প্রশ্ন : আমেরিকানদের পক্ষে কি তথাকথিত সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে বিজয়ী হওয়া সম্ভব? উত্তর যদি ‘হ্যাঁ’ হয়, তাহলে কীভাবে সম্ভব? আর যদি ‘না’ হয়, তাহলে নিউ ইয়র্ক বা ওয়াশিংটনে যেধরনের হামলা হলো, সেধরনের হামলা ভবিষ্যতে প্রতিহত করার জন্য বুশ প্রশাসনের কী করা উচিত?
চমস্কি : আমরা যদি প্রশ্নটি নিয়ে খুব গুরুত্ব দিয়ে আলোচনা করতে চাই তাহলে শুরুতেই স্বীকার করে নিতে হবে- পৃথিবীর বড় একটি অংশের কাছে যুক্তরাষ্ট্র সবচেয়ে বড় সন্ত্রাসবাদী রাষ্ট্র এবং তার পেছনে যথেষ্ট যুক্তিসঙ্গত কারণ আছে। ধরুন, আমরা মনে করতে পারি, ১৯৮৬ সালে বিশ্ব আদালত আমেরিকাকে সমালোচনা করেছিল ‘বেআইনি শক্তি ব্যবহারের কারণে’ (আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদ) এবং পরে নিরাপত্তা পরিষদ একটি প্রস্তাবনা উত্থাপন করেছিল, যেখানে আমেরিকার সকল রাজ্যকে আন্তর্জাতিক আইন মেনে চলার আহবান জানানো হয়েছিল। এটা হচ্ছে অসংখ্য উদাহরণের মাঝে একটি উদাহরণ মাত্র।
কিন্তু প্রশ্নটিকে যদি সংকীর্ণ অর্থে দেখি, সেক্ষেত্রে আমরা খুব ভাল করে জানি, আমাদের দিকে তাক করা অন্যদের সন্ত্রাসবাদী তৎপরতাকে কীভাবে মোকাবিলা করতে হবে, যদি আমরা এই ধরনের হুমকিকে বাড়ানোর বদলে কমাতে চাই। যখন আইরিশ রিপাবলিক আর্মি (আইআরএ) লন্ডনের বাণিজ্যিক এলাকায় বোমা হামলার ঘটনা ঘটালো তখন কিন্তু পশ্চিম বেলফাস্ট বা বোস্টনে পাল্টা বোমা হামলার কথা চিন্তা করা হয়নি। যারা আইআরএকে অর্থ সাহায্য করে, তাদের ওপর হামলা চালানোর কথা চিন্তা করা হয়নি। যা করা হয়েছে তা হলো- এসকল অপরাধীদেরকে চিহ্নিত করার চেষ্টা করা হয়েছে, তাদের পেছনের শক্তির ও পরিকল্পনার কথা জানার চেষ্টা করা হয়েছে।
ওকলাহামাতে যখন ফেডারেল ভবনে বোমা হামলা হলো তখনো অবশ্য মধ্যপ্রাচ্যে পাল্টা হামলার করার প্রস্তাব উঠেছিল, এবং সম্ভবত হামলা করেও ফেলা হতো যদি এই হামলার উৎস মধ্যপ্রাচ্যে পাওয়া যেত। যখন জানা গেল যে হামলাটা অভ্যন্তরীণ এবং চরম ডানপন্থীদের সাথে সম্পর্কযুক্ত, তখন কিন্তু মন্টানা কিংবা ইডাহোতে বোমা ফেলার ডাক দেয়নি কেউ। বরং, হামলাকারীদেরকে খুঁজে বের করার জন্য কাজ করা হয়েছে, তাদেরকে খুঁজে পাওয়ার পর আদালতের মুখোমুখি করা হয়েছে এবং বিচারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এরপরেও বোঝার চেষ্টা করা হয়েছে এই ধরনের হামলার পেছনে কারণটা কী হতে পারে, ঠিক কোনধরনের হিংসা কাজ করেছে এরকম হামলার পেছনে এবং কীভাবে এধরনের অপরাধকে প্রতিহত করা যেতে পারে। অন্য দশটা অপরাধের মতো এর পেছনে নিশ্চিতভাবেই কোনো কারণ আছে এবং আমরা যদি তা খুঁজে পাই ও সেটাকে খুব মারাত্মক কিছু মনে করি তাহলে সেটার সমাধান করতেই হবে।
অপরাধ যে মাত্রার হোক না কেন তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য সবসময়ই আইনসম্মত পথ খোলা আছে। আর এই ধরনের উদাহরণও আছে আমাদের সামনে। একটি স্পষ্ট উদাহরণ তো এইমাত্র দিলাম। আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়ার প্রেক্ষিতে আমাদেরকে সব ধরনের বিতর্কের উর্ধ্বে থাকতে হবে।
আশির দশকের নিকারাগুয়া হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেরআক্রমণ ও হামলায় চরমভাবে বিধ্বস্ত একটি দেশ। লাখখানেক মানুষ নিহত হয়েছে এসকল হামলায়। পুরো দেশটা ধ্বংস হয়ে গেছে এবং সম্ভবত আর কখনোই উঠে দাঁড়াতে পারবে না। আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদী হামলা আর এর সাথে রয়েছে বিধ্বংসী অর্থনৈতিক যুদ্ধ। এসবের বিপরীতে নিকারাগুয়ার মতো একটি ছোট্ট দেশের পক্ষে টিকে থাকাই কঠিন। এই দেশটির চারপাশে রয়েছে ভয়ংকর সব শক্তিমান দেশগুলো। নিকারাগুয়ার প্রধান ঐতিহাসিক থেমাস ওয়াকার বিস্তারিত লিখেছেন এই প্রসঙ্গে।
