ইসলামি রাজনৈতিক দল ও সংগঠনগুলো জাতীয় নির্বাচনের সময় এলে জোটভিত্তিক কার্যক্রম জোরদার করে। বর্তমানে স্বতন্ত্রভাবে নিজেদের সংগঠন শক্তিশালী করতে ব্যস্ত সময় পার করছে। করোনাভাইরাস রোধে সরকার ঘোষিত বিধিনিষেধ উঠে যাওয়ায় ধীরে ধীরে সক্রিয় হচ্ছে ইসলামি রাজনৈতিক দলগুলো। বিশেষ করে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে সাংগঠনিক শক্তি বাড়ানোর পাশাপাশি প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি সম্পন্ন করছেন নেতারা।
জামায়াতে ইসলামি বাদে বাকি ইসলামি দলগুলো রাজনৈতিক কার্যক্রম চালাতে কোনো বাধার মুখে পড়তে হচ্ছে না। গত কয়েক বছর সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায়ও অনেক ইসলামি দলের কার্যক্রম চলতে দেখা গেছে। ফলে দেশের রাজনীতিতে ইসলামি দলগুলোর অবস্থান দিন দিন পোক্ত হচ্ছে।
তবে নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন চায় অধিকাংশ দল। এ ইস্যুতে পরিবেশ-পরিস্থিতি বুঝে রাজপথের কর্মসূচি দেওয়ার কথাও ভাবছে তারা। একই সঙ্গে চলছে জোট গঠনে নানা তৎপরতা।
জানা যায়, মামলা-হামলার ভয়েই মূলত রাজপথে ইসলামি দলগুলোর তৎপরতা কমে গেছে। তবে তারা দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে। সময়-সুযোগমতো রাজপথেও নামবে। সেই লক্ষ্য সাংগঠনিকভাবেও নিজেদের নতুনভাবে সাজানো হচ্ছে। নীরবে ঘর গোছাচ্ছে তারা। জাতীয় ও রাজনৈতিক ইস্যুতে শিগগিরই প্রকাশ্যে তৎপরতা শুরুর পরিকল্পনা করছেন।
বর্তমানে নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের সংখ্যা ৪০। এর মধ্যে ইসলামি বা ইসলামপন্থি দল ১০টি। নিবন্ধনের বাইরে ইসলামি দল বা সংগঠন কতগুলো তার কোনো পরিসংখ্যান নেই। নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত ইসলামি দলগুলো হচ্ছে— ইসলামি আন্দোলন বাংলাদেশ, ইসলামি ঐক্যজোট, বাংলাদেশ তরিকত ফেডারেশন, খেলাফত মজলিস, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন, বাংলাদেশ ইসলামি ফ্রন্ট, ইসলামিক ফ্রন্ট বাংলাদেশ, জাকের পার্টি ও জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ।
একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামির নিবন্ধন বাতিল করেছে নির্বাচন কমিশন। বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০-দলীয় জোটের সঙ্গে রয়েছে খেলাফত মজলিস ও জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ।
আর আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪-দলীয় জোটে রয়েছে তরিকত ফেডারেশন। ইসলামিক ফ্রন্ট বাংলাদেশ ১৪-দলীয় জোটে না থাকলেও আওয়ামী লীগের সঙ্গে রয়েছে তাদের সুসম্পর্ক। ইসলামি ঐক্যজোট, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস একসময় বিএনপির জোটে ছিল। বর্তমানে তারা স্বতন্ত্র অবস্থানে। বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন, বাংলাদেশ ইসলামি ফ্রন্ট ও জাকের পার্টিও স্বতন্ত্রভাবে সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালনা করছে।
বর্তমানে ইসলামি দলগুলোর মধ্যে সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী ইসলামি আন্দোলন বাংলাদেশ। সংগঠন শক্তিশালীকরণে জোর দিচ্ছেন দলের আমির মুফতি সৈয়দ রেজাউল করিম চরমোনাই পীর। দলীয় সরকারের অধীনে হওয়ায় দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেয়নি তারা। তবে একাদশ সংসদ নির্বাচনে সর্বোচ্চ ২৯৯ আসনে প্রার্থী দেয় দলটি। অনিয়মের অভিযোগে নির্বাচনের দিন ভোট বর্জন করে। বর্তমানে ইসলামি আন্দোলন বিভিন্ন ইস্যুতে মাঠে সরব। জামায়াতে ইসলামির রাজনীতি নিষিদ্ধের জন্য লড়াই করে যাচ্ছে সৈয়দ নজিবুল বশর মাইজভান্ডারীর নেতৃত্বাধীন তরিকত ফেডারেশন ও লায়ন এম এ আউয়ালের নেতৃত্বাধীন ইসলামি গণতান্ত্রিক পার্টি।
বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০-দলীয় জোটের অন্যতম শরিক দল জামায়াতে ইসলামি। শীর্ষ থেকে তৃণমূলের প্রায় সব নেতাকর্মী মামলায় জর্জরিত। দলের সেক্রেটারিসহ শীর্ষ বেশ কয়েকজন নেতা এখনো কারাগারে রয়েছেন। সূত্র জানায়, দলটির কেন্দ্রীয় নেতারা কমবেশি সবাই আত্মগোপনে থাকলেও পিকনিক, মিলাদ মাহফিলের মতো বিভিন্ন সামাজিক কর্মকাণ্ডের আড়ালে রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় রয়েছে জামায়াত।
জামায়াতে ইসলামি বাদে বাকি ইসলামি দলগুলো রাজনৈতিক কার্যক্রম চালাতে কোনো বাধার মুখে পড়তে হচ্ছে না। গত কয়েক বছর সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায়ও অনেক ইসলামি দলের কার্যক্রম চলতে দেখা গেছে। ফলে দেশের রাজনীতিতে ইসলামি দলগুলোর অবস্থান দিন দিন পোক্ত হচ্ছে।
গ্রেপ্তার ও সরকারের নজরদারি এড়াতে এ কৌশলে গোপনে সাংগঠনিক কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে দলটি। এমনকি সম্প্রতি স্থানীয় সরকার নির্বাচনেও কেন্দ্রের সিদ্ধান্তে তৃণমূলের নেতাকর্মীরা অংশ নেয়। সারা দেশে অর্ধশতাধিক ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে তাদের প্রার্থী জয়লাভও করে। আগামী সংসদ নির্বাচন ঘিরে প্রস্তুতি নিচ্ছে দলটি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দলটির ঢাকা মহানগরীর এক নেতা বলেন, সরকার আমাদের মাঠে নামতে দিচ্ছে না। তবে আমরা কৌশলে দলকে শক্তিশালী করছি। সময়মতো রাজপথে নামব।
হেফাজতে ইসলাম ‘অরাজনৈতিক’ সংগঠন হলেও নির্বাচনকে সামনে রেখে তাদের ভূমিকা নিয়ে নানা মহলে আলোচনা চলছে। সংগঠনটি গত বছরের শুরু থেকেই সরকারের চাপে রয়েছে। গ্রেপ্তার হয়ে এখনো কারাগারে আছেন শীর্ষ পর্যায়ের সাবেক ও বর্তমান অনেক নেতা। আগামী নির্বাচনে এ সংগঠনটির ভূমিকা কী হবে, তা এখনো স্পষ্ট নয়। তবে এই মুহূর্তে তারা কেন্দ্রীয় নেতাদের মুক্তির বিষয়টিকেই অগ্রাধিকার দিচ্ছে। জানতে চাইলে হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মাওলানা মীর ইদরিস জাতীয় দৈনিক যুগান্তরকে বলেন, এখন দলের নেতারা যারা কারাগারে আছেন, তাদের মুক্তির বিষয়টি বেশি গুরুত্ব দিচ্ছি।
এছাড়া দলের কমিটিগুলো যেহেতু বিলুপ্তি করা হয়েছে, নতুন করে এসব কমিটি করার জন্য চেষ্টা চলছে। আমরা নির্বাচনমুখী নই। আমাদের দলের সঙ্গে রাজনীতির কোনো সম্পর্ক নেই। সাংগঠনিকভাবে রাজনীতি করার সুযোগ নেই, করবও না। যদিও আমাদের অনেকেই রাজনীতি করেন, তাদের ভিন্ন দল আছে। তারা তাদের দলের সিদ্ধান্ত নেবেন।
খেলাফত মজলিসের আমির অধ্যক্ষ মাওলানা মুহম্মদ ইসহাক বলেন, আমরা স্বাধীন দল। আমরা ক্ষমতাসীন অথবা অন্য দলেরও সহযোগী হব না। তবে বিরোধী দলের পক্ষে আমাদের অবস্থান। আমাদের দাবি নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এটা জনগণও চায়। আমরা জনগণের পক্ষে। এই দাবিতে আমরা আলাপ-আলোচনা করে কর্মসূচি ঠিক করব।
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব গাজী আতাউর রহমান যুগান্তরকে বলেন, মার্চজুড়ে সারা দেশে দাওয়াত ও সদস্য সংগ্রহ কর্মসূচি চলবে। পরে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিসহ আরও কিছু দাবিতে ঢাকায় সমাবেশ করার চিন্তা আছে। জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে আমরা মাঠে আছি, থাকব। বাস্তবতা হচ্ছে-দেশে দলীয় সরকারের অধীনে কখনোই সুষ্ঠু-নিরপেক্ষ নির্বাচন হয়নি। অতএব আমরা শুরু থেকেই বলে আসছি-নির্বাচনকালীন একটি গ্রহণযোগ্য সরকার লাগবে। জাতীয় সরকারের দাবি করছি, যাতে সব নাগরিকের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়, ভোটের পরিবেশ ফিরে আসে, ভোটাধিকার নিশ্চিত হয়। আগামী দিনে এ দাবিতে আমাদের কর্মসূচি থাকবে।
