বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে আওয়ামী লীগের অবস্থান সবসময়ই অনন্য। স্বাধীনতার নেতৃত্বদানকারী এই দল শুধু রাজনৈতিক শক্তি নয়, বরং দেশের ইতিহাস, সংস্কৃতি ও পরিচয়ের সঙ্গেও অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে আছে। অথচ নির্বাচন কমিশনের সর্বশেষ ঘোষণার ফলে এই দলটির ভবিষ্যৎ নিয়ে বড় প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। কমিশনের ভাষ্য অনুযায়ী, কোনো দলের কার্যক্রম স্থগিত থাকলে তাদের নিবন্ধন এবং প্রতীকও স্থগিত থাকবে। অর্থাৎ আওয়ামী লীগের স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার না হলে তারা দলীয় প্রতীক ‘নৌকা’ নিয়ে নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে না।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রতীকের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সাধারণ ভোটারদের কাছে প্রার্থীর নামের চেয়ে প্রতীক বেশি পরিচিত। বিশেষ করে গ্রামীণ অঞ্চলে ‘নৌকা’ প্রতীক মানেই আওয়ামী লীগ। এই প্রতীক ছাড়া নির্বাচনে দাঁড়ালে প্রার্থীকে চেনাতে হিমশিম খেতে হবে। ভোটারদের মধ্যে বিভ্রান্তি দেখা দেবে এবং প্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলো সেই সুযোগ কাজে লাগাতে পারবে। ফলে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী শক্তি মারাত্মকভাবে দুর্বল হয়ে পড়বে।
তবে কমিশনের বক্তব্যে একটি সুযোগ রাখা হয়েছে—স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে দাঁড়ানোর। আওয়ামী লীগের নেতারা চাইলে আলাদাভাবে প্রার্থী হতে পারবেন। কিন্তু দলীয়ভাবে নয়। এতে যে সমস্যা দেখা দেবে তা হলো অভ্যন্তরীণ বিভাজন। একই আসনে একাধিক আওয়ামী লীগপন্থী প্রার্থী দাঁড়ালে ভোট বিভক্ত হবে। এতে দলের ঐক্য নষ্ট হওয়ার পাশাপাশি সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের সম্ভাবনা প্রায় শূন্যে নেমে আসবে।
বাংলাদেশের ইতিহাসে বড় দল নির্বাচনের বাইরে থাকার নজির আছে। ১৯৮৬ সালের নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেয়নি, তারা বর্জনের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারির নির্বাচনেও আওয়ামী লীগ অংশ নেয়নি। উভয় ক্ষেত্রেই দেখা গেছে, বড় দলকে বাদ দিয়ে নির্বাচনের বৈধতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে এবং পরবর্তী সময়ে রাজনৈতিক অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। তবে এবারকার ঘটনা ভিন্ন। এখানে আওয়ামী লীগ স্বেচ্ছায় নয়, বরং প্রাতিষ্ঠানিক কারণে প্রতীক হারাচ্ছে। এটি হবে দেশের ইতিহাসে এক নজিরবিহীন অধ্যায়।
আওয়ামী লীগের ভবিষ্যৎ এ অবস্থায় অনিশ্চিত হয়ে পড়বে। প্রতীক ছাড়া জয়ী হলেও প্রার্থীরা ব্যক্তিগতভাবে সাংসদ হিসেবে আসবেন, দলীয় সাংসদ হিসেবে নয়। সংসদে আওয়ামী লীগের প্রভাব ক্ষীণ হয়ে যাবে। তাদের ঐতিহ্যবাহী শক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
রাজনৈতিকভাবে এর গভীর প্রভাব রয়েছে। আওয়ামী লীগ বহুদিন ধরে ক্ষমতায় রয়েছে। তাদের শিকড় গ্রাম পর্যন্ত বিস্তৃত। প্রতীক হারালে সেই শিকড় দুর্বল হয়ে পড়বে। স্থানীয় পর্যায়ের নেতারা জনগণকে বোঝাতে ব্যর্থ হতে পারেন যে তারা আওয়ামী লীগের প্রতিনিধি। এর ফলে বিএনপি, জামায়াত কিংবা নতুন উদীয়মান রাজনৈতিক শক্তিগুলো সুবিধা পেয়ে যাবে।
আওয়ামী লীগের ইতিহাসে নানা সময়ে দমন-পীড়নের নজির আছে। পাকিস্তান আমলে শেখ মুজিবকে আটক করা হয়েছিল, দলের কার্যক্রম সংকুচিত করা হয়েছিল। ২০০৭ সালের সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ও আওয়ামী লীগ ও বিএনপিকে রাজনৈতিক অঙ্গন থেকে দূরে রাখার চেষ্টা হয়েছিল। কিন্তু প্রতীক কেড়ে নেওয়ার মতো পরিস্থিতি আগে কখনো হয়নি।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও এ ঘটনায় নড়েচড়ে বসবে। যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন বা জাতিসংঘ সবসময় বাংলাদেশের নির্বাচনের সুষ্ঠুতা নিয়ে কথা বলে। সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দল যদি প্রতীক ছাড়া নির্বাচনের বাইরে চলে যায়, তাহলে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সেই নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হবে না। এতে কূটনৈতিক চাপ বাড়বে, অর্থনৈতিক প্রভাবও পড়বে।
আওয়ামী লীগের সামনে এখন দুটি পথ খোলা। তারা প্রতীক ছাড়াই সংগঠন ধরে রেখে জনগণের সঙ্গে সম্পর্ক অক্ষুণ্ণ রাখতে পারে। এতে সময় লাগলেও তারা আবার ঘুরে দাঁড়াতে সক্ষম হবে। অন্যদিকে, যদি দলীয় ভাঙন তৈরি হয়, নেতারা স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে একে অপরের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠেন, তাহলে আওয়ামী লীগ তার শক্ত রাজনৈতিক ভিত্তি হারাতে পারে।
ইতিহাসে দেখা গেছে, দমন-পীড়ন কোনো দলকে পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন করতে পারেনি। পাকিস্তান আওয়ামী লীগকে দমন করতে গিয়ে নিজেই ভেঙে পড়েছিল। বিএনপি ২০১৪ সালের নির্বাচন বর্জন করে বড় ক্ষতির মুখে পড়েছিল। আওয়ামী লীগের ক্ষেত্রেও একই বাস্তবতা প্রযোজ্য। নির্বাচনের মতো গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া থেকে বাইরে থাকলে দীর্ঘমেয়াদে কোনো দলই টিকে থাকতে পারে না।
অতএব, আওয়ামী লীগ যদি এই নির্বাচনে অংশ নিতে না পারে বা প্রতীক হারায়, তা শুধু দলের জন্য নয়, বাংলাদেশের গণতন্ত্রের জন্যও বড় সংকট বয়ে আনবে। একদিকে আওয়ামী লীগ তাদের ঐতিহাসিক শক্তি ও প্রতীক হারাবে, অন্যদিকে নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন উঠবে। জনগণকে বাদ দিয়ে কিংবা বড় দলকে বাইরে রেখে কোনো নির্বাচন কখনোই দীর্ঘস্থায়ী বৈধতা পায়নি। এ কারণেই বলা যায়, আওয়ামী লীগের এই পরিণতি যদি সত্যিই ঘটে, তাহলে তা দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে গভীর অস্থিরতা সৃষ্টি করবে এবং গণতান্ত্রিক কাঠামোর জন্য ভয়াবহ সংকেত হয়ে দাঁড়াবে।
আপনার মতামত জানানঃ