতরী পাঠাতে পারি না। সেটা যুদ্ধের উস্কানি। আর সেখানে কিছু একটা হলে গোটা পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে। চীন কিংবা রাশিয়ার সাথে পারমাণবিক যুদ্ধ বাঁধানো যাবে না। এটা প্রতিকারের উপায় নয়। কূটনীতি ও আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা মেটাতে হবে। এখানে সুযোগ আছে, যা কিনা সঠিকভাবে সবসময় ব্যবহার করা যায় না। অসংখ্য মিথ্যের মধ্যে ট্রাম্প একটা মাত্র সত্য বলেছিলেন; সেটা হল, ‘আপনারা কি ভাবেন আমাদের দেশ খুব নিরীহ?’ একই ঘটনা ঘটেছে রাশিয়ান সীমান্তে উস্কানি দেয়া নিয়ে। খেয়াল করুন, এটা করা হয়েছে রাশিয়ান বর্ডারে, মেক্সিকান বর্ডারে না। এটা সামরিক কসরত দেখানোর জায়গা না। এন্টি-ব্লাস্টিক মিসাইল বসানোর জায়গা না। আপনি চাইলেই যা ইচ্ছা করতে পারেন না, যদি আপনি পৃথিবীতে শান্তিপূর্ণভাবে বাস করতে চান।
মূল এবং তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, ভিন্নমত পোষণের কালচারে ফিরে যাওয়া এবং তা বারবার ঘটা। কোন জটিল প্রশ্নে যদি অতিমাত্রায় একমত হতে দেখেন মানুষকে, সন্দেহ করুন। জটিল প্রশ্নগুলো নিয়ে বিতর্ক হওয়া উচিত।
আপনার মতামত জানানঃ