১৮১৬ সালে মাদ্রাজ লাইব্রেরির সাহিত্য গেজেটে জনৈক ড. শেরউডের লেখা একটি নিবন্ধ পাওয়া যায়, তিনি আততায়ীদের একটি রহস্যময় গোপন গোষ্ঠী সম্পর্কে গুজব শুনেছিলেন। এই নিবন্ধটিই ছিল প্রথম কোনো লিখিত বক্তব্য, যেখানে একটি আধ্যাত্মবাদী দলের অস্তিত্বের কথা স্বীকার করা হয়েছিল, যারা কিনা হিন্দুদের দেবী কালি’র নামে হত্যাযজ্ঞ চালাতো। কালি ছিলেন রক্তপিপাসার বাস্তব উদাহরণ। তার চারটি বাহু, রক্ত রাঙা চোখ। কোলকাতায় তার নামে একটি জায়গায় রয়েছে- কালিঘাট; যার অর্থ ‘কালির পদক্ষেপ’।
ঠগী ছিল এমন সম্প্রদায়, যারা বংশপরম্পরায় এর সদস্য হতো। হিন্দু ও মুসলিম উভয় সম্প্রদায় থেকে যারা জাত ও ধর্মের বেড়াজাল অতিক্রম করতে পারতো তারাই এর সদস্যপদ লাভ করতো।
ঠগ পিতাগণ কৈশোর বয়সে তাদের পুত্রদেরকে সম্প্রদায়ের গোপন সহস্যের সাথে যুক্ত করতো। তাদেরকে প্রথমে কোনো কিছু না বলে একটি ঠগী আস্তানায় নেওয়া হতো। পরবর্তী সময়ে তাদের জানানো হতো, এই দলের লক্ষ্য ডাকাতি করা। এরপর তাদেরকে সরাসরি একজন লোককে শ্বাসরোধ করার মাধ্যমে হত্যা করে দেখানো হতো, যা ছিল একটি ভয়াবহ পদ্ধতি। সম্ভবত এটিই একমাত্র গোপন গোষ্ঠীর উপাচার, যেখানে অন্য কোনো ব্যক্তিকে দীক্ষাপ্রার্থীর জন্য প্রকৃত মৃত্যুর মুখোমুখি হতে হতো। অবশেষে ঠগী জীবনের অভিজ্ঞতা অর্জনের পর দীক্ষাপ্রাপ্তরা ‘ভুর্তোটের’ মর্যাদা অর্জন করতো।
সব ঠগীই দলের সদস্যদের ঔরস থেকে জন্ম নেয়নি। বহিরাগতদেরও দলে প্রবেশের জন্য প্রচুর সুযোগ ছিল, বিশেষত যদি তারা সমাজের কোনো গুরুত্বপূর্ণ এবং শক্তিশালী পদে অধিষ্ঠিত থাকতো, যাদেরকে দলের উপকারে কাজে লাগানো সম্ভব।
কালি’র সব ভক্তই ঠগ ছিল না, তবুও ধারণা করা হয়েছিল, ভারতে সেসময় কমপক্ষে ৫ হাজার ঠগ ছিল। দলটিকে অনেক প্রাচীন বলে দারি করা হয়। বলা হয়ে থাকে, গ্রিক ঐহিাসিক হেরোডোটাস মধ্য এশিয়ায় বসবাসকারী সাগরটিয়ানদের নাম রহস্যপূর্ণভাবে উল্লেখ করে সম্ভবত ঠগীদের উৎসের কথা বলেছেন, যা প্রায় দুই হাজার বছরেরও বেশি পুরোনো। এদের সম্পর্কে বলা হয় যে, এরা স্রেফ একটি কর্ড বা বড় রুমাল দিয়ে শ্বাসরোধ করতে সক্ষম ছিল। এজন্যই হয়তো ঠগীরা বিখ্যাত।
ঠগীরা বিশ্বাস করতো, তাদের কর্মকান্ডগুলো অষ্টম শতাব্দীতে ইলোরা গুহার মন্দিরে খোদাই করে চিত্রিত হয়েছিল। তবে এই জাতীয় খোদাই কখনো পাওয়া যায়নি। এগুলো সম্ভবত দলের নতুন অনুসারীদের কাছে বলা পৌরাণিক কাহিনী বা গল্প ছিল। ১৩ শ’ শতাব্দীতে দিল্লির সুলতান জালাল উদ্দিন খিলজির রাজত্বকালে এক হাজার ঠগকে গ্রেপ্তার করে দিল্লি থেকে বাংলায় নির্বাসন দেওয়া হয়েছিল।
পরবর্তী শতাব্দীর গোড়ার দিকে নিজাম উদ্দিন নামে একজন শীর্ষস্থানীয় ঠগ দিল্লি থেকে বহিরাগত আক্রমণকারীদের বিতারিত করতে সহায়তা করেছিলেন, যা প্রমাণ করে ঠগীরা শক্তিশালী সংগঠন এবং শাসক শ্রেণির জন্য একধরনের ভয় প্রদর্শনের অস্ত্র হয়ে উঠেছিল। এক পর্যায়ে ব্রিটিশরা আবিষ্কার করেছিল, উঁচু স্তরের ভারতীয় মহাজনরা এই দলের সাথে জড়িত।
