বাংলাদেশে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আগমনের প্রতিবাদে ব্রাহ্মণবাড়িয়া, চট্টগ্রাম, ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় ব্যাপক সহিংসতা চালায় হেফাজতে ইসলাম। এসময় সহিংসতায় বেশ কয়েকজনের প্রাণহানী ঘটে। ব্যাপক জ্বালাও-পোড়াও ও ভাঙচুর করা হয়। হামলা হয় একাধিক সরকারি প্রতিষ্ঠান ও থানায়। এসব নিয়ে তিতিবিরক্ত দেশবাসীসহ অনেকেই। তাই বিভিন্ন জায়গা থেকে হেফাজতে ইসলাম নিষিদ্ধের দাবি উঠেছে।
হেফাজত নিষিদ্ধের দাবি নিউ ইয়র্ক আওয়ামী লীগের
হেফাজতে ইসলামকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে নিষিদ্ধ করার দাবি উঠেছে যুক্তরাষ্ট্রে নিউ ইয়র্ক মহানগর আওয়ামী লীগের এক সমাবেশ থেকে।
স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী এবং বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে গত ৩০ মার্চ (মঙ্গলবার) অনুষ্ঠিত সমাবেশ থেকে এ দাবি জানান তারা।
আয়োজক সংগঠনের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক সুব্রত তালুকদারের সঞ্চালনায় সভায় সভাপতিত্ব করেন সংগঠনটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি আব্দুল কাদের মিয়া।
বিশেষ অতিথি ছিলেন যুক্তরাষ্ট্র সেক্টর কমান্ডারস ফোরামের সেক্রেটারি বীর মুক্তিযোদ্ধা রেজাউল বারি।
তিনি বলেন, “স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তি উৎসব ঘিরে দেশব্যাপী যে জাগরণ শুরু হয়েছে তার ঢেউ আটলান্টিকের এপারেও বিস্তৃত। এমনি অবস্থায় একাত্তরের পরাজিত শক্তির মদদে হেফাজতে ইসলামের অতীত ও বর্তমান কাণ্ডে এটাই প্রমাণিত হয়েছে যে ওরা আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী চক্রের সঙ্গে জড়িত। তাই অবিলম্বে তাদেরকে নিষিদ্ধ করতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি। অন্যথায় শেখ হাসিনা এবং তার সরকারকে বড় ধরনের সংকটে ঠেলে দিতেও ওরা কসুর করবে না।”
সভাপতির বক্তব্যে কাদের মিয়া বলেন, “বলতে কষ্ট হচ্ছে যে, আওয়ামী লীগের লেবাস লাগিয়ে বিএনপি-জামায়াত-শিবিরের কিছু লোক হেফাজতকে মদদ দিচ্ছে শেখ হাসিনা সরকারের ইমেজ বিনষ্টে। সারাবিশ্বের প্রধান প্রধান মিডিয়া এবং যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্রসহ জাতিসংঘের শীর্ষ কর্মকর্তারা যখন বাংলাদেশের উন্নয়নের ভূয়সী প্রশংসা করছেন, ঠিক তেমনি সময়ে হেফাজতের তাণ্ডবে সবাই হতভম্ব। তাই অবিলম্বে হেফাজতকে নিষিদ্ধ এবং হেফাজতের বর্বরোচিত তাণ্ডবে মদদদাতাদের চিহ্নিত করে বিচার করতে হবে।”
সভায় আরও বক্তব্য দেন মহানগর আওয়ামী লীগের সহ সভাপতি জাফরউল্লাহ এবং মোর্শেদ খান বদরুল, সিনিয়র যুগ্ম সম্পাদক মিনহাজ শরিফ রাসেল, সাংগঠনিক সম্পাদক সমীরুল ইসলাম বাবলু, সাংস্কৃতিক সম্পাদক শাহাবুদ্দিন চৌধুরী লিটন, নির্বাহী সদস্য এটিএম মাসুদ, মাহফুজুর রহমান ও আওয়ামী লীগ নেতা ইলিয়াস খান।
হেফাজত নিষিদ্ধের দাবি একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির
গত ৩১ মার্চ বুধবার এক বিবৃতিতে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির পক্ষ থেকে হেফাজতে ইসলামের সব ধরনের সভা সমাবেশ বন্ধ করা এবং হেফাজত-জামায়াতের মতো ‘স্বাধীনতাবিরোধী জঙ্গি মৌলবাদী সন্ত্রাসী সংগঠন’ নিষিদ্ধ ঘোষণার দাবি জানানো হয়।
একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি তাদের বিবৃবিতে বলেছে, ‘পূর্বাহ্নে ঘোষণা দিয়ে স্বাধীনতাবিরোধী মৌলবাদী সন্ত্রাসী হেফাজতে ইসলাম মুক্তিযুদ্ধের সুবর্ণজয়ন্তীর উৎসব উদযাপন বানচাল করার জন্য সারা দেশে একের পর ধ্বংসাত্মক ঘটনা ঘটিয়েছে। বিশেষভাবে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় তারা যে নারকীয় তাণ্ডব চালিয়ে সুরসম্রাট আলাউদ্দিন সঙ্গীতাঙ্গনে গত শতাব্দীর কিংবদন্তিতুল্য সঙ্গীতগুরু ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর স্মৃতিবিজড়িত নিদর্শনসমূহ ধ্বংস করেছে এবং যে পৈশাচিকতায় বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভেঙেছে তা আমাদের একাত্তরের পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এবং পরবর্তীকালে আল কায়েদা ও আইএস-এর নৃশংস বর্বরতার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছে।
সুনামগঞ্জ থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া পর্যন্ত তারা হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপরও একইভাবে হামলা এবং উপাসনালয় ধ্বংস করেছে। দুর্ভাগ্যের বিষয় হচ্ছে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে হেফাজতের তাণ্ডবে বিএনপি-জামায়াতে ইসলামীর সম্পৃক্ততার কথা গণমাধ্যমে বলা হলেও স্থানীয় প্রশাসন নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করেছে, যা হেফাজতিদের অধিকতর নৃশংসতায় প্ররোচিত করেছে।’
সংবাদপত্রে আসা খবরের বরাত দিয়ে নির্মূল কমিটি বলেছে, ‘গত ৫ দিনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সফরকে অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করে দেশের বিভিন্ন স্থানে সন্ত্রাসী হামলার জন্য ২৫টি মামলায় ১৫ হাজার ব্যক্তিকে আসামি করা হলেও হেফাজতের মাত্র ৩৮ জন স্থানীয় নেতাকর্মীকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। বাকিদের রাজনৈতিক পরিচয় উল্লেখ করা হয়নি। আমরা বহুবার বলেছি, একাত্তরে যারা ধর্মের নামে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছে, তাদেরই রাজনৈতিক ও আদর্শিক উত্তরাধিকারী হচ্ছে হেফাজতে ইসলাম, যারা ঘোষণা দিয়ে বাংলাদেশকে মোল্লা উমরের তালেবানি আফগানিস্তান বানাতে চায়।’
হেফাজত নিষিদ্ধের দাবি বাংলাদেশ আওয়ামী ওলামা লীগের
হেফাজত ও জামায়াতে ইসলামকে নিষিদ্ধের দাবি জনিয়েছে বাংলাদেশ আওয়ামী ওলামা লীগ। সংগঠনটির নেতারা বলেছেন, মোদির বিরোধিতা করতে গিয়ে হরতাল করে, সহিংসতা করে এবং পুলিশের ওপর আঘাত করে জাতীয় সম্পদ নষ্ট করে হেফাজতিরা মুরতাদ হয়েছে। অনতিবিলম্বে হেফাজত-জামায়াতকে নিষিদ্ধ করতে হবে।
আজ শনিবার (০৩ এপ্রিল) সকালে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে বাংলাদেশ আওয়ামী ওলামা লীগ ও সমমনা ১৩ দলের মানববন্ধনে এসব দাবি জানানো হয়।
মানববন্ধনে বক্তব্য দেন- বাংলাদেশ আওয়ামী ওলামা লীগের সভাপতি পীরজাদা মাওলানা মুহম্মদ আখতার হুসাইন বুখারী, সাধারণ সম্পাদক কাজী মাওলানা মুহম্মদ আবুল হাসান শেখ শরীয়তপুরী, সম্মিলিত ইসলামী গবেষণা পরিষদের সভাপতি মাওলানা মুহম্মদ আবদুস ছাত্তার প্রমুখ।
বক্তারা বলেন, মোদির বিরোধিতা করতে গিয়ে হরতাল-সহিংসতা করে এবং পুলিশের উপর আঘাত করে ও জাতীয় সম্পদ নষ্ট করে হেফাজতিরা মুরতাদ হয়েছে। অনতিবিলম্বে হেফাজত ও জামায়াতকে নিষিদ্ধ করতে হবে।
সমাবেশে বক্তারা বলেন, দ্বীন ইসলামের দৃষ্টিতে হরতাল করা হারাম। আর হারামকে হালাল মনে করে করে বা হারাম কাজকে ইসলামি আন্দোলন বলে প্রচার করলে তারা মুরতাদ হয়ে যায়। শরীয়তের দৃষ্টিতে তাই হেফাজতি মাওলানারা সব মুরতাদ হয়ে গেছে। প্রকাশ্যে তওবা না করা পর্যন্ত তাদের পেছনে নামাজ হবে না। তারাবিহ ঈদের নামাজ কোনটাই হবে না। তারা মুসলমান বলে গণ্য হবেন না।
হেফাজতে ইসলামকে নিষিদ্ধের দাবি রাজশাহীর সাংবাদিকদের
হরতালের নামে দেশব্যাপী তাণ্ডব চালানোর কারণে হেফাজতে ইসলামকে নিষিদ্ধের দাবি জানিয়েছেন রাজশাহীর সাংবাদিকরা। পাশাপাশি যারা তাণ্ডব চালিয়েছে, তাদের দ্রুত গ্রেফতারের দাবি জানানো হয়েছে।
