সাক্ষাৎকারের আগের অংশটি পড়তে এখানে ক্লিক করুন : টুইন টাওয়ার হামলা ও লাদেন প্রসঙ্গে নোম চমস্কি (পর্ব-১)
প্রশ্ন : এই প্রসঙ্গে মার্কিন সরকারের প্রতিক্রিয়াকে আপনি কীভাবে দেখেন? আসলে কার মতামতকে তারা প্রতিনিধিত্ব করছে?
চমস্কি : আমেরিকান সরকার অন্যান্যদের মতো প্রাথমিকভাবে আমেরিকার অভ্যন্তরীণ শক্তিরই প্রতিনিধিত্ব করে থাকে। এটা এক ধরনের স্বতঃসিদ্ধ সত্যের মতো। অবশ্য এটা ছাড়াও অন্যান্য প্রভাবক রয়েছে। যেমন : নানান ধরনের জনপ্রিয় মতামত সমূহ। আসলে জনপ্রিয় মতামত বা ধারণাগুলো প্রায় সকল সমাজেই প্রভাবক হিসেবে কাজ করে, তা সে খুব গণতান্ত্রিক সমাজ হোক বা একেবারে নিষ্ঠুর কর্তৃত্ববাদী সমাজ হোক। এপর্যন্ত আমাদের জানামতে, আমেরিকান সরকার এখন নিজেদের এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য মরিয়া হয়ে সব ধরনের সুযোগকে কাজে লাগানোর চেষ্টা করছে। এজেন্ডাটি হলো- সারা দুনিয়া সামরিকায়ন। জলে, স্থলে এমনকি মিসাইল ডিফেন্সের নামে মহাকাশের সামরিকায়নও এর অন্তর্ভুক্ত।
আসলে, দুইপক্ষেই রয়েছে অসংখ্য বিন লাদেন।
তার সাথে রয়েছে সমাজের গণতান্ত্রিক বিকাশের পথগুলোকে রুদ্ধ করা, কর্পোরেট বিশ্বায়নের ভয়ংকর পরিণতিগুলোকে উপেক্ষা করা, পরিবেশ বিষয়ক, জনগণের স্বাস্থ্যবীমা সংক্রান্ত সমস্যাগুলো উপেক্ষা করা ছাড়াও এমন সব ব্যবস্থা আরোপ করা হচ্ছে যা কেবল গুটিকয়েক মানুষকেই অর্থ-সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলতে সাহায্য করে (যেমন : কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোকে ট্যাক্স ব্রেক দেওয়া বা কর রেয়াত দেওয়া) আর সবশেষে সমাজের মানুষকে ক্রমশই জঙ্গি ও উগ্র করে তোলা, যেন সুস্থ বির্তক, গণতান্ত্রিক প্রতিবাদের পদ্ধতিগুলো ধ্বংস করে দেওয়া যায়। এর সবই সাধারণ ও স্বাভাবিক, সহজাত। আর এসবের প্রেক্ষিতে, আমার ধারণা এরা অনেকের সাথেই বলছেন, মতামত শুনছেন। এরা অনেক বিদেশি ও আন্তর্জাতিক নেতাদের কথা শুনছেন, মধ্যপ্রাচ্য বিশেষজ্ঞ এবং এদের নিজেদের অভ্যন্তরীণ বিশেষজ্ঞদের কথাও শুনছেন। এসব মতামতের প্রায় সবগুলোই যে সতর্কতার কথাটা বলেছে তা হলো- একটা বিরাট সামরিক অভিযান হয়তো বিন লাদেনের মনোবাসনাই পূরণ করবে।
কিন্তু এদের মাঝেও অনেক ভয়ংকর, নিষ্ঠুর শক্তি আছে, যারা বরং এই সুযোগটাকেই কাজে লাগাতে চান চরম ভায়োলেন্স সৃষ্টি করে নিজেদের শত্রুকে ধ্বংস করার জন্য। এই ক্রমাগত বাড়তে থাকা ভায়োলেন্সের চক্রে আমেরিকায় বা ইউরোপে দুপক্ষের যত মানুষই মারা যাক না কেন, যত মানুষের ভোগান্তি হোক না কেন তাতে যেন তাদের কিছুই যায় আসে না। সেই একই পরিচিত দৃশ্য, পরিচিত পদ্ধতি। আসলে, দুইপক্ষেই রয়েছে অসংখ্য বিন লাদেন।
প্রশ্ন : অর্থনৈতিক বিশ্বায়ন পশ্চিমা মডেলকে সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে দিয়েছে এবং আমেরিকা হচ্ছে এই বিশ্বায়নের প্রধান সমর্থক। কখনো কখনো খুবই প্রশ্নবিদ্ধ উপায়ে, প্রায়ই বিভিন্ন দেশের স্থানীয় সংস্কৃতিকে অপদস্থ করে। আমরা কি আমেরিকার গত দশকের নীতির পরিণতি ভোগ করছি? কিংবা আমেরিকা কি কেবলই একটা নিরীহ ভিকটিম?
