ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল ভূগোলগতভাবে দেশটির সবচেয়ে বিচ্ছিন্ন ও ঝুঁকিপূর্ণ অংশগুলোর একটি। এই অঞ্চলকে মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে যুক্ত করে রেখেছে মাত্র ২২ কিলোমিটার প্রস্থের একটি সংকীর্ণ করিডোর, যা ‘চিকেনস নেক’ নামে পরিচিত। নেপাল, ভুটান এবং বাংলাদেশের মাঝখানে থাকা এই করিডর শুধু একটি ট্রানজিট পয়েন্ট নয়, বরং প্রায় সাড়ে চার কোটি মানুষ ও সামরিক রসদের প্রধান লাইফলাইন। এই করিডরকে ঘিরে ভারতের উদ্বেগ দীর্ঘদিনের, তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তা কৌশলগত অগ্রাধিকারের পর্যায়ে পৌঁছেছে। বিশেষ করে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পরিবর্তন এবং চীনের আঞ্চলিক সক্রিয়তা এই উদ্বেগকে আরও তীব্র করেছে।
এই প্রেক্ষাপটে দিল্লি ২০৩০ সালের মধ্যে উত্তর-পূর্ব ভারতের আটটি রাজ্যকে রেলপথে ভারতের বাকি অংশের সঙ্গে সংযুক্ত করার উচ্চাভিলাষী লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে। এই পরিকল্পনার উদ্দেশ্য কেবল যোগাযোগ ব্যবস্থা জোরদার করা নয়, বরং চিকেনস নেকের উপর নির্ভরতা কমিয়ে দেশের ভৌগোলিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করাও এর অন্যতম উদ্দেশ্য। বর্তমানে আসাম, ত্রিপুরা, অরুণাচল প্রদেশ এবং মিজোরাম রেলপথে যুক্ত হলেও বাকিদের যুক্ত করতে বিপুল অবকাঠামো উন্নয়ন চালাচ্ছে ভারত সরকার।
সম্প্রতি মিজোরামে ৫২ কিলোমিটার দীর্ঘ বৈরাবি-সাইরাং রেলপথের নির্মাণ কাজ শেষ হয়েছে, যেটি ৮ হাজার কোটি রুপি ব্যয়ে গড়া একটি প্রকল্প। এতে রয়েছে ৪৮টি টানেল, ১৪২টি ছোট-বড় সেতু, ওভারব্রিজ, আন্ডারব্রিজসহ নানা স্থাপনা। এই রেলপথটি আইজল শহরকে ভারতের বৃহৎ রেল নেটওয়ার্কের সঙ্গে যুক্ত করেছে। এর ফলে মিজোরামের অর্থনৈতিক ও পর্যটন সম্ভাবনা নতুন মাত্রা পাবে।
নাগাল্যান্ডে ৮২.৫০ কিমি দীর্ঘ ডিমাপুর-কোহিমা রেলপথ তৈরির কাজ দ্রুত এগোচ্ছে। এতে আটটি নতুন স্টেশন এবং ২০টি টানেলের পাশাপাশি শতাধিক সেতু নির্মাণ করা হচ্ছে। এর একটি অংশ ইতিমধ্যেই চালু হয়েছে, এবং শোখুভি হয়ে অরুণাচল ও মেঘালয় পর্যন্ত ট্রেন চলাচল শুরু হয়েছে।
মণিপুরে পরিস্থিতি আরও চ্যালেঞ্জিং। ১১১ কিমি দীর্ঘ জিরিবাম-ইম্ফল রেলপথ নির্মাণাধীন, যেখানে বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু রেলওয়ে পিয়ার সেতু নির্মাণ করা হচ্ছে। এই প্রকল্পে ৬০ কিমিরও বেশি টানেল এবং শতাধিক সেতুর কাজ চলছে। এতে থাকবে ১০ কিমি দীর্ঘ সাঙ্গাইহেল টানেল, যা উত্তর-পূর্ব ভারতের দীর্ঘতম রেলওয়ে টানেল হবে।