নিকারাগুয়ার ওপর এসকল হামলার পরিণতি ছিল নিউ ইয়র্কের সেই হামলার চাইতেও অনেক বেশি প্রকট ও করুণ। তারা কিন্তু ওয়াশিংটনে পাল্টা বোমা হামলা করে জবাব দেয়নি। তারা বিশ্ব আদালতে গিয়েছিল, আদালত রিকারাগুয়ার পক্ষে রায় দিয়েছিলেন। রায়ে আমেরিকাকে দুঃখপ্রকাশ করা সহ যথাযথ ক্ষতিপূরণ দিতে বলা হয়েছিল। আমেরিকা বিশ্ব আদালতের রায়কে উপেক্ষা করেছিল এবং আরো বড় হামলার আয়োজন করেছিল তার জবাবে! ফলে নিকারাগুয়া এরপর জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে প্রশ্নটি উত্থাপন করেছিল। নিরাপত্তা পরিষদ এই বিষয়ে আন্তর্জাতিক আইন মেনে চলার পরামর্শ দিয়েছিল। কিন্তু এই প্রস্তাবনার বিরুদ্ধে একা ভেটো প্রয়োগ করেছিল আমেরিকা!
এরপর নিকারাগুয়া জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে গিয়েছিল একই অভিযোগ নিয়ে। সাধারণ পরিষদও নিকারাগুয়ার পক্ষে প্রস্তাবনা নিয়েছিল কিন্তু আমেরিকা ও ইজরায়েল পরপর দুই বছর সেই প্রস্তাবনার বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। এল সালভাদরও এদের সাথে যোগ দিয়েছিল একবার। এভাবেই একটি রাষ্ট্রের এগোনো উচিত। নিকারাগুয়া যদি কোনো শক্তিমান দেশ হতো, তাহলে হয়তো নিজেরাই একটি আদালত বসাতে পারতো। আমেরিকাও একই ধরনের ব্যবস্থা নিতে পারতো, কেউ তো আমেরিকাকে বাধা দিতো না। এই অঞ্চলের জনগণ এমনকি আমেরিকার মিত্ররাও বলেছিল এই ধরনের পদ্ধতিতে এগোনোর জন্য।
মনে রাখা দরকার, মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকার সরকারগুলো আলজেরিয়ার সন্ত্রাসবাদী সরকারের মতোই ভয়ংকর এবং সকলেই হয়তো এই সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ার প্রশ্নে সানন্দে রাজি হতো, যারা তাদের ওপরেও হামলা করেছে। তারাই প্রধান টার্গেট ছিল কিন্তু তারা সকলেই এর স্বপক্ষে অন্তত কিছু প্রমাণ চেয়েছিল এবং তারা বলেছিল সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়াটা যেন হয় আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি অন্তত নূন্যতম শ্রদ্ধা রেখে। মিশরের অবস্থানটা ছিল মিশ্র, কেননা তারাই এই সন্ত্রাসবাদের প্রাথমিক উৎসের অংশীদার, বিন লাদেন যার অংশ ছিল। তারাই ছিল এই সন্ত্রাসবাদের প্রথম শিকার যখন আনোয়ার সাদাস খুন হন। এরপর আরো অনেকেই এর শিকার হয়েছে। তারা এই সন্ত্রাসবাদকে ধ্বংস করতে চেয়েছে। তবে তারা কিছু তথ্য-প্রমাণও চেয়েছে, কে বা কারা এর সাথে যুক্ত এবং তাহলে জাতিসংঘের ঘোষণা ও নিরাপত্তা পরিষদের কাঠামো অনুযায়ী তারা ব্যবস্থা নেবেন।
এই ধরনের ব্যবস্থাই নেওয়া উচিত যদি সত্যিই কেউ ভয়ংকর হামলার সম্ভাবনা কমাতে চায়। আরেকটা রাস্তা আছে, প্রচণ্ড সংঘাতমূলক প্রতিক্রিয়া নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়া এবং দরকার হলে এই সংঘাতের পরিমাণ বাড়ানো এবং চক্রাকারে এই সংঘাত দিয়ে প্রতিশোধের ডাক দেওয়া, প্রতিশোধের নেশা ছড়িয়ে দেওয়া। এই ক্রিয়াকলাপগুলো খুবই পরিচিত এবং সাধারণ।
প্রশ্ন : মূলধারার সংবাদমাধ্যমগুলোতে এই ঘটনার কোনো দিক বা প্রেক্ষিতগুলোকে খুব কম গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। আপনার কেন মনে হয়এই দিকগুলোতে বেশি মনোযোগ দেওয়া যেতে পারতো?