চমস্কি : এই তত্ত্ব এখন সাধারণভাবে বেশ এগিয়ে গেছে। আমি এর সাথে একমত পোষণ করি না। প্রথম কারণ- এই পশ্চিমা মডেল, বিশেষত আমেরিকান মডেল মূলত দাঁড়িয়ে আছে অর্থনীতির ওপর রাষ্ট্রের একটা বড়সড় হস্তক্ষেপের নীতির ওপর ভিত্তি করে। ‘নয়া উদারনৈতিক নিয়ম’গুলো অনেকটা পূর্বতন সমস্যার মতো, অনেকটা দু’ধারি তরবারির মতো। বাজারের শৃঙ্খলা আপনার জন্য ভাল কিন্তু আমার জন্য ভাল নয়। কেবল কিছু অস্থায়ী সময়ের জন্য, যখন আমি বাজারের প্রতিযোগিতায় জিততে চাই, শুধু তখন সেটা আমার জন্য ভাল।
যদি আমরা আমেরিকার কৃতকর্মগুলোকে, আমেরিকার মিত্রদের কৃতকর্মগুলোকে ভুলে গিয়ে থাকি তাহলেই আমেরিকাকে মনে হতে পারে একটা ‘নিরীহ ভিকটিম’।
দ্বিতীয় কারণ- সেপ্টেম্বর এগারোতে যা ঘটেছে তার সাথে অর্থনৈতিক বিশ্বায়নের কোনো সম্পর্ক নেই। বরং আমার মতে, কারণাটা ভিন্ন। ৯/১১-কে জায়েজ করার মতো কোনো যুক্তি নেই পৃথিবীতে। কিন্তু এর বিপরীতে আমেরিকাকে ভিকটিম মনে করা যেতে পারে যদি আমরা খোদ আমেরিকার নিজের অতীত ইতিহাসে ভুলে গিয়ে থাকি। অর্থাৎ, যদি আমরা আমেরিকার কৃতকর্মগুলোকে, আমেরিকার মিত্রদের কৃতকর্মগুলোকে ভুলে যাই তাহলেই আমেরিকাকে মনে হতে পারে একটা ‘নিরীহ ভিকটিম’। যদিও কৃতকর্মের ইতিহাসগুলো গোপন কিছু নয়।
প্রশ্ন : সকলেই একমত যে নাইন-ইলেভেনের পর কোনো কিছুই আর আগের মতো থাকবে না। দৈনন্দিন জীবনের অধিকারের ওপর নিয়ন্ত্রণ থেকে শুরু করে বৈশ্বিক জোটগুলো আর তাদের শত্রুদের প্রতিকৌশল প্রসঙ্গে আপনার বক্তব্য কী?
