বর্তমানে গুপ্তসংঘ ইলুমিনাতির অস্তিত্ব পাওয়া যায় ষড়যন্ত্র তাত্ত্বিকদের উদ্ভট কল্পনার জগতে। যাদের কাজই হলো এসব চরিত্র পরিবেশনের মাধ্যমে সমাজে একধরনের ভীতি প্রবণতা জিইয়ে রাখা যে- আমরা আসলে একটা গুপ্তসংঘের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হচ্ছি। শুধু তা-ই নয়, আমরা বাহ্যিকভাবে যাদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হচ্ছি, তারাও আসলে এই গোষ্ঠীর দ্বারা নিয়ন্ত্রিত! এসব সন্দেহই ষড়যন্ত্র তত্ত্ববিদদের মনে একটা ফ্যান্টাসি তৈরি করে।
‘ক্ষমতার পিরামিড’ তত্ত্বও এসব কন্সপিরেসি থিওরিস্টদের আবিষ্কার। যেখানে ইলুমিনাতিরা সবার ওপরে অবস্থান করে। দাবি করা হয়ে থাকে, পিরামিডের চূড়ায় গুপ্ত নিয়ন্ত্রকেরা অবস্থান করে ‘কমিটি অব থ্রি হান্ড্রেড’ রূপে।
বলা হয়- ফ্রিম্যাশন, স্কাল অ্যান্ড বোন্স, ইয়েল এবং বোহেমিয়ান গ্রোভ; এসব প্রধান প্রধান গুপ্তসংঘগুলোর মাঝে ইলুমিনাতি প্রভাব বিস্তার করেছে। তারা নিজেদের কার্যসিদ্ধির জন্য ১৮০০ সাল থেকে শুরু হওয়া সকল যুদ্ধ ও নানাবিধ গর্হিত কর্মকান্ডের ইন্ধন যোগাচ্ছে। এসব তত্ত্ব কোনো যৌক্তিক বোধ তৈরি করে না।
কেনেডির চারপাশে বোহেমিয়ান গ্রোভারবার থাকতো, তাহলে কেন ইলুমিনাতি তাকে হত্যা করতে চাইবে? যেমনটা কেউ কেউ অভিযোগ করে থাকেন। হিরোশিমা শহরে বোমা ফেলা হয় শুধু ‘খ্রিষ্টান অধ্যুষিত’ শহর হওয়ার কারণে নাকি সেখানে গোলাবারুদ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান ছিল বলে? যুদ্ধ ইতিহাসবেত্তারা এর প্রকৃত সত্য জানেন। কিন্তু এসব ষড়যন্ত্র তাত্ত্বিকরা দাবি করে সেখানে ইলুমিনাতি নাকি খ্রিস্টান বিরোধী মিশনে নেমেছিল!
‘শয়তান আসলে ইলুমিনাতির মাধ্যমে কাজ করে’- এটা কট্টর খ্রিষ্টীয় মতবাদ। এসব ধারণা আসলে স্থুল। ‘ইলুমিনাতির পর্দা ফাঁস’ ধরনের ওয়েবসাইটগুলো এই সমস্ত মনগড়া, অযৌক্তিক কথাবার্তা দিয়ে ভরপুর। ক্ষেত্রবিশেষ এটা খুবই দরকারি একটা ফ্যান্টাসি হিসেবে হাজির হয়। যার মাধ্যমে আধুনিক ধান্দাবাজরা মৌলবাদী খ্রিষ্টানদের এজেন্ডা বাস্তবায়নে প্রোপাগান্ডা ছড়ায়। তবে প্রশ্ন জানে, এই ‘ফ্যান্টাসি’র পেছনে কি কোনো ঐতিহাসিক সত্য লুকিয়ে আছে?
