প্রশ্ন : টুইন টাওয়ার হামলার মিডিয়া কভারেজকে আপনি কীভাবে দেখছেন? এটা কি মধ্যপ্রাচ্য আক্রমণ করার জন্য ‘সম্মতি উৎপাদন’-এর মতো সমান্তরাল ঘটনা?
চমস্কি : মিডিয়া কভারেজ ঠিক সবক্ষেত্রে একই রকমের নয় যেমনটা সাধারণত ইউরোপীয়রা বিশ্বাস করে থাকেন। কারণ তারা সম্ভবত নিউ ইয়র্ক টাইমস, জাতীয় বেতার কিংবা টিভি ইত্যাদির ওপর আস্থা রাখছেন। নিউ ইয়র্ক টাইমস আজ সকালে মেনে নিয়েছে গত কয়েকদিন ধরে তারা যা প্রচার করে আসছিল তার তুলনায় নিউ ইয়র্কের মনোভাব বেশ আলাদা।
দ্য টাইমস এখন রিপোর্ট করেছে, ‘নিউ ইয়র্কের রাস্তায় যুদ্ধের দামামার শব্দ এখন খুবই ক্ষীণ…’ এবং এখন শান্তির ডাক দেওয়া হচ্ছে। বলা হচ্ছে ‘শান্তির ডাকের সংখ্যা প্রতিশোধের ডাকের চেয়ে বেশি’। এমনকি যারা এই হামলার ভিকটিম, তাদের জন্য শোক প্রকাশ করার স্থানেও এরকম মতামত শোনা যাচ্ছে। পুরো দেশেই এমনটা হচ্ছে, যা অস্বাভাবিক কিছু নয়। এটা নিশ্চিত যে, সারা দেশেই আমরা সকলেই মনে করি হামলাকারীদের যদি খুঁজে পাওয়া যায়, তাদের যথাযথ শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। কিন্তু আমার মনে হয়, এই মানুষদের একটা বড় অংশই শাস্তির নামে অন্ধভাবে পাল্টা হামলা চালানো ও নিরীহ মানুষ খুন করার বিরুদ্ধে।
কিন্তু এটা খুব সাধারণ একটা লক্ষণ যে প্রধান মিডিয়া এবং সাধারণ অর্থে বুদ্ধিজীবী শ্রেণি সবাই এই ধরনের সংকটের সময়গুলোতে লাইন ধরে শক্তিমানের সমর্থন করে থাকে এবং জনগণের মতামতকেও সেই শক্তিমানদের পক্ষে টানার চেষ্টা করে। সার্বিয়াতে বোমা ফেলার সময় এমনটাই ঘটেছিল, অনেকটা হিস্টিরিয়া আক্রান্ত উন্মাদনার মতো। গালফের যুদ্ধ মোটেও অস্বাভাবিক ছিল না। বেশ পুরোনো ইতিহাসেও এই ধরনটা খুঁজে পাওয়া যাবে।
প্রশ্ন : ধরে নিচ্ছি, সন্ত্রাসবাদীরা ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারকে (টুইন টাওয়ার) বেছে নিয়েছিল একধরনের প্রতিকী লক্ষ্য হিসেবে, কিন্তু বিশ্বায়ন এবং সাংস্কৃতিক আধিপত্য কীভাবে আমেরিকার বিরুদ্ধে এই ধরনের ঘৃণা উৎপাদনে সাহায্য করেছিল?
চমস্কি : এটা হলো পশ্চিমা বুদ্ধিজীবিদের জন্য দারুণ সুবিধাবাদী সহজ একটা বিশ্বাস। এটা তাদেরকে সত্যিকারের কারণটা খুঁজে বের করার পরিশ্রম থেকে এক ধরনের দায়মুক্তি দেয়। ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারকে আক্রমণের লক্ষ্য হিসেবে বেছে নেওয়ার পেছনে যে প্রকৃত কারণগুলো রয়েছে সেগুলো খোঁজার পরিশ্রম থেকে বাঁচিয়ে দেয়। তাহলে প্রশ্ন তোলা যায়, ১৯৯৩ সালে কি বোমা হামলা করা হয়েছিল বিশ্বায়ন আর সাংস্কৃতিক আধিপত্যের কারণে? তারও বিশ বছর আগে কি আনোয়ার সাদাত খুন হয়েছিলেন বিশ্বায়নের কারণে? এই একই কারণে কি সিআইএ’র সমর্থনপুষ্ট ‘আফগান’রা আফগানিস্তানে কিংবা এখন চেচনিয়াতে রাশিয়ানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে?
