অ্যাসাসিনরা হলো ইসমাইলিয়া নামক একটি গোপন মুসলিম সম্প্রদায়ের ধর্মান্ধ শাখা। যাদের মূলমন্ত্র ছিল- আপেক্ষিকভাবে সব কাজই ঠিক। এজন্য তারা তাদের ইচ্ছেমতো যা খুশি তা-ই করতো। ‘অ্যাসাসিন’ শব্দটি ইংরেজি ভাষায় প্রবেশ করেছে ধর্মীয় বা রাজনৈতিক উদ্দেশে হত্যা করার জন্য প্রশিক্ষিত লোকদের বোঝাতে। নিজেদের সময়ে অ্যাসাসিনরা যে কোনো জায়গার জন্য সবচেয়ে ভয়ংকর গুপ্তসংঘ ছিল। কোনো অ্যাসাসিন তার লক্ষ্যে আঘাত হানার আগে বছরের পর বছর অপেক্ষা করতো। কখনো কাজ হাসিল করার জন্য টার্গেটের সাথে বন্ধুত্ব করতো। তারা ব্যাপকভাবে সন্ত্রাসবাদকে উস্কে দিয়েছিল। তারা ভাবতো, তাদের চোখ, কান সর্বত্র ছড়িয়ে আছে। তারা স্বভাবে অত্যন্ত নির্মম ছিল।
গুপ্তহত্যার মিশনে প্রেরণের আগে হাশিশ (গাঁজা জাতীয় নেশা দ্রব্য) প্রয়োগের মাধ্যমে তাদেরকে নেশার রাজ্যে নিয়ে যাওয়া হতো। এজন্য তারা হাশাশিন বা হাশিশসেবী হিসেবে পরিচিত ছিল। যা পরবর্তীকালে পশ্চিমা ভাষাগুলোতে প্রবেশ করে অ্যাসাসিন (Assassin)-এ পরিবর্তিত হয়ে যায়।
এই দলটি একাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে খোরাসনের একজন শিয়া মুসলিম ব্যক্তি হাসান ইবনে সাবাহ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তিনি নিশাপুরে ইসমাইলি মতবাদ নিয়ে পড়াশোনা করেন এবং সেখানকার ধর্মীয় নেতাদের থেকে এই মতবাদের গোপন জ্ঞান সম্পর্কে পান্ডিত্য লাভ করেন। তিনি ইসমাইলি সংঘের মাঝে একটি উচ্চ স্তরে পৌঁছেছিলেন। কায়রো থাকাকালীন সময়ে তিনি ইসমাইলি নেতাদের সাথে বিতর্কে জড়িয়ে পড়েন এবং মিশর ত্যাগ করে আলেপ্পো ও দামেস্ক হয়ে ইরান চলে যেতে বাধ্য হন। সেখানে তিনি তার অনুগামীদের একত্রিত করে ১০৯০ সালে আলমুতের পাহাড়ি দুর্গ দখলের উদ্দেশে যাত্রা করেন। এখানে তিনি একটি গোষ্ঠী প্রতিষ্ঠা করেন। যারা ইসমাইলিদের অনেক শিক্ষাকে গ্রহণ করেছিল এবং একই সাথে শত্রুদের বিরুদ্ধে গুপ্তহত্যার কৌশল রপ্ত করেছিল।
এই নতুন দলের নেতার উপাধি ছিল ‘শাইখুল জাবাব’ বা পাহাড়ের প্রধান। তার অধস্তন আরো তিনটি পদ ছিল। যেমন : ‘দাঈয়ুল কিরবাল’ বা প্রধান ধর্মগুরু, তারপর ‘দাঈ’ বা ধর্মগুরু ইত্যাদি। চতুর্থ স্তরে ‘রফিক’ নামে আরেকটি পদ ছিল, যারা দলের নির্দিষ্ট কিছু বিষয়ে আংশিক জ্ঞানে অধিকারী ছিল। তাদের নিচে ছিল ‘ফেদায়ী’, যারা দলে দীক্ষিত না হওয়া সত্ত্বেও দলের প্রতি ছিল নিবেদিত এবং অন্ধভাবে শাইখুল জাবালের আদেশ মান্য করতো। ফেদায়ীদের