১৭৭৬ সালে রথচাইল্ড পরিবারের পৃষ্ঠপোষকতায় অ্যাডাম উইশোপ্ট ষোড়শ শতাব্দীর মুসলিম ‘রোশনিয়া’ গোষ্ঠীর মতো একটা পাশ্চাত্য ঢঙের ‘আলোকিত’ গুপ্তগোষ্ঠী প্রতিষ্ঠা করেন। এই পরিষদে মারকিস ডি সেড ও বিখ্যাত ‘হেলফায়ার ক্লাব’-এর স্যার ফ্রান্সিস ড্যাশউড যোগদান করেন। উইশোপ্ট দীক্ষাদানের তেরটি ক্রম প্রবর্তন করেন, যার প্রথম ৯টির মাঝে মূল ক্ষমতা ছিল। কথিত আছে, তখন থেকেই ইলুমিনাতিরা ফ্রিম্যাসন ও অন্যান্য সংগঠনে অনুপ্রবেশ করতে থাকে। এসবের পেছনে তাদের উদ্দেশ্য ছিল- কীভাবে আন্তর্জাতিক বিষয়াদি নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখা যায় এবং পৃথিবীতে একটা ‘নতুন শাসন ব্যবস্থা’ কায়েম করা যায়।
লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো- শুরু থেকেই এই গোষ্ঠী খ্রিস্টানদের তিনটি প্রধান ‘শংকা’কে সাথে নিয়ে তৈরি হয়েছে। সেগুলো হলো- মুসলিম সম্প্রদায়, ইহুদিদের টাকা এবং ড্যাশউড রূপী শয়তান ও তার শয়তানি সংঘ ‘হেলফায়ার ক্লাব’, যাদের মাধ্যমে ইলুমিনাতি একটি শক্তিশালী দল হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিল।
উইশোপ্ট শিক্ষা দিতেন- মানব ইতিহাসের প্রায় সবই ৫টি জিনিসের ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। ইতিহাসের পাঁচটি পর্যায় আছে। যেমন : বিশৃঙ্খলা অনৈক্য, সংশয়, আমলাতন্ত্র ও পরিণাম; যেখানে সমাজ আবারো বিশৃঙ্খলার দিকে ফিরে যায়।
বলা হয়ে থাকে, তার অধীনস্ত ফ্রিম্যাসনদের দ্বারা তিনি ইউরোপের সব সামাজিক প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস করার চেষ্টা শুরু করেছিলেন। ইলুমিনাতির সমালোচকরা দাবি করে, ফরাসি বিপ্লব আসলে ছিল ‘ইলুমিনাতিবাদ’-এর একটি এক্সপেরিমেন্ট। যদি ঈশ্বর হস্তক্ষেপ না করতেন, তাহলে আজ পুরো ইউরোপেই একই রকম বিপ্লব হতো।
উইশোপ্টের এই নীলনকশা প্রায় সফলই হতে যাচ্ছিল কিন্তু তার দূত, যে কিনা ইলুমিনাতির সাংকেতিক ভাষায় লেখা গুরুত্বপূর্ণ নথি বহন করছিল, তার মাধ্যমে ফ্রিম্যাসন ও ইউরোপের সরকারগুলোকে পরাজিত করা যেত, সেই দূতটি বজ্রপাতে মারা যায়। বলা হয়ে থাকে, ইলুমিনাতিকে আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে যেতে বলপ্রয়োগ করা হয়। কিন্তু তারা কখনোই একেবারে হারিয়ে যায়নি। তারা আবার ফ্রিম্যাসনদের মাধ্যমে প্রভাব বিস্তার করতে থাকে।
ফ্রিম্যাসনরা দুই ভাগে ভাগ হয়ে যায়। একটা গতানুগতিক ফ্রিম্যাসন, আরেকটা ইলুমিনাতি ফ্রিম্যাসন; যা ‘গ্রান্ড ওরিয়েন্ট লজেস’ নামেও পরিচিত ছিল। কথিত আছে, তাদের এই প্রভাব প্রতিপত্তির মাধ্যমে তারা অভীষ্ট লক্ষ্য যেমন : রাজতন্ত্রের পতন, ঈশ্বরে বিশ্বাস নষ্টকরণ, জাতিরাষ্ট্র ও দেশপ্রেমের বিলোপ, সামাজিক স্তরবিন্যাসের ধ্বংস সাধন ইত্যাদি বাস্তবায়নের চেষ্টা করতো।
আরো একটা দাবি করা হয়, ইলুমিনাতিরা জনপরিসর থেকে নিজেদের গোপন করে রাখে। এছাড়া আরো বলা হয়, আমেরিকার মুদ্রায় লিখি ‘নতুস অর্ডো সেকলোরাম’ যার অর্থ ‘নতুন বিশ্ব ব্যবস্থা’; এটা নাকি ইলুমিনাতির প্রভাবের প্রমাণ। এক মুহূর্ত ভাবলে এটাকেও ‘অনর্থক’ বলে মনে হবে। ‘নভুস’ তো সতেজতা বা তারুণ্যকেও নির্দেশ করে। ‘অর্ডো’ শব্দটি বন্দোবস্ত অর্থেও ব্যবহৃত হয়। বাক্যটিকে এভাবেও ব্যাখ্যা করা যায়- ‘নব প্রাণের শুরু’, অর্থাৎ আমেরিকা ঔপনিবেশিক ব্রিটিশদের শিকল ছিঁড়ে নিজেরা কে নব্য ব্যবস্থার উদ্ভব ঘটিয়েছে, যেখানে সুদূর থেকে উড়ে আসা কোনো ভিন দেশি শক্তি নেই। একথা অস্বীকার করার সুযোগ নেই যে, পরবর্তীতে যুক্তরাষ্ট্রের গঠন ও স্বাধীনতার ঘোষণায় ফ্রিম্যাসনদের অবদান আছে। কিন্তু তার মানে কি এই যে, কিছু আত্মস্বীকৃত ইলুমিনাতি অপচ্ছায়ারাই আসলে সব কলকাঠি নেড়েছে?