চমস্কি : ১৮১২ সালের পর এরবারই প্রথমবারের মতো আমেরিকার নিজ ভূমি বহিঃশত্রুদের দ্বারা আক্রান্ত হলো। আমার মনে হয় না এই ঘটনা গুরুতরভাবে দীর্ঘমেয়াদে নাগরিক অধিকারকে সংকুচিত করবে, বিশেষ করে দেশের ভেতরে। আমার বিশ্বাস, এই বিষয়ে আমাদের সাংস্কৃতিক ও প্রাতিষ্ঠানিক বাধাগুলো খুব গভীর। অবশ্য যদি আমেরিকার সিদ্ধান্ত নেয় যে তারা একটা তীব্র হিংস্র আক্রমণের মাধ্যমে এর জবাব দেবে, যেমনটা লাদেন আর দল প্রত্যাশা করছে; সেরকম কোনো হিংস্র সিদ্ধান্ত নিলে তার পরিণতি হবে অভাবনীয়। যদিও এছাড়া অন্যান্য পথও রয়েছে, যা তুলনামূলকভাবে আইনগত এবং গঠনমূলক। এধরনের অসংখ্য উদাহরণও রয়েছে অতীতে। একটা মুক্তি ও গণতান্ত্রিক সমাজের সচেতন ও জেগে ওঠা মানুষেরা চাইলে তাদের নীতিগুলোকে আরো অনেক বেশি মানবিক ও সম্মানজনক দিকে ধাবিত করতে পারে।
প্রশ্ন : সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে থাকা গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর কর্মকান্ড এবং আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো (যেমন : ECHELON) বুঝতেই পারলো না এরকম কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে। যদিও ইসলামিক সন্ত্রাসবাদী দলগুলোর নেটওয়ার্ক এমন কোনো অজানা বিষয় নয়। এটা কীভাবে সম্ভব হলো যে ‘বিগ ব্রাদার’ চোখ বুজে ঘুমোচ্ছিলেন? তাহলে কি এখন আমাদের আরো বড় কোনো ‘বিগ ব্রাদার’-এর ভয়ে থাকতে হবে?
চমস্কি : সত্যি বলতে, নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা হিসেবে ECHELON-এর ভূমিকা নিয়ে ইউরোপ জুড়ে যে ব্যাপক উদ্বেগ চালু আছে তাতে আমি খুব একটা প্রভাবিত হয়নি। এসকল গোয়েন্দা ও নজরদারি সংস্থাগুলোর ব্যর্থতা রীতিমতো ভয়ংকর ও প্রকান্ড। এসব নিয়ে আমি এবং আরো অনেকেই লিখেছে, সেসব আর এখানে বলতে চাই না।
লাদেনের দলটা আসলে গড়ে উঠেছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের সহযোগিতায়, তাদের নিজেদের স্বার্থের জন্য। দলটাকে তারা ততদিন পর্যন্ত সমর্থন করেছে যতদিন পর্যন্ত দলটা তাদের স্বার্থ মিটিয়েছে।
বিন লাদেনের তুলনায় যারা সহজ টার্গেট, যারা বাস্তবত খুবই বিকেন্দ্রিত, কাঠামোগতভাবে খুব একটা সুসংগঠিত নয় এবং বিক্ষিপ্তভাবে সারা দুনিয়াতে ছড়িয়ে আছে। ফলে যারা খানিকটা ধরা ছোঁয়ার বাইরে, তাদের বেলাতেও এধরনের গোয়েন্দা ব্যর্থতার নজিরের প্রমাণ রয়েছে। কোনো সন্দেহ নেই যে এসকল গোয়েন্দা সংস্থাকে প্রচুর টাকা-পয়সা দেওয়া হবে আরো কঠোরভাবে চেষ্টা করার জন্য। কিন্তু এধরনের সন্ত্রাসবাদের হুমকি কমানোর জন্য যেকোনো আন্তরিক প্রচেষ্টার ক্ষেত্রে আসলে যা দরকার তা হলো- হুমকির কারণগুলোকে বোঝা এবং মোকাবিলা করা।
‘শয়তান বিন লাদেন’ এটা কি আসলে কেবল একজন শত্রুর নাম নাকি সে নিজেই একটা ‘ব্র্যান্ড’ বা প্রতীক? বা এক ধরনের চিহ্ন যা নিজেই সমস্ত দুষ্ট বিষয়গুলোকে চরিত্রায়ন করেছে?