হেফাজতে ইসলামের উগ্র কর্মীদের দ্বারা সাংবাদিক নির্যাতন ও লাঞ্ছনার প্রতিবাদে আয়োজিত এক মানববন্ধন কর্মসূচি থেকে এ দাবি জানানো হয়।
আজ শনিবার বেলা ১১টায় মহানগরীর সাহেববাজার জিরোপয়েন্টে কর্মসূচির আয়োজন করে রাজশাহী সাংবাদিক ইউনিয়ন (আরইউজে)।
বক্তারা বলেন, হেফাজত শব্দের অর্থ রক্ষা করা। কিন্তু হেফাজতে ইসলাম ধ্বংসলীলায় মেতে উঠেছে। ইসলাম শান্তির ধর্ম। ইসলামের নামে ধ্বংসলীলা চলতে দেয়া যায় না।
তারা বলেন, একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখে। সংবিধানেও চার মূলনীতি আছে। এর একটি অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ। কিন্তু হেফাজতে ইসলাম সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়াচ্ছে।
বক্তারা আরও বলেন, হেফাজতের উগ্র কর্মীরা সারা দেশে সরকারি স্থাপনায় ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে। গণমাধ্যমকর্মীদের নির্যাতন করেছে। লাঞ্ছিত করেছে। গণমাধ্যমের গাড়িতে অগ্নিসংযোগ করেছে। দেশের স্বাধীনতা এবং সার্বভৌমত্বকে চ্যালেঞ্জ করেছে। তাই অবিলম্বে ধর্মভিত্তিক এই সংগঠনটি নিষিদ্ধ করতে হবে। আর ধ্বংসযজ্ঞে যারা জড়িত তাদের বিচারের আওতায় আনতে হবে।
আরইউজে সভাপতি রফিকুল ইসলাম কর্মসূচিতে সভাপতিত্ব করেন। সাধারণ সম্পাদক তানজিমুল হক মানববন্ধন পরিচালনা করেন।
বিশ্লেষকদের মন্তব্য
বিশ্লেষকরা বলেন, দেশের সবকটা রাজনৈতিক দলই স্বার্থের রাজনীতি করে। ফলে আদর্শের বাইরে গিয়ে তারা স্বার্থোদ্ধারে মরিয়া। হেফাজত ইসলামও তেমনি একটি দল। হেফাজতে ইসলামে ঐক্যমত ও আদর্শের বালাই নেই বলে দলটির নেতৃত্ব নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে বলে জানান তারা।
তারা বলেন, ক্ষমতার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠা দলটি ইতিমধ্যে ধর্মের সংস্পর্শ থেকেও দূরে সরে গেছে। আওয়ামী লীগের সংস্পর্শে কিংবা প্রশ্রয়ে এসে তারাও ক্ষমতার রাজনীতিতে নেমেছে। তাদের এই ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতির কুফল গত কয়েকদিনের ব্যাপক জ্বালাও পোড়াও তাণ্ডব দেখে ধর্মপ্রাণ মুসলমানের মন থেকেও ইতিমধ্যে উঠে গেছে দলটি। মোদীবিরোধী আন্দোলনে নেমে জাতীর জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিভিন্ন প্রতিকৃতিতে আগুন, ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর সংগীতাঙ্গনে ও সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ব্যাপক তাণ্ডবে বিরক্ত ধর্মপ্রাণ দেশবাসী। তারা ধর্মের নামে দেশে এই ব্যাপক অগ্নি নির্যাতন মেনে নিতে পারেনি।
বিশ্লেষকরা বলেন, হেফাজত ইসলাম কেবলি একটি রাজনৈতিক দল। অন্যান্য রাজনৈতিক দলের মত ধর্মকে ব্যবহার করলেও ধর্ম নিয়ে তাদের তেমন কোনো মাথাব্যথা নেই যতটা আছে ক্ষমতার্জন নিয়ে, দেশবাসী ইতিমধ্যে তা উপলব্ধি করেছে। তাই বিভিন্ন জায়গা থেকে হেফাজতে ইসলাম নিষিদ্ধের দাবি উঠেছে।
তারা বলেন, হেফাজতে ইসলাম মূলত দেশকে মধ্যযুগে নিয়ে যেতে চাইছে৷ তারা দেশে প্রগতি এবং আধুনিকতার চাকা থামিয়ে দিতে চাইছে৷ কিন্তু দেশের মানুষ তা মেনে নেবেনা৷
তারা বলেন, এই হেফাজতে ইসলাম জামায়াতকে হেফাজতের পাশাপাশি দেশের সংস্কৃতি, কৃষ্টি, ইতিহাস এবং মুক্তিযোদ্ধার চেতনার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে৷ বাংলাদেশের মানুষ ধর্মপ্রাণ, কিন্তু ধর্মান্ধ নয়, তারা (হেফাজতে ইসলাম) ধর্মকে ব্যহার করে হয়তো সাময়িক উন্মাদনা সৃষ্টি করতে পারবে কিন্তু সফল হবেনা৷ কারণ এই ধর্ম ব্যবসায়ীদের এদেশের মানুষ ভালভাবেই চেনে৷
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/২১৩০
আপনার মতামত জানানঃ