এছাড়া আরো দাবি করা হয়, ইলুমিনাতিরা নাকি পেঁচা সাদৃশ্য ভবন নির্মাণ করে নিজেদের অস্তিত্বের জানান দেয়। একটা নির্দিষ্ট অ্যাঙ্গেল থেকে দেখলে তাদের তৈরি স্থাপত্যশিল্পে পেঁচার সাদৃশ্য পাওয়া যায় বটে। কারণ ইলুমিনাতিরা প্রতীক হিসেবে একটা পেঁচা বা ‘মোলেখ’-এর উপাসনা করে থাকে (মোলেখ ছিল প্রাচীন ক্যানান ও ফিনিশিয়া অঞ্চলের অগ্নিদেবতা)। সেই সাথে দাবি করা হয়, ওয়াশিংটন ডিসি’র রাস্তার এক অংশের নকশা নাকি পেঁচা সাদৃশ্য! এসব দাবি সাধারণ বুদ্ধি দিয়েই খন্ডন করা সম্ভব। যারা আসলে এভাবে দেখতে চায় শুধূ তারাই এমন আজগুবি জিনিস আবিষ্কার করতে পারে।
মানুষের মুখ চিহ্নিতকরণ ব্যাপারটা মস্তিষ্কে ছাপ দিয়ে গেঁথে দেওয়ার মতো। আমরা ছোটবেলা থেকে মুখ দেখে দেখে অভ্যস্ত, তাই মস্তিষ্ক একে প্রোগ্রামের মতো সাজিয়ে রেখেছে। সেজন্য প্রায়ই বৃক্ষকান্ড, মেঘ বা শিলার গঠনে আমরা মুখাকৃতি দেখতে পাই। মানবমস্তিষ্ক আসলে গঠন বা স্ট্র্যাকচার চিহ্নিত করার জন্যই তৈরি। এর সেরা উদাহরণ- মঙ্গল গ্রহে আপাতত দৃশ্যমান মুখাকৃতি। আদতে কোনো মুখই সেখানে বিদ্যমান নেই। এটা আলোকচিত্র ও শিলার সাথে সূর্যরশ্মির খেলা মাত্র। কিন্তু মানুষের মন নিজ থেকে সেই শূন্যতা পূরণ করে নিজের মতো কিছু একটা কল্পনা করে নেয়।
কার্ল স্যাগান তার বিখ্যাত বই ‘দ্য ডেমন হনটেড ওয়ার্ল্ড’ বইতে এধরনের ভাবধারার ব্যক্তিদের ‘তাৎপর্য খোঁজা নেশাগ্রস্ত লোক’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন, যারা কিনা অস্তিত্বহীন জিনিসেও অর্থের খোঁজ করে। ওয়াশিংটনের পেঁচার বিষয়টাও এই ক্যাটাগরিতে ফেলা যায়।
বলা হয়ে থাকে, যেসব গণমাধ্যম ও সরকার প্রতীক হিসেবে পিরামিড বা সাদৃশ্য জিনিস ব্যবহার করে, তারা আসলে ইলুমিনাতির দ্বারা প্রভাবিত। যেসব ফ্যান্টাসি সিনেমা বা উপন্যাসে নাইট টেম্পলার, পেঁচা ইত্যাদি থাকে তা মূলত ইলুমিনাতির গোপন মেসেজ। হ্যারি পটারের গল্পগুলো নাকি আধুনিককালের সর্বোৎকৃষ্ট উদাহরণ! তাহলে কি জে.কে. রাউলিং-কে এখন ইলুমিনাতির একজন সদস্য হিসেবে বিবেচনা করা উচিত?
অভিযোগ আছে, ইলুমিনাতির কথিত সদস্য যেমন : রকফেলার, রথচাইল্ড, মরগান, রুজভেল্ট, ডলেস ও অন্যান্যরা বিংশ ও একবিংশ শতাব্দীর বহু গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা, বিশ্বযুদ্ধ, রুশ বিপ্লব ইত্যাদির পেছনে কলকাঠি নেড়েছেন। বলা হয়, তারা মানুষের মাঝে বিভাজন তৈরি এবং ভয়ের সংস্কৃতি জারি রেখে নিজেদের কার্যসিদ্ধি করেছেন।
তথ্যসূত্র :
Secret Societies: The Pocket Essential Guide Book by Nicholas Mark Harding
গুপ্তসংঘ – নিক হার্ডিং
আপনার মতামত জানানঃ