তেল সমৃদ্ধ মধ্যপ্রাচ্য তার ভৌগোলিক অবস্থান এবং মূল্যবান খনিজ সম্পদের কারণে বরাবারই বিশ্ব রাজনীতির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট। দীর্ঘদিন ধরে এই অঞ্চলটিতে মার্কিন প্রভাব থাকলেও সম্প্রতি চীনা কূটনীতির গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবও দেখা যাচ্ছে।
সৌদি-ইরান সম্পর্ক এবং আরব লীগে সিরিয়ার পুনরায় সদস্য পাওয়ার মতো গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা খুব সম্প্রতি ঘটেছে। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যে চীনের প্রভাবের বাস্তবতা আসলে কোন জায়গায়? প্রশ্ন থেকে যায়।
মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকা এবং চীনের প্রভাব তুলনা করার মূল অসুবিধা হল দুটি শক্তি সম্পূর্ণ ভিন্ন পরিকল্পনায় চলে। অঞ্চলটিকে পশ্চিমারা মধ্যপ্রাচ্য বললেও চীনের কাছে এটি পরিচিত পশ্চিম এশিয়া নামে।
মূলত লেভান্ত, ইরাক, উপসাগর, তুরস্ক এবং ইরানের মতো গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলকে বুঝাতে এই টার্ম ব্যবহার করে থাকে চীন। ‘লেভান্ত’ শব্দটি মূলত পশ্চিম এশিয়ার পূর্ব ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের একটি বিশাল এলাকাকে বুঝায়।
কিন্তু দীর্ঘ সময় ধরে মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে আমেরিকা যে সামরিক এবং অর্থনৈতিক বলয় তৈরি করে রেখেছে তা কি সহজেই ভাঙ্গতে পারবে চীন? চীনের জাঁকমকপূর্ণ নৌ-নির্মাণ কর্মসূচি সত্ত্বেও উপসাগরীয় অঞ্চলে মার্কিন শক্তিকে এখনো চ্যালেঞ্জ জানানোর মতো সক্ষমতা অর্জন করতে পারেনি বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
এমনকি এই অঞ্চলটিতে চীন যে খুব শিগগিরই এমন কিছু করতে পারবে সেরকম কোনো ইঙ্গিতও পাওয়া যায়নি।
তবে সামরিকভাবে সক্ষমতা দেখা না গেলেও মধ্যপ্রাচ্যে চীনের অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত উপস্থিতি গত কয়েক বছরে চোখে পড়ার মতো অবস্থায় পৌঁছে গেছে। ব্রডব্যান্ড অবকাঠামোর মতো গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে চীনের প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারছে না যুক্তরাষ্ট্র।
মধ্যপ্রাচ্যে চীনের সামরিক উপস্থিতি বেশ কম। জিবুতি নৌ-ঘাঁটিতে দেশটির ২০০ মেরিন রয়েছে শুধু জলদস্যু ঠেকানোর এবং বেসামরিক উদ্ধার অভিযানের জন্য। যদিও সৌদি আরব, ইরান, সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং ওমানকে নিয়ে একটি যৌথ নৌবাহিনী গঠনের পৃষ্ঠপোষকতা করেছে চীন তবে প্রকল্পে কোনো জাহাজ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়নি তারা।
২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত আমেরিকান এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউটের নোট অনুযায়ী, ‘এই অঞ্চলে বর্তমান চীনভিত্তিক ক্ষমতা এবং জোরালো প্রতিশ্রুতি অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক সম্পৃক্ততার স্তরকে সমর্থন করার জন্য পর্যাপ্ত বলে মনে হচ্ছে না। তাই ওয়াশিংটনকে আরও প্রস্তুত হওয়া উচিত।’
সংযুক্ত আরব আমিরাতে একটি চীনা নৌ-ঘাঁটির পরিকল্পনা সম্পর্কে গুজব রয়েছে। তবে তা এখনো পর্যন্ত নিশ্চিত নয়। পেন্টাগনের সবশেষ পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী এই অঞ্চলে চীনের সামরিক অভিযানের সক্ষমতা বাড়ানোর কোনো পূর্বাভাস নেই। বর্তমানে এখানে আমেরিকার ২ লাখ মেরিন রয়েছে আর বিপরীতে চীনের আছে মাত্র ৩০ হাজার। এমনকি ১২ হাজার স্পেশাল ফোর্সের বিপরীতে আমেরিকার ৭০ হাজার স্পেশাল ফোর্স রয়েছে।
২০১৪ সালের আগস্ট মাসে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা অভিযোগ করেছিলেন, পারস্য উপসাগরে চীন একটি ‘ফ্রি রাইডার’ হিসেবে ছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই অঞ্চলে নৌবহরের খরচ বহন করতো যা কাজে লাগিয়ে চীন তার তেল বাণিজ্য সুরক্ষা করতো। কিন্তু চীনের সামরিক ব্যয় নাটকীয়ভাবে এখানে বাড়তে থাকে। মধ্যপ্রাচ্যে চীনের প্রতিশ্রুতি ন্যূনতম থাকলেও চীন এখনো ফ্রি রাইডার হিসেবেই রয়ে গেছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, শিপিং লেন রক্ষার ক্ষেত্রে মার্কিন প্রতিশ্রুতির অবনতি ঘটলে চীন হয়তো পদক্ষেপ নিতে পারে। তবে এটি শুধুই অনুমান। আপাতত চীন তার সামরিক সম্পদের সিংহভাগ উপকূলীয় প্রতিরক্ষায় উৎসর্গ করবে। এর মধ্যে মাঝারি ও দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র, জে-২০ ইন্টারসেপ্টর, স্যাটেলাইট, ইলেকট্রনিক ওয়ারফেয়ার এবং সাবমেরিন অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে।
