গত মে মাসে খালাফ আল-রোমাইথি নামের এক ব্যক্তি তার ছেলের স্কুল খুঁজতে তুরস্ক থেকে জর্ডান গিয়েছিলেন৷ কিন্তু সেখানে ডিজিটাল বায়োমেট্রিক শনাক্তকরণ পদ্ধতি ব্যবহার করে তাকে গ্রেপ্তার করে সংযুক্ত আরব আমিরাতে পাঠানো হয়৷ সেখানে এখন তিনি ১৫ বছরের জন্য কারাভোগ করছেন৷
৫৮ বছর বয়সি আল-রোমাইথি তুরস্কের পাসপোর্ট নিয়ে জর্ডান গিয়েছিলেন৷ কিন্তু আম্মান বিমানবন্দরের ডিজিটাল বায়োমেট্রিক শনাক্তকরণ পদ্ধতি তার চোখের আইরিশ শনাক্ত করে তিনি যে সংযুক্ত আরব আমিরাতে কারাদণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তি সেটি চিহ্নিত করে৷
২০১৩ সালে আরব আমিরাতের নেতৃত্বের সমালোচনা করা ৯৪ ব্যক্তির বিচার করা হয়েছিল৷ মানবাধিকার সংস্থাগুলোর অভিযোগ, ঐ বিচার রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ছিল৷
বেসরকারি সংস্থা ‘এমিরেটস ডিটেইনিস অ্যাডভোকেসি সেন্টারের’ পরিচালক হামাদ আল-শামসি আইরিশ স্ক্যান করে আল-রোমাইথির গ্রেপ্তারের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন৷ তবে তার বায়োমেট্রিক তথ্য কীভাবে জর্ডানের কাছে গেল সে ব্যাপারে কেউ নিশ্চিত নয়৷ তবে শামসির ধারণা, আরব আমিরাত এই তথ্য জর্ডানকে দিয়েছিল৷
এ ব্যাপারে জার্মানিতে জর্ডান ও আরব আমিরাতের কাছে জানতে চেয়েছিল ডয়চে ভেলে৷ তবে উত্তর পাওয়া যায়নি৷
মধ্যপ্রাচ্যে ব্যক্তিগত বায়োমেট্রিক তথ্য কীভাবে ব্যবহৃত হতে পারে তার একটি প্রমাণ আল-রোমাইথির গ্রেপ্তার, বলেন যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ডেমোক্রেসি ওয়াচডগ ফ্রিডম হাউসের ইয়ানা গরোখোভস্কাইয়া৷
তিনি বলেন, ‘‘আমরা দমনমূলক সরকারগুলোর মধ্যে ঘনিষ্ঠ সহযোগিতার অংশ হিসেবে বায়োমেট্রিক প্রযুক্তির ক্রমবর্ধমান ব্যবহার নিয়ে খুব উদ্বিগ্ন- যা আমরা মধ্যপ্রাচ্য ও মধ্য এশিয়াতেও দেখেছি৷”
বায়োমেট্রিক পদ্ধতির সক্ষমতা খুব দ্রুত বাড়ছে৷ আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এতে সহায়তা করছে৷ মুখের আকার, কানের পর্দা, নিশ্বাস নেয়ার ধরন, হাঁটা ইত্যাদি পর্যবেক্ষণ করেও এখন মানুষ শনাক্ত করা যাচ্ছে৷ ভবিষ্যতে মানুষ কীভাবে টাইপ করে, কীভাবে নাম সই করে এসব দেখেও শনাক্তকরণ সম্ভব হতে পারে৷
আরেকটি বিষয় হচ্ছে ‘রিমোট বায়োমেট্রিক আইডেন্টিফিকেশন’ বা আরবিআই৷ স্পাই মুভিতে যেমন দেখা যায়, চলন্ত ডিজিটাল ক্যামেরা ব্যবহার করে চোখ, কানের পর্দা ইত্যাদি বিশ্লেষণ করে অনেক মানুষের মধ্যে সম্ভাব্য একজনকে খুঁজে বের করা হচ্ছে৷ এটিই হলো আরবিআই৷
