বাংলাদেশের রাজনীতিতে ‘সেফ এক্সিট’ শব্দটি এখন একেবারে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। টেলিভিশন টকশো, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম কিংবা রাজনৈতিক অঙ্গন—সব জায়গায় চলছে এই শব্দটি নিয়ে আলোচনা। কিন্তু অনেকেই জানেন না, এটি কোনো নতুন বিষয় নয়। বাংলাদেশের রাজনীতির ৫৪ বছরের ইতিহাসে অন্তত তিনবার এমন ঘটনা ঘটেছে, যেখানে ক্ষমতাসীন বা প্রভাবশালী কোনো পক্ষকে নিরাপদে প্রস্থান বা ‘সেফ এক্সিট’ নেওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। অর্থাৎ এমন কিছু সময় এসেছে, যখন রাজনৈতিক জটিলতা বা সংঘাতের মুখে অভিযুক্ত বা বিতর্কিত ব্যক্তিদের জবাবদিহিতার বাইরে রেখে, নিরাপদে সরে যাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
‘সেফ এক্সিট’ সাধারণভাবে মানে কোনো বিপজ্জনক পরিস্থিতি থেকে নিরাপদে চলে যাওয়া। কিন্তু রাজনীতির ক্ষেত্রে এর অর্থ অনেক গভীর। এখানে বিষয়টি কেবল শারীরিক নিরাপত্তা নয়, বরং দায়মুক্তি, বিচার থেকে রেহাই পাওয়া এবং রাজনৈতিক পরিসর থেকে চাপমুক্তভাবে সরে যাওয়ার বিষয়কেও বোঝায়। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এই ‘সেফ এক্সিট’ তিনটি সময়ে সবচেয়ে স্পষ্টভাবে দেখা গেছে—১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর, ২০০৭-২০০৮ সালের এক-এগারোর সময়, এবং ২০২৪ সালে শেখ হাসিনার দেশত্যাগের ঘটনায়।
প্রথমবারের মতো সেফ এক্সিটের ঘটনা ঘটে ১৯৭৫ সালের আগস্টে। ওই বছরের ১৫ আগস্ট জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর পরিবারের অধিকাংশ সদস্যকে হত্যা করে সেনাবাহিনীর কিছু সদস্য। দেশের ইতিহাসের সবচেয়ে নৃশংস এই হত্যাকাণ্ডের পর যে ঘটনাটি ঘটে, সেটিই সেফ এক্সিটের প্রথম উদাহরণ হিসেবে ইতিহাসে জায়গা করে নেয়। হত্যাকাণ্ডের পরপরই সামরিক শাসকরা একটি ‘ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ’ জারি করেন, যার মাধ্যমে এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত সেনা কর্মকর্তাদের বিচার থেকে রেহাই দেওয়া হয়। শুধু তাই নয়, তাদের মধ্যে কয়েকজনকে পরবর্তীতে বিদেশে রাষ্ট্রদূত ও কূটনৈতিক পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। অর্থাৎ যাদের বিচারের মুখোমুখি হওয়ার কথা ছিল, তাদের পরিবর্তে রাষ্ট্রই তাদের নিরাপদ আশ্রয় দেয়। এটি ছিল বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রথম ‘সেফ এক্সিট’, যেখানে অপরাধীরা রাষ্ট্রীয় প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই দায়মুক্তি পায়। পরবর্তীতে ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এসে এই ইনডেমনিটি আইন বাতিল করে এবং তখনই শুরু হয় শেখ মুজিবুর রহমান হত্যাকাণ্ডের বিচারপ্রক্রিয়া।
দ্বিতীয় বড় সেফ এক্সিটের ঘটনা ঘটে এক-এগারোর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়, ২০০৭ সালে। সেই সময় রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার মধ্যে সেনাবাহিনীর সহায়তায় একটি অনির্বাচিত সরকার দায়িত্ব নেয়। ফখরুদ্দীন আহমদ ছিলেন প্রধান উপদেষ্টা এবং সেনাপ্রধান ছিলেন মঈন উ আহমেদ। শুরুতে দুর্নীতি দমন, প্রশাসনিক সংস্কার এবং রাজনীতি ‘শুদ্ধ’ করার কথা বলা হলেও, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সরকার নিজেই চাপে পড়ে যায়। দুর্নীতির অভিযোগে তখন শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়াসহ অনেক রাজনীতিবিদকে গ্রেফতার করা হয়। কিন্তু শাসন ব্যবস্থার ওপর নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখা কঠিন হয়ে পড়ে। তখন সরকার এবং সেনা কর্মকর্তারা বুঝতে পারেন, ক্ষমতা ছাড়ার সময় আসছে এবং নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে তারা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদ তাঁর ‘এক-এগারো’ বইতে লিখেছেন, এই সময় এক পর্যায়ে সরকার শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করে নিজেদের জন্য একটি ‘সেফ এক্সিট’ চায়। খালেদা