গুপ্তহত্যার মিশনে প্রেরণের আগে হাশিশ (গাঁজা জাতীয় নেশা দ্রব্য) প্রয়োগের মাধ্যমে তাদেরকে নেশার রাজ্যে নিয়ে যাওয়া হতো। এজন্য তারা হাশাশিন বা হাশিশসেবী হিসেবে পরিচিত ছিল। যা পরবর্তীকালে পশ্চিমা ভাষাগুলোতে প্রবেশ করে অ্যাসাসিন (Assassin)-এ পরিবর্তিত হয়ে যায়। এদের ষষ্ঠ স্তরে ছিল ‘লাসিক’ তথা শিক্ষানবিশ সদস্যগণ এবং সপ্তম স্তরে ছিল শ্রমিক এবং কারিগর। যাদের কঠোরভাবে ধর্মীয় বিধান অনুসরণ করতে হতো। এর বিপরীতে দীক্ষিত সদস্যদের ধর্ম-কর্মে অনেক বেশি ছাড় দেওয়া হতো। তাদের জন্য ধর্মের শিক্ষা অনুসরণের তেমন গুরুত্ব ছিল না।
১১২৪ সালে হাসান মারা যান এবং তার প্রধান দাঈ উমিদ দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তার অধীনে অ্যাসাসিনরা সিরিয়ায় নিজেদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে এবং শীঘ্রই দুজন খলিফাকে হত্যার মাধ্যমে নিজেদের শক্তিশালী অবস্থান প্রমাণ করে। ১১৬৩ সালে দ্বিতীয় হাসান অ্যাসাসিন রাজ্যে ইসলাম বিলোপের প্রক্রিয়া শুরু করেন। তিনি অদীক্ষিত লোকদের মধ্যে গোপন জ্ঞান ছড়িয়ে দিয়ে তাদের নিজ দলে টানার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু অ্যাসাসিনরা চিরায়ত ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখার জন্য তাকে তার আপন শ্যালকই খুন করেছিল। তার পুত্র দ্বিতীয় মুহাম্মদ ক্রুসেডারদের সাথে আঁতাতের চেষ্টা চালিয়েছিলেন এবং সালাহউদ্দিনের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলেন। সালাহউদ্দিনকে খুন করার জন্য তিনজন আততায়ীকে পাঠিয়েছিলেন তিনি।
স্বাভাবিকভাবে এই ঘটনার পর অ্যাসাসিনরা সালাহউদ্দিনের এক নাম্বার শত্রুতে পরিণত হয়েছিল। ১১৭৬ সালে চিরতরের জন্য সম্প্রদায়টিকে নির্মূল করার জন্য সালাহউদ্দিন তাদের অঞ্চলে অভিযান পরিচালনা করেছিলেন এবং তাদের গুঁড়িয়ে দিতে শুরু করেছিলেন। সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে যাওয়ার ভয়ে অ্যাসাসিনরা সালাহউদ্দিনের সাথে যুদ্ধ বন্ধের জন্য শান্তি আলোচনার করে এবং তাকে হত্যার চেষ্টায় ক্ষান্ত দেয়।
তারা ইসলামিক ভূখন্ডের একটি শক্তি হিসেবে সক্রিয় ছিল। এমনকি তাদেরকে বোম্বের (মুম্বাই, ভারত) মতো দূরবর্তী অঞ্চলেও দেখা যেত বলে কথিত আছে।
এসময় মূলত দুজন নেতা অ্যাসাসিনদের চালাচ্ছিলেন। পারস্যে হাসান আর সিরিয়ায় সিনান। সিনান ছিলেন একজন নির্মম মানুষ। নিজেকে নবী হিসেবে ঘোষণা দিয়েছিলেন। দিনের বেশিরভাগ সময় কেবল একটি পশমের জামা পরিধান করে পাথরের ওপর বসে তার বিশ্বাস প্রচার করতেন।