নিজেদের কর্মকান্ডের মাধ্যমে ঠগীরা প্রচুর সম্পদ অর্জন করেছিল। যদিও তারা মিতব্যয়ী এবং সাদাসিদা জীবনযাপন করতো, কিন্তু তারা ঘুষ এবং অন্যান্য অনৈতিক কর্মকান্ডে অর্থের একটি উৎস হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
ঠগীদের হত্যার পদ্ধতিটি ছিল শ্বাসরোধ করা, কাজটা করতো পেছন দিক থেকে একটি হলুদ রেশমী কাপড়েরর রুমাল ব্যবহার করা হতো। ঠগ শব্দটি হিন্দি ক্রিয়াবাচক শব্দ ‘থাগ লেনা’ থেকে এসেছে। যার অর্থ ‘প্রতারণা’।
এই নামের কারণ- ঠগরা তাদের শিকারদের সাথে বন্ধুত্ব করতো এবং তাদেরকে নিরাপদবোধ করাতো, প্রলুব্ধ করতো (অ্যাসাসিনদের সাথে তাদের এই অংশে মিল রয়েছে)। প্রায়ই নিরাপদ আশ্রয় খোঁজা সফররত বণিকের ছদ্মবেশে তারা বিশ্বাস অর্জন করতো। পিন্ডারিদের মতো ঘাতক দস্যু দলগুলোর জন্য ভারতের রাস্তাঘাট সেসময় অত্যন্ত বিপদজনক ছিল। ভীতু মুসাফিররা ছদ্মবেশী ঠগীদের দেখা পেয়ে খুব খুশি হতো। ছদ্মবেশী ঠগরা দীর্ঘসময় তাদের শিকারদের সাথে সফর করতো এবং একই সাথে তাদের আস্থা ও বন্ধুত্ব অর্জন করতো। পথে যেন কোনো সন্দেহ তৈরি না হয় এজন্য তারা প্রায়ই একটি ব্যাকআপ গ্রুপ রাখতো যারা পথের সাঝে যাত্রীদের সাথে যোগ দিতো, যেন তাদের সন্দেহ থাকলে তা দূর হয়ে যায়। ঠগরা রামসি নামে একটি গোপন ভাষাও তৈরি করেছিল, যার মাধ্যমে তারা অপরিচিতদের সাথে থেকেও প্রকাশ্যে নিজেদের মাঝে কথা বলতে বা সংকেত বিনিময় করতে পারতো।
ঠগরা প্রতিনিয়ত তাদের হত্যাযজ্ঞ চালানো জন্য নির্দিষ্ট কিছু বন ও জঙ্গল ব্যবহার করতো। যখন তারা কাঙ্খিত জায়গায় পৌঁছে যেত তখন প্রতিটি ঠগ সুবিধামতো তাদের শিকারের আশপাশে অবস্থান করতো। একটি গোপন কমান্ড বলার সাথে সাথে মারাত্মক ক্ষিপ্রতায় ঠগরা তাদের শিকারকে পেছন দিক থেকে শ্বাসরোধ করে ফেলতো। মূল্যবান জিনিসপ্রগুলো নেওয়ার পরে মৃতদেহগুলো আগে থেকে খনন করা কবরে ফেলে দেওয়া হতো। তাড়াতাড়ি পচনের জন্য তারা দেহগুলোতে গভীর ক্ষত করতো। যেন শিয়াল বা অন্যান্য পচা মাংসভোজী প্রাণী তাদেরকে খুঁজে না পায়, প্রাণীগুলো খুঁজে পাওয়ার আগেই যেন লাশের দেহ তাদের আহারের অনুপোযুক্ত হয়ে পড়ে।
ব্রিটিশরা, বিশেষত স্যার উইলিয়াম হেনরি স্লিম্যান-এর (১৭৮৮-১৮৫৬) অধীনে ঠগীদের দমনের সিদ্ধান্ত নিলে তাদের শক্তি হ্রাস পেতে শুরু করে। শুরুর দিকে ঠগীদের দমন করা কঠিন বলে প্রমাণিত হয়েছিল। একবারে কিছু ঠগীকে বন্দী করা হতো এবং তাদের সঙ্গীদের অবস্থান প্রকাশ করতে বাধ্য করা হতো। কালি তাদেরকে পরিত্যাগ করেছেন ভেবে সদস্যরা দল ত্যাগ করতে থাকলে সামগ্রিকভাবে ঠগীদের ক্ষমতা কমতে শুরু করে। অনতিবিলম্বে দলটি বিলুপ্ত হয়ে যায়। যদিও গুজব আছে, ভারত জুড়ে এখনো তাদের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র উপদলের অস্তিত্ব রয়েছে।
তথ্যসূত্র :
Secret Societies: The Pocket Essential Guide Book by Nicholas Mark Harding
গুপ্তসংঘ – নিক হার্ডিং
আপনার মতামত জানানঃ