বিন লাদেন এই দুষ্কর্মের জন্য সরাসরি দায়ী হতে পারে, নাও হতে পারে। খুব সম্ভবত এটা তার দলের কাজ, যে দলের একজন প্রধান চরিত্র সে নিজে। এবং সেই দলটা আসলে গড়ে উঠেছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের সহযোগিতায়, তাদের নিজেদের স্বার্থের জন্য। দলটাকে তারা ততদিন পর্যন্ত সমর্থন করেছে যতদিন পর্যন্ত দলটা তাদের স্বার্থ মিটিয়েছে। শত্রুপক্ষকে ব্যক্তিগতকরণ করা খুব সহজ। কেননা ব্যক্তিকে সকল বদমাইশির দায়ভার দেয়াটা খুব সহজ কাজ। কোনো ভয়াবহতার পেছনে আসল কারণ জানার চাইতে সেই সকল কিছুর দুষ্টক্ষত হিসেবে ব্যক্তিকে চিহ্নিত করাটা তুলনামূলকভাবে সহজ। খুব স্বাভাবিকভাবেই নিজেকে এধরনের ভয়াবহ ঘটনা থেকে দায় মুক্তি দেওয়ার বা নিজের ভূমিকা অস্বীকার করার একটা প্রবণতা থাকে। কিন্তু ইতিহাস থেকে প্রকৃত ঘটনা উন্মোচন করাটা কঠিন কিছুই নয়। আঞ্চলিক ইতিহাস সম্পর্কে সামান্য খোঁজখবর রাখেন, এমন সকলের কাছেই বিষয়টা বেশ পরিচিত।
প্রশ্ন : এই যুদ্ধটা কি আরেকটা ভিয়েতনাম হতে যাচ্ছে না? ভিয়েতনামের ক্ষতটা আজো দগদগে জীবন্ত হয়ে আছে।
চমস্কি : এই তুলনাটা প্রায়শই দেওয়া হচ্ছে। আমার মতে এটা হচ্ছে পশ্চিমা বুদ্ধিবৃত্তিক ও নৈতিক সংস্কৃতির ওপর এর কয়েকশ বছরের সাম্রাজ্যবাদী হিংসা ও আগ্রাসনের গভীর প্রভাব। ভিয়েতনাম যুদ্ধটা শুরু হয়েছিল দক্ষিণ ভিয়েতনামে আমেরিকার আক্রমণের মধ্য দিয়ে। দক্ষিণ ভিয়েতনাম সবসময়ই আমেরিকার যুদ্ধগুলোর একটা প্রধান টার্গেট ছিল। কিন্তু এই যুদ্ধটা আসলে শেষ পর্যন্ত গড়ায় ইন্দোচীনের একটা বড় অংশের ভয়াবহ ধ্বংসের মধ্য দিয়ে। আমরা যদি এই প্রাথমিক বিষয়টাকে স্বীকার না করি তাহলে ভিয়েতনাম বিষয়ে কোনো গুরুতর আলোচনা হতে পারে না। এটা সত্য যে যুদ্ধটা আমেরিকার জন্য বেশ খরুচে হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু ইন্দোচীনের ওপর যে সুদূরপ্রসারী প্রভাব, সেই ভয়াবহতার কোনো তুলনা চলে না। আফগানিস্তান আক্রমণও রাশিয়ার জন্য খুব মহার্ঘ ছিল, কিন্তু সেটা খুব বড় সমস্যা ছিল না যদি আমরা মূল অপরাধের কথাটা আগে চিন্তা করি।
বিশেষ নোট : নোম চমস্কির একাধিক রেডিও সাক্ষাৎকার এখানে সংকলিত হয়েছে। বেলগ্রেডের Radio B92-কে ২০০১ সালের সেপ্টেম্বর মাসের ১৮ তারিখে দেওয়া সাক্ষাৎকার, এই মাসের ২০ তারিখে জার্মান রেডিও Deutschland Funk Radio-তে Elise Fried এবং Peter Kreysler-কে দেওয়া সাক্ষাৎকার এবং ওই মাসের ২১ তারিখে সুইজারল্যান্ডের Paola Leoni-এর নেওয়া সাক্ষাৎকার এখানে সংকলিত হয়েছে।
তথ্যসূত্র :
9-11: Was There an Alternative? by Noam Chomsky
নাইন ইলেভেন; কোনো বিকল্প ছিল কী? – নোম চমস্কি – চৈতন্য
আপনার মতামত জানানঃ