এটা হলো পশ্চিমা বুদ্ধিজীবিদের জন্য দারুণ সুবিধাবাদী সহজ একটা বিশ্বাস। এটা তাদেরকে সত্যিকারের কারণটা খুঁজে বের করার পরিশ্রম থেকে এক ধরনের দায়মুক্তি দেয়।
ধনী ও সুবিধাপ্রাপ্ত মিশরীয়দের দৃষ্টিভঙ্গি ও মতামত নিয়ে কিছুদিন আগে ‘ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল’ রিপোর্ট করেছিল, যারা একটা ম্যাকডোনাল্ডসে বসে ছিল খুব কেতাদুরস্ত আমেরিকান স্টাইলের পোশাক পরে। তারা খুব তিক্তভাবে আমেরিকার সমালোচনা করেছিল, মূলত আমেরিকার নীতির প্রশ্নে। যা আমাদের সকলেরই জানা, অন্তত যারা জানতে চান আরকি। এরা আরেকটা রিপোর্ট প্রকাশ করেছিল, এই অঞ্চলের ধনী-সম্পদশালী ও সুবিধাপ্রাপ্ত মানুষদের দৃষ্টিভঙ্গি জানার জন্য, যারা সবাই ছিলেন আমেরিকাপন্থী মানুষ। কিন্তু তারাও আমেরিকার নীতির খুব কট্টর সমালোচনা করেছিলেন। এটাও কি বিশ্বায়ন বা ম্যাকডোনাল্ডস আর জিন্সের প্রভাব? রাস্তাঘাটে সাধারণ মানুষের প্রতিক্রিয়া একই রকমের কিন্তু এসকল ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়ার সাথে ফ্যাশন দুরস্ত অজুহাতের কোনো সম্পর্ক নেই।
আমেরিকা ও পশ্চিমের জন্য এসকল অজুহাত হচ্ছে সহজ ও সুবিধাজনক অজুহাত। নিউ ইয়র্ক টাইমসের প্রধান বিশ্লেষণটা (সেপ্টেম্বর ১৬) দেখুন- ‘হামলাকারীরা মূলত পশ্চিমা মূল্যবোধ যেমন : স্বাধীনতা, সহনশীলতা, সাফল্য, ধর্মীয় সহাবস্থান আর সার্বজনীন নাগরিক অধিকারের প্রতি ঘৃণাবশত এই হামলা চালিয়েছে।’ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রর ভূমিকা এখানে অপ্রাসঙ্গিক এবং সেজন্য এখানে উল্লেখও করা হয়নি। এটা বাস্তবের একধরনের সুবিধাজনক ছবি কিন্তু এই প্রসঙ্গে সাধারণ অবস্থানটা বুদ্ধিবৃত্তিক ইতিহাসে খুব একটা অজানা নয়, বাস্তবত এটাই আমাদের প্রচলিত মূল্যবোধের খুব কাছাকাছি। ঘটনাচক্রে এসব হচ্ছে আমাদের জানাশোনার সম্পূর্ণ বিপরীত ধরনের ঘটনা কিন্তু আমরা এটাও জানি ক্ষমতার প্রতি এদের এই আত্মতোষণ আর শর্তহীন সমর্থন রয়েছে। তবে এর প্রধান সমস্যা হলো- এটা খুব সুনির্দিষ্টভাবে নৃশংসতাকে আরো বাড়িয়ে তোলে এবং বিশেষত আমাদের দিকে এবং কখনো কখনো ৯/১১-এর চেয়েও তা আরো ভয়াবহ হয়ে ওঠে।