মানবাধিকার কর্মীরা এই আরবিআই নিয়ে বেশি চিন্তিত৷ মধ্যপ্রাচ্যে আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্সের ব্যবহার বিষয়ে ২০২২ সালে ইউরোপিয়ান ইনস্টিটিউট অফ দ্য মেডিটেরানিয়ানের প্রকাশ করা এক গবেষণার লেখকেরা বলেছেন, ‘‘বায়োমেট্রিক শনাক্তকরণ পদ্ধতির ব্যাপক ব্যবহার, দুর্বল গোপনীয়তা আইন এবং দুর্বল আইনের শাসন ও মানবাধিকার সুরক্ষা কর্তৃত্ববাদী অপব্যবহারের দ্বার উন্মুক্ত করে- যার শক্তি এআই-এর কারণে সম্ভবত আরও বাড়বে৷”
বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্যের প্রায় সব দেশ ইমিগ্রেশন প্রক্রিয়ায় বায়োমেট্রিক তথ্য ব্যবহার করছে৷ সাম্প্রতিক সময়ে দুবাই বিমানবন্দরের নিরাপত্তা কর্মীদের অহংকার করতে দেখা গেছে৷ কারণ তারা কানের আকার পরীক্ষা করে একজন প্রতারককে গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয়েছিলেন৷
এছাড়া পুরো শরীর ঢাকা মেয়েদের পোশাক পরা এক পুরুষকে তার হাঁটার ধরণ ও শরীরের মাপ পরীক্ষা করেও ধরতে সক্ষম হন দুবাই বিমানবন্দরের নিরাপত্তাকর্মীরা৷
নাগরিক নিবন্ধনের অংশ হিসেবে কাতার, সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত বায়োমেট্রিক তথ্য সংগ্রহ করেছে৷ আর ইরাক ও ইয়েমেন ভোটার নিবন্ধনের জন্য এসব তথ্য নিয়েছে৷
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসব তথ্য অন্য উদ্দেশ্যেও ব্যবহৃত হতে পারে৷ ব্রাসেলসের ইউরোপিয়ান ডিজিটাল রাইটস নেটওয়ার্কের সিনিয়র পলিসি অ্যাডভাইজার এলা ইয়াকুবোভস্কা বলছেন, ‘‘যে কোনো সরকার একটি শহরের সিসিটিভি ফুটেজের সঙ্গে নাগরিকদের বায়োমেট্রিক তথ্য ব্যবহার করতে দিতে পারে৷ তাহলে আপনি লাইভ দেখতে পারবেন কেউ সাংবাদিকের সঙ্গে দেখা করছে কিনা, কেউ সমকামী বারে যাচ্ছে কিনা, কেউ রাজনৈতিক বিরোধী বা ভিন্নমতাবলম্বীদের সঙ্গে মেলামেশা করছে কিনা- যা খুব বিপজ্জনক হতে পারে৷”
তিনি বলেন, বায়োমেট্রিক তথ্য খুব সংবেদনশীল৷ এটি পাসওয়ার্ডের মতো নয় যে, যখন খুশি তখন পরিবর্তন করা যাবে৷
আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের সামাজিক প্রভাব নিয়ে গবেষণা করা সংস্থা এআই নাউ ইনস্টিটিউটের পরিচালক আমবা কাক আরবিআই (রিমোট বায়োমেট্রিক আইডেন্টিফিকেশন) পদ্ধতির উপর সম্পূর্ণ নিষেধাজ্ঞা চান৷ গোপনীয়তা আইন বা অন্য কোনো আইন এক্ষেত্রে সহায়ক হবে না বলে মনে করেন তিনি৷
এসডব্লিউএসএস/২১০০
আপনার মতামত জানানঃ