পাশাপাশি, পশ্চিমবঙ্গের সিভোক থেকে সিকিমের রাংপো পর্যন্ত একটি গুরুত্বপূর্ণ রেলপথ নির্মাণ কাজ চলছে, যা ২০২৭ সালের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা। এই প্রকল্পের মাধ্যমে সিকিমের রাজধানী গ্যাংটক ভারতের মূল রেল নেটওয়ার্কে যুক্ত হবে।
তবে মেঘালয়ে এখনো বড় অগ্রগতি হয়নি। স্থানীয় জনগোষ্ঠীর মধ্যে বহিরাগত আগমনের আশঙ্কা রয়েছে, যা রেল প্রকল্পে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে। মুখ্যমন্ত্রী কনরাড সাংমা জানিয়েছেন, রাজ্য সরকার বিকল্প স্থান খুঁজছে যেখানে জনমতের সঙ্গে সমন্বয় রেখে রেল প্রকল্প এগিয়ে নেওয়া যাবে।
ভারতের এই কৌশলগত পরিকল্পনা শুধু একটি রেল সম্প্রসারণ প্রকল্প নয়, বরং এটি দেশটির নিরাপত্তা, অর্থনীতি এবং আঞ্চলিক প্রভাব বিস্তারের একটি বড় পদক্ষেপ। চিকেনস নেক একটি সংকীর্ণ করিডর, যেটির উপর একমাত্র নির্ভরতা ভারতের জন্য সামরিক ও বাণিজ্যিকভাবে বিপজ্জনক হতে পারে। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কের টানাপোড়েন এবং সীমান্তে চীনা তৎপরতা এই করিডরের ঝুঁকি আরও বাড়িয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যদি ভবিষ্যতে রাজনৈতিক বা ভূ-রাজনৈতিক কারণে এই করিডর ব্যবহার অনির্ভরযোগ্য হয়ে পড়ে, তাহলে পুরো উত্তর-পূর্ব ভারত মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে, যা ভারতের নিরাপত্তার জন্য মারাত্মক হুমকি হতে পারে।
তাই বিকল্প পথ তৈরি করে রাখাই এখন ভারতের অগ্রাধিকার। এই রেল প্রকল্পগুলো শুধুই যাতায়াতের ব্যবস্থা নয়, বরং এগুলো নিরাপত্তা, বাণিজ্য, এবং আঞ্চলিক ইন্টিগ্রেশনের প্রতীক। উন্নত রেল যোগাযোগের ফলে উত্তর-পূর্ব ভারতের অর্থনীতি উন্নয়নের নতুন দিগন্তে পা রাখবে, বিশেষ করে মিজোরাম, মণিপুর এবং নাগাল্যান্ডের মতো রাজ্যগুলোতে বাণিজ্য, পর্যটন ও শিল্পায়ন বাড়বে।
ভারতের এই রেল সংযোগ কার্যক্রম একদিকে যেমন দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করছে, অন্যদিকে প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে বৈদেশিক নীতির ক্ষেত্রে আরও কার্যকর কৌশল রচনার সুযোগ সৃষ্টি করছে। বিশেষ করে, বাংলাদেশ ও চীনের দিকে নজর রেখে ভারতের এই ভূ-কৌশলগত বিনিয়োগ দেশটির আঞ্চলিক প্রভাব বজায় রাখারই একটি কৌশলগত প্রচেষ্টা।
চিকেনস নেক নিয়ে ভারতের দীর্ঘদিনের উদ্বেগ অবশেষে তাকে সক্রিয় পদক্ষেপ নিতে বাধ্য করেছে। এই করিডরের উপর নির্ভরতা কমাতে উত্তর-পূর্বাঞ্চলে রেল সম্প্রসারণ শুধুমাত্র অবকাঠামো উন্নয়নের প্রজেক্ট নয়, বরং এটি ভারতের ভূরাজনৈতিক নিরাপত্তার সুরক্ষা বলয় গঠনের অংশ। এই পরিকল্পনাগুলোর সফল বাস্তবায়ন ভারতকে তার অখণ্ডতা ও কৌশলগত সক্ষমতায় এক নতুন উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারে।
আপনার মতামত জানানঃ