বিন লাদেন আর তার দলের জন্য এসকল বিষয় অর্থাৎ বিশ্বায়ন কিংবা সাংস্কৃতিক আধিপত্যবাদ কোনো বিবেচ্য বিষয়ই নয়, ঠিক যেমনটা তারা মধ্যপ্রাচ্যের গরীব-দুঃখী ও শোষিত মানুষদের বারোটা বাজিয়ে এসেছে বহু বছর ধরে। তারা সবাই আমাদের বলে এদের আপত্তির জায়গাগুলো, খুব সরাসরি ও স্পষ্টভাবে। তারা এই অঞ্চলে একটা চরম দুর্নীতিবাজ, নিপীড়ক ও অনৈসলামিক শাসনের বিরুদ্ধে এবং এই জান্তার সমর্থকদের বিরুদ্ধে জিহাদ করছে, ঠিক যেমন জিহাদ করেছিল ১৯৮০ সালের দিকে আফগানিস্তানে, রাশিয়ার বিরুদ্ধে (এবং একই রকমের জিহাদ করছে এখন চেচনিয়াতে, পশ্চিম চীনে, মিশরে এবং মিশরের বেলায় সেই ১৯৮১ সাল থেকে অর্থাৎ আনোয়ার সাদাতের হত্যাকান্ডের পর থেকেই)।
এমনকি বিন লাদেন নিজে সম্ভবত গ্লোবালাইজেশন বা বিশ্বায়ন শব্দটা কখনো শোনেইনি। যার তার খুব বিস্তারিত সাক্ষাৎকার নিয়েছে, সাংবাদিক রবার্ট ফিস্কের মতো, তাদের অনেকেই অনেকেই বলেছে, বিন লাদেন আসলে দুনিয়ার বর্তমান হাল-হকিকত সম্পর্কে কিছুই জানে না। এমনকি জানার প্রয়োজনও বোধ করে না। আমরা চাইলে এসকল বাস্তবতাই অস্বীকার করতে পারি এবং আমাদের নিজেদের ফ্যান্টাসির মাঝে ডুবে থাকতে পারি। সেই সাথে আমরা চাইলে বিন লাদেন এবং তার সঙ্গীদের মতো ‘আফগানি’দের মূল শেকড়ের ইতিহাসটা ভুলে থাকতে পারি।
প্রশ্ন : আমেরিকান জনগণ কি এসব দেখা ও বোঝার মতো যথেষ্ট শিক্ষিত? অর্থাৎ আমেরিকানদের মাঝে কি এসকল বিষয়ে কোনো সচেতনতা আছে?
চমস্কি : দূর্ভাগ্যবশত, নেই। যেমনটা ইউরোপিয়ান জনগণের মাঝেও নেই। মধ্যপ্রাচ্যের অভিজাত বলয়ে (এমনকি সাধারণ মানুষের মাঝেও) সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি নিয়ে আমাদের ভাবনা নেই বললেই চলে। আমাদের এখানে ওসব নিয়ে কোনো বোঝাপড়া নেই। যেমন : সুনির্দিষ্টভাবে বলা যায়, ইরাকে হামলা ও ইসরায়েলের সামরিক দখলদারিত্ব বিষয়ে আমেরিকার যে দ্বৈত নীতি; এসব নিয়ে আমাদের কোনো উপলব্ধি বা বোঝাপড়া নেই।
ইসরায়েল এবং আমেরিকার সম্পর্ক নিয়ে খুব কদাচিৎ মূলধারার মিডিয়াগুলোতে আলোচনা আসে এবং সারা পৃথিবীতেই এই বিষয়ে একটা অজ্ঞতা বিরাজ করছে, বিশেষত অভিজাত বুদ্ধিবৃত্তিক সমাজের মাঝে।