দ্বিতীয় মুহাম্মদ মারা গেলে তার পুত্র জালালউদ্দিন তখন হাসানের আদেশ প্রত্যাখ্যান করেন। আদেশটি ছিল- অ্যাসাসিনদের কখনোই ধর্মীয় বাধ্যবাধকতা থাকবে না। জালালউদ্দিন বুঝতে পেরেছিলেন, ধর্মের প্রতি ভক্তি তাদেরকে বাহ্যিকভাবে আরো শক্তিশালী করে তুলবে। তাই তিনি ইসলামের প্রতি আনুগত্য বাড়ানোর পক্ষে জোর দিয়েছিলেন। তিনি পূর্বসূরীদের কর্মের জন্য অনুতাপ ও ইসলামের প্রতি তার আন্তরিকতার মাধ্যমে ইসলামি শক্তিগুলোকে বিশ্বাস করাতে পেরেছিলেন যে, তিনি ভিন্ন চিন্তার মানুষ। ফলে দুর্বল ও নিষ্ক্রিয় শাসক আলাউদ্দিনের পরিবর্তে জালালউদ্দিন তার স্থলাভিষিক্ত হন। তিনি অ্যাসাসিনদের সাথে দূরত্ব রেখে চলতেন। নিজের ভেড়া চরাতেই বেশি পছন্দ করতেন। এটা ছিল অ্যাসাসিনদের সমাপ্তির সূচনা। এমন সময় পূর্ব থেকে মঙ্গোল সেনারা আগমন করলে তাদের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হয় অ্যাসাসিনদের।
আলাউদ্দিনের পুত্র রুকনদ্দিন মঙ্গোলদের জোয়ার থামানোর চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু তাকে অপহরণ করে হত্যা করা হয়েছিল। ফলস্বরূপ পারস্যে অ্যাসাসিনদের শক্তি ধ্বংস হয়ে যায় এবং মাত্র অল্প কয়েকজন বিপর্যস্ত সদস্য দলটির ভবিষ্যৎ পুনর্জীবনের আশা বুকে নিয়ে অন্তরালে চলে যায়।
১২৬০ সালে মিশরের মামলুক সুলতান মঙ্গোল সেনাবাহিনীকে বিতাড়িত করে আলমুতের দুর্গ পুনরুদ্ধার করেন। মিশরীয়দের নিয়ন্ত্রণে অ্যাসাসিনদের ভাগ্যে পুনরুত্থান ঘটেছিল। অ্যাসাসিনরা বহু শতাব্দী ধরে মধ্যপ্রাচ্যে একটি শক্তিশালী বাহিনী হিসেবে টিকে ছিল। যদিও তারা আগের মতো শক্তিশালী ছিল না। তারপরেও তারা ইসলামিক ভূখন্ডের একটি শক্তি হিসেবে সক্রিয় ছিল। এমনকি তাদেরকে বোম্বের (মুম্বাই, ভারত) মতো দূরবর্তী অঞ্চলেও দেখা যেত বলে কথিত আছে। অন্যান্য সিক্রেট সোসাইটির ওপর অ্যাসাসিনদের ব্যাপক প্রভাব ছিল। সমস্ত পশ্চিমা সিক্রেট সোসাইটি তাদের মৌলিক কাঠামো এবং মতবাদ যে টেম্পলারদের কাছ থেকে গ্রহণ করেছিল, সেই টেম্পলাররা এই ইসমাইলি দলটির কাছে চরমভাবে ঋণী। টেম্পলাররা তাদের গ্র্যান্ড মাস্টার্স, গ্র্যান্ড প্রিয়ারস এবং দীক্ষার স্তরগুলো অ্যাসাসিনদের কাছ থেকে গ্রহণ করেছিল।
তথ্যসূত্র :
Secret Societies: The Pocket Essential Guide Book by Nicholas Mark Harding
গুপ্তসংঘ – নিক হার্ডিং
আপনার মতামত জানানঃ