জোট গঠনের বিষয়ে তিনি বলেন, আমরা পরিবেশ-পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছি। সামনে সব ইসলামি শক্তিকে নিয়ে যাতে নির্বাচনে যেতে পারি-এমন চিন্তাও রয়েছে। তবে সেটা কীভাবে, কোন প্রক্রিয়ায় হবে-এ নিয়ে আলাপ-আলোচনা চলছে।
জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য ও কেন্দ্রীয় প্রচার বিভাগের সেক্রেটারি মতিউর রহমান আকন্দ বলেন, আমাদের বক্তব্য পরিষ্কার, নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকার ব্যতীত বাংলাদেশে কোনো নির্বাচনই গ্রহণযোগ্য ও নিরপেক্ষ হয় না। এই সরকার ১২ বছর ধরে তা তাদের আচরণে প্রমাণ করেছে। কাজেই মধ্যরাতের নির্বাচন আর বিনা ভোটের নির্বাচন-এগুলোর হাত থেকে জাতিকে উদ্ধার করতে হবে। এজন্য কেয়ারটেকারের মাধ্যমে নির্বাচন দিতে হবে। এই দাবির পক্ষে জামায়াতে ইসলামী বক্তব্যের মাধ্যমে জাতির দৃষ্টি আকর্ষণ করছে। আগামী দিনে এ ব্যাপারে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় জামায়াত রাজনৈতিক কর্মসূচি দেবে।
ইসলামি দলগুলোর নেতারা আরও জানান, কোনো পরিস্থিতিতেই বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো স্বাধীন ও স্বাভাবিকভাবে কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারছে না। এমন পরিস্থিতিতে ইসলামি রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিকূলতা আরও বেশি। তবে তাদের মতে, বর্তমানে ইসলামি রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য গুরুত্বপূর্ণ হলো জনসম্পৃক্ততা তৈরি করা। জনগণকে ধর্মভিত্তিক দলগুলোর সঙ্গে বেশি বেশি সম্পৃক্ত করা।
তবে ইসলামি দলগুলোর নেতারা সব সময় সুযোগ-সুবিধার রাজনীতিতেই বেশি মনোযোগী বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, মূলত সুযোগ-সুবিধার হিসাব মেলাতে গিয়ে ইসলামি দলগুলোতে অনৈক্য দৃশ্যমান হয়। এক নেতার সুবিধার রাজনীতির পেছনে হাজার হাজার সমর্থককে অকাতরে ভোল পাল্টাতেও সময় লাগে না। ইসলামি দলগুলোর অনৈক্য অবস্থা থেকে ফিরিয়ে আনতে বড় স্কেলে হেফাজতে ইসলাম মাঠে আসে ২০১৩ সালে। আজকের বাস্তবতায় এ দলও অনেক ক্ষেত্রে আদর্শ বাদ দিয়ে ক্ষমতা বা সুবিধার পেছনে হেঁটেছে। সেই হাঁটা কখনো সরকারের পক্ষে আবার কখনো সরকারের বিপক্ষে গেছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, ভবিষ্যতেও ইসলামি দলের নেতারা সুবিধার রাজনীতির ধারাতেই হাঁটতে পারেন।
তারা বলেন, ‘ইসলামি দলগুলো থেকে ধর্মীয় বিষয় ছাড়া তেমন কোনো রাজনৈতিক এজেন্ডা আমরা দেখতে পাই না। সরকারি দল বলেন আর বিরোধী দল বলেন তারা সব সময় সুবিধার রাজনীতির পথেই হেঁটেছে। সামনেও হয়তো তারা তাই করবে।’
আরও বলেন, ‘সারা দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ইসলামি দলগুলোর সমর্থক ভোটারদের বিএনপি বা ডান ধারার পুঁজি হিসেবে ধরা হতো। এটা বেশ কিছু দিন দেখা গেলেও এখন অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। এখন তারা কৌশলী হয়ে ক্ষমতার কাছাকাছি যেতে প্রতিযোগিতা করছে। আর এটার সুযোগও সরকার নিচ্ছে। আগামী নির্বাচনে বিএনপিসহ কিছু দল মাঠে না গেলেও এসব ইসলামপন্থি দলগুলো সামনের নির্বাচনে বড় ফ্যাক্ট হয়ে দেখা দিতে পারে। তবে এখানে একটি কথা বলা যায় যে, দলগুলোর নেতারা যত তাড়াতাড়ি তাদের দিক পরিবর্তন করতে পারেন তাদের সমর্থকরা অতটা পারে না। তাই ইসলামি এসব দলকে কাছে টেনেও খুব বেশি লাভ নেই বড় রাজনৈতিক দলগুলোর।’
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৩৩০
আপনার মতামত জানানঃ