চমস্কি : বেশ কিছু মৌলিক প্রশ্ন আছে এখানে :
প্রথমত, ঠিক কয়টি বা কয় ধরনের রাস্তা খোলা ছিল আমাদের সামনে? আর এই পথগুলোর সম্ভাব্য পরিণতি ঠিক কী হতে পারতো? বাস্তবত, এই ঘটনার কোনো আইনসিদ্ধ পন্থার কথা আলোচনাই করা হয়নি। যেমনটা অন্যদের ক্ষেত্রে হয়েছিল; ধরুন, কিছুক্ষণ আগে আমি নিকাগুয়ার উদাহরণ দিলাম (যদিও তারা ব্যর্থ হয়েছে, কিন্তু আমেরিকা যদি একই পথে যেত কেউ তাকে বাধা দিতো না) অথবা যেমনটা ইংল্যান্ড করেছিল আইরিশ রিপাবলিকান আর্মির বোমা হামলার পরে অথবা ধরুন আমেরিকা যে পথ অনুসরণ করেছিল যখন তারা জেনেছিল ওকলাহামা বোমা বিস্ফোরণের ঘটনটার উৎস অভ্যন্তরীণ। এরকম আরো অসংখ্য ঘটনার উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে।
সংবাদমাধ্যমগুলোতে শুরু থেকেই অনেকটা ঢোল বাজিয়ে চরম প্রতিক্রিয়া দেখানো হচ্ছিল। অথচ বাস্তব তথ্যগুলো খুব বেশি সামনে আনা হয়নি। বলা হয়নি এই ধরনের প্রতিক্রিয়া কী ভয়ংকর পরিণতি বয়ে নিয়ে আসবে নিরপরাধ আফগান ভিকটিমদের ওপর, যারা আসলে তালিবানদের অত্যাচারেও ভিকটিম। তাছাড়া এধরনের ভয়ংকার প্রতিক্রিয়া হয়তো বিন লাদেন আর তার চক্রের দীর্ঘদিনের মনোবাসনা পূরণ করতে সহায়তা করবে।
দ্বিতীয় প্রশ্ন হচ্ছে- কেন? এই প্রশ্নটি কদাচিৎ গুরুত্ব সহকারে উত্থাপিত হয়েছে।
এই ধরনের প্রশ্নের মুখোমুখি না হওয়া মানে এধরনের ঘটনা পুনরায় ঘটবার সম্ভাবনাকে উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়িয়ে তোলা। এর ব্যতিক্রমও আছে। যেমন আমি আগে উল্লেখ করেছি, ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল ধনী মুসলিমদের মতামত পর্যালোচনা করছিল, যারা আমেরিকার পক্ষে মানুষ কিন্তু আমেরিকার পররাষ্ট্রনীতির কঠোর সমালোচক, একটু সচেতন এমন যে কারো কাছেই কারণগুলো বেশ পরিষ্কার। মাঠপর্যায়ের অবস্থাও অনেকটা একই রকম তবে আরো বেশি তিক্ত এবং ক্ষোভ সমৃদ্ধ।
বিন লাদেন ও তার চক্র অবশ্য ভিন্ন শ্রেণিতে পড়ে, এবং বাস্তবত এদের নানা কাজকর্মের কারণে গত বিশ বছরে গরিব-মেহনতি ও শোষিত মানুষদের নানা ধরনের ক্ষতি হয়েছে যারা আসলে সন্ত্রাসবাদী চক্রের জন্য কোনো মাথাব্যথা নয়। কিন্তু তারা জনগণের ক্রোধ, ভীতি এবং বেপরোয়াভাবকে কাজে লাগায়। এজন্যই তারা চাইছিল আমেরিকা একটি চরম প্রতিক্রিয়া দেখাক যেখান থেকে তাদের এই ভয়ংকর কাজের জন্য আরো অনেক বেশি জনসমর্থন আদায় করতে পারবে। যদি আমরা এসব ভয়ংকর সংঘাত সমূহের সংখ্যা না বাড়িয়ে উল্টো কমাতে চাই, তাহলে এধরনের বিষয়গুলো অন্তত গণমাধ্যমের প্রথম পাতায় আসা উচিত
তথ্যসূত্র :
১. হার্টফোর্ড কোর্যান্ট পত্রিকার কেভিন ক্যানফিল্ডের সাথে, সেপ্টেম্বরের ২০ তারিখ, ২০০১ সালে এবং ডেভিড বারসামিয়ানের সাথে একই মাসের ২১ তারিখে নোম চমস্কি’র দুটো ভিন্ন সাক্ষাৎকারের ওপর ভিত্তি করে সাক্ষাৎকারটি সংকলন করা হয়েছে।
২. নাইন-ইলেভেন; নোম চমস্কি – চৈতন্য
আপনার মতামত জানানঃ