যদিও ইরাকের প্রসঙ্গটা পশ্চিমারা ভিন্ন বয়ান বিশ্বাস করতে চায়, কিন্তু গত দশ বছরে ইরাকে আমেরিকান নীতির কারণে ইরাকে ভয়াবহ অবস্থা হয়েছে, ওখানকার নাগরিক সমাজ সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে গেছে কিন্তু সাদ্দাম হোসাইনকে করে তুলেছে অসীম ক্ষমতার অধিকারী। এমনকি নাগরিকরা জানেন যে আমেরিকা সাদ্দাম হোসাইনের মতো শাসককে সকল অর্থেই সরাসরি সমর্থন করেছে, সাদ্দামের সব ভয়াবহ নির্যাতন, নিপীড়ন সমর্থন করেছে। ১৯৮৮ সালের কুরদ জনগোষ্ঠীর ওপর করা গ্যাস চেম্বার নিপীড়নের ঘটনাটিও বাদ যায়নি। যখন বিন লাদেন এসব বিষয় উল্লেখ করে এই অঞ্চলের প্রচার মাধ্যমে প্রচারণা চালায়, তখন কিন্তু এই অঞ্চলের মানুষেরা তা বুঝতে পারে। এমনকি যারা তাকে পছন্দ করে না, তারাও তার যুক্তিটা ধরতে পারে। ইসরায়েল এবং আমেরিকার সম্পর্ক নিয়ে খুব কদাচিৎ মূলধারার মিডিয়াগুলোতে আলোচনা আসে এবং সারা পৃথিবীতেই এই বিষয়ে একটা অজ্ঞতা বিরাজ করছে, বিশেষত অভিজাত বুদ্ধিবৃত্তিক সমাজের মাঝে।
ক্যাম্প ডেভিডে ২০০০ সালের গ্রীষ্মে যে শান্তি আলোচনা হয়েছিল, সেটার ‘উদারতা’ আর ‘মহানুভবতা’ নিয়ে অবশ্য মধ্যপ্রাচ্যের এই অঞ্চলের জনগণের মাঝে আমেরিকানদের মতো ‘সুখকর’ বিভ্রান্তি নেই। অন্যান্য সুবিধাজনক (আমেরিকানদের জন্য) মিথ্যাচারগুলোর কথা বাদই দিলাম।
এই প্রসঙ্গগুলো নিয়ে অজস্র লেখা প্রকাশিত হয়েছে, খুব গ্রহণযোগ্য উৎস থেকে দলিল দস্তাবেজসহ এই তথ্যগুলোকে সংকলন করা হয়েছে, কিন্তু তবুও এগুলো নিয়ে মানুষের জানাশোনা খুব সামান্যই।
প্রশ্ন : এই প্রসঙ্গে মার্কিন সরকারের প্রতিক্রিয়াকে আপনি কীভাবে দেখেন? আসলে কার মতামতকে তারা প্রতিনিধিত্ব করছে?
চমস্কি : (চলমান…)
সাক্ষাৎকারের পরবর্তী অংশটি পড়তে এখানে ক্লিক করুন : টুইন টাওয়ার হামলা ও লাদেন প্রসঙ্গে নোম চমস্কি (পর্ব-২)
বিশেষ নোট : নোম চমস্কির একাধিক রেডিও সাক্ষাৎকার এখানে সংকলিত হয়েছে। বেলগ্রেডের Radio B92-কে ২০০১ সালের সেপ্টেম্বর মাসের ১৮ তারিখে দেওয়া সাক্ষাৎকার, এই মাসের ২০ তারিখে জার্মান রেডিও Deutschland Funk Radio-তে Elise Fried এবং Peter Kreysler-কে দেওয়া সাক্ষাৎকার এবং ওই মাসের ২১ তারিখে সুইজারল্যান্ডের Paola Leoni-এর নেওয়া সাক্ষাৎকার এখানে সংকলিত হয়েছে।
তথ্যসূত্র :
9-11: Was There an Alternative? by Noam Chomsky
নাইন ইলেভেন; কোনো বিকল্প ছিল কী? – নোম চমস্কি – চৈতন্য
আপনার মতামত জানানঃ