জিয়া সেই সুযোগ দেননি, কিন্তু শেখ হাসিনা নরম অবস্থান নেন। তাঁর মধ্যস্থতায় সেনা কর্তাদের জন্য নিরাপদে ক্ষমতা ছাড়ার পথ তৈরি হয়। ২০০৮ সালের শেষের দিকে সেনাবাহিনীর উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তারা ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কয়েকজন সদস্য শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠকে বসেন এবং সেখানে সেফ এক্সিটের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়। সেনাপ্রধান মঈন উ আহমেদ তখন নিউইয়র্কে ছিলেন এবং ফোনে যুক্ত হন আলোচনায়। সেই বৈঠকের ফলেই নির্ধারিত হয় যে, নতুন নির্বাচনের পর এই সরকার শান্তিপূর্ণভাবে দায়িত্ব হস্তান্তর করবে এবং তাদের কেউই জবাবদিহির মুখে পড়বে না। পরবর্তীতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে, আর ফখরুদ্দীন আহমদ ও মঈন উ আহমেদ দেশত্যাগ করেন। এই ঘটনাকে বাংলাদেশের দ্বিতীয় ‘সেফ এক্সিট’ হিসেবে ধরা হয়।
সবশেষ সেফ এক্সিটের ঘটনা ঘটে ২০২৪ সালের ৫ আগস্টে। দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতায় থাকা শেখ হাসিনার সরকার গণঅভ্যুত্থানের মুখে পড়ে। আন্দোলনকারীদের ওপর গুলি চালানোর নির্দেশের অভিযোগ ওঠে তাঁর বিরুদ্ধে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পরিস্থিতি এমনভাবে মোড় নেয় যে তাঁকে ক্ষমতা ছাড়তে হয়। বিশ্লেষকদের মতে, সেই সময় তাঁকে পালিয়ে যাওয়ার একটি সুযোগ করে দেওয়া হয়, যা মূলত ছিল একটি ‘সেফ এক্সিট’। রাজনীতিবিদ মহিউদ্দিন আহমদের ভাষায়, “তিনি তো প্রাণে বাঁচলেন, সেই অর্থে এটা সেফ এক্সিট। তিনি গোপনে পালাননি; বরং সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে সামরিক বিমানে তাঁকে ভারতে পৌঁছে দেওয়া হয়।” অর্থাৎ, রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার মাধ্যমেই তাঁর নিরাপদ প্রস্থান নিশ্চিত করা হয়েছিল।
এছাড়াও ২০০৮ সালে তারেক রহমানের দেশত্যাগের ঘটনাও অনেকের কাছে সেফ এক্সিট হিসেবে ধরা হয়। দুর্নীতির মামলায় জড়িয়ে পড়ে তিনি চিকিৎসার অজুহাতে বিদেশে যান। বলা হয়, তাঁর বিদেশে যাওয়ার অনুমতি একটি সমঝোতার ভিত্তিতেই হয়েছিল, যেখানে শর্ত ছিল যে তিনি আর রাজনীতিতে ফিরবেন না। যদিও পরবর্তীতে তিনি রাজনীতিতে সক্রিয় হন, তবু অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, সেটি ‘আংশিক সেফ এক্সিট’-এর উদাহরণ।
কেন এমন সেফ এক্সিট দেওয়া হয়, তা নিয়েও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা নানা মত দিয়েছেন। সাধারণত যখন কোনো রাষ্ট্র বা শাসনব্যবস্থা সংকটে পড়ে, তখন সংঘাত বা রক্তপাত এড়াতে একটি সমঝোতার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করা হয়। এতে করে যারা ক্ষমতায় থাকে, তারা নিরাপদে সরে যায়, আর যারা নতুন করে ক্ষমতা নেয়, তারা দ্রুত স্থিতিশীলতা ফেরাতে চায়। এক অর্থে এটি ‘উভয় পক্ষের মুনাফা’ বা ‘কম ক্ষতির বিনিময়ে সমাধান’-এর পথ।
মহিউদ্দিন আহমদ এই প্রসঙ্গে বলেন, “চলে গেলে সেও নিরাপদ থাকলো, আমরাও ঝামেলামুক্ত থাকলাম। ব্যাপারটা এমন যে একজন দুর্বৃত্ত পালালেন, কিন্তু তাকে পালাতে সাহায্য করা হলো। যারা সাহায্য করলেন, তারাও একই গোয়ালের গরু।” তাঁর এই মন্তব্যই বোঝায়, সেফ এক্সিট কেবল একজন ব্যক্তির নয়, বরং পুরো একটি ব্যবস্থার নিরাপদে নিজের দায় এড়ানোর কৌশল।
বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রতিবারই সেফ এক্সিট এসেছে এক ধরনের রাজনৈতিক অচলাবস্থা বা উত্তপ্ত পরিস্থিতির মধ্যে। কখনো এটি এসেছে রক্তাক্ত ঘটনার পর, কখনো আবার এসেছে রাজনৈতিক সমঝোতার আড়ালে। তবে এর প্রতিটি উদাহরণই রাষ্ট্র, রাজনীতি ও বিচারব্যবস্থার দায়মুক্তির এক বিশেষ অধ্যায় হিসেবে ইতিহাসে থেকে গেছে। সেফ এক্সিট হয়তো সাময়িকভাবে শান্তি আনে, কিন্তু এটি গণতন্ত্র ও জবাবদিহির ধারণাকে দুর্বল করে দেয়। কারণ যখন কেউ জবাবদিহি ছাড়াই ক্ষমতা ছাড়তে পারে, তখন ভবিষ্যতের শাসকরাও জানে—অপরাধের শেষ আশ্রয় হয়তো ‘সেফ এক্সিট’-ই।
আপনার মতামত জানানঃ