তবে চীন এখনো এটাই প্রমাণ করে আসছে যে এই অঞ্চলে তার স্বার্থ আমেরিকার সঙ্গে সাংঘর্ষিক নয়। সাংহাই একাডেমি অব সোশ্যাল সায়েন্সের রাষ্ট্রবিজ্ঞানী প্যান গুয়াং ২০২২ সালে ‘অবজারভার’ ওয়েবসাইটকে বলেছিলেন, ‘চীনের অর্থনৈতিক বিনিয়োগ এবং মার্কিন সামরিক বিনিয়োগ কিছু জায়গায় একে অপরের পরিপূরক হতে পারে, যেমন উপসাগরীয় দেশগুলোতে। বিদেশে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বেশ
কয়েকটি বড় সামরিক ঘাঁটি রয়েছে। বৃহত্তম সামরিক ঘাঁটি আছে কাতারে। সৌদি আরবেও দুটি রয়েছে এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতেও রয়েছে। যাইহোক, এই দেশগুলোতে অবকাঠামো নির্মাণ আমেরিকান শ্রমিকদের মাধ্যমে নয়, চীনা শ্রমিকদের মাধ্যমেই ঘটেছে। পাশাপাশি থাইল্যান্ড, ফিলিপাইন, শ্রীলঙ্কা এবং ভারতের মতো দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় এবং দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর শ্রমিকরা কাজ করেছেন।’
এদিকে, ২০২২ সালের শেষের দিকে এবং ২০২৩ সালের প্রথম দিকে সৌদি আরবে চীনের রপ্তানি বার্ষিক হার প্রায় ৪৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছেছে। বিপরীতে, ২০১৪ সালে সৌদি আরবে ইউরোপীয় ইউনিয়নের রপ্তানি সর্বোচ্চ ৪৫ বিলিয়ন ডলার ছিল, কিন্তু ২০২২ সালে তা ৩৩ বিলিয়নে নেমে আসে।
অপরদিকে ২০১৫ সালে মার্কিন রপ্তানি ছিল ১৯ বিলিয়ন ডলার। ২০২২ সালে তা ১১.৫ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসে। এমনকি সৌদি আরবের সৌরবিদ্যুৎ, গণপরিবহন এবং অন্যান্য উচ্চ প্রযুক্তিখাতে শিল্প পণ্যের শীর্ষস্থানীয় সরবরাহকারী হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপকে হটিয়ে জায়গা দখল করেছে চীন। পাশাপাশি ২০১৮ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে ইসরায়েলে চীনের রপ্তানি দ্বিগুণ বেড়েছে। এছাড়াও উল্লেখযোগ্যভাবে তুরস্ক এবং মধ্য এশিয়ায় চীনা রপ্তানি বেড়েছে।
চীনের লক্ষ্যকে দীর্ঘমেয়াদী কৌশল এবং সুবিধাবাদী বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। এই অঞ্চলে দেশটির দীর্ঘমেয়াদী স্বার্থ এবং গুরুত্বের ক্রমানুসারে চারটি ধাপ থাকতে পারে।
প্রথমত—পারস্য উপসাগর থেকে তেলের অবাধ প্রবাহ নিশ্চিত করা। এ ক্ষেত্রে চীন বিশ্বের বৃহত্তম গ্রাহক তাই তারা অবশ্যই স্থিতিশীলতা বৃদ্ধি করবে।
দ্বিতীয়ত—দুর্বল সামুদ্রিক যানবাহনের বিকল্প হিসেবে জ্বালানি এবং অন্যান্য পণ্যের ওভারল্যান্ড পরিবহনের মাধ্যমে বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ তৈরি করা।
তৃতীয়ত—উপসাগরীয় অঞ্চলে চীনা উচ্চ-প্রযুক্তি শিল্পের বাজার প্রসারিত করা।
চতুর্থত—মুসলিম বিশ্বে, বিশেষ করে তুরস্কের সঙ্গে ক্রমবর্ধমান সম্পর্ক বজায় রেখে ঘরে বসে মুসলিম কট্টরপন্থাকে নিয়ন্ত্রণে রাখা এবং উইঘুর নীতি বিষয়ে ভালো বোঝাপড়া তৈরি করা।
এছাড়াও চীনের অন্যান্য ছোট লক্ষ্য রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, ইসরায়েলি প্রযুক্তিতে আরও অ্যাক্সেস। ফিলিস্তিন ইস্যুতে চীনের কোনো কৌশলগত স্বার্থ নেই। ইসরায়েল-ফিলিস্তিন শান্তিতে মধ্যস্থতা করার প্রস্তাবটি একটি কূটনৈতিক চাল মাত্র। প্রস্তাবটি চীনকে বিনাশ্রমে ইসরায়েলের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে এবং ইসরায়েলের সঙ্গে ভবিষ্যতের আলোচনায় দর কষাকষির রাস্তা খোলা রাখতে সহায়তা করবে।
চীন মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকার সামরিক উপস্থিতিকে চ্যালেঞ্জ করছে না বা আমেরিকা বাণিজ্য ও অবকাঠামো বিনিয়োগে চীনের নেতৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করছে না। যদিও চীনের প্রত্যক্ষ সামরিক সম্পৃক্ততা ন্যূনতম পর্যায়ে রয়েছে, তবে এর অর্থনৈতিক প্রভাব এই অঞ্চলে সম্পর্ককে শক্তিশালী করবে। সূত্র: এশিয়া টাইমস।
আপনার মতামত জানানঃ