আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর ভারতে আশ্রয় নেওয়া শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে ঢাকায় সংগঠিত হয়েছে এক গোপন প্রশিক্ষণ তৎপরতা। বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা জানিয়েছে, নিষিদ্ধ ঘোষিত আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের প্রায় আড়াই হাজার বাছাইকৃত ক্যাডারকে সশস্ত্র ও ভার্চ্যুয়াল লড়াইয়ের জন্য প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। এই প্রশিক্ষণ রাজধানীর ভাটারা, মিরপুর, কাটাবন ও পূর্বাচল এলাকায় অনুষ্ঠিত হয়। বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, এই কার্যক্রম পরিচালনায় যুক্ত ছিলেন সেনাবাহিনীর এক মেজর পদমর্যাদার কর্মকর্তা সাদেকুল হক সাদেক, যিনি বর্তমানে সেনাবাহিনীর হেফাজতে রয়েছেন। তার স্ত্রী সহকারী পুলিশ সুপার সুমাইয়া জাফরিনও এই ষড়যন্ত্রে যুক্ত থাকার অভিযোগে তদন্তের আওতায় আছেন।
গোয়েন্দা তথ্যে উঠে এসেছে, শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়ের প্রত্যক্ষ নির্দেশনা ও কলকাতায় বসে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, পুলিশের সাবেক কর্মকর্তা হাবিবুর রহমান, এবং ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’-এর সহায়তায় এই পুরো নীলনকশার রূপরেখা তৈরি করা হয়েছে। এ ছাড়া দিল্লিতে অবস্থান করা পলাতক অতিরিক্ত আইজিপি মনিরুল ইসলাম ও ডিজিএফআইয়ের সাবেক প্রধান মুজিবুর রহমান কৌশলগত দিকনির্দেশনায় যুক্ত আছেন।
প্রশিক্ষণের জন্য রাজধানীর ভাটারা এলাকায় একটি কনভেনশন সেন্টার ৪০ হাজার টাকায় ভাড়া নেওয়া হয়, যেখানে ৪০০ ক্যাডারকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। অংশগ্রহণকারীদের মিরপুর ডিওএইচএসে একটি মিটিংয়ে টোকেন সরবরাহ করে তাতে অংশ নিতে উৎসাহিত করা হয়। এই প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণকারীদের আগে থেকেই শনাক্ত করে নজরদারিতে রেখেছে গোয়েন্দারা। গ্রেপ্তার করা হয়েছে বরগুনার যুবলীগ নেতা সোহেল রানা, গোপালগঞ্জের আওয়ামী লীগ নেত্রী শামীমা নাসরিন শম্পা ও মেহেরপুরের যুবলীগ আহ্বায়ক মাহফুজুর রহমান রিটনসহ অন্তত ১৬ জনকে। তাদের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের পর উঠে আসে মেজর সাদেক ও তার স্ত্রীর নাম। জানা যায়, তাদের কর্মস্থল কক্সবাজারের রামু ক্যান্টনমেন্টে অনুপস্থিত থাকা অবস্থায় তারা এই ষড়যন্ত্রে সক্রিয় ভূমিকা রাখেন।
পুলিশ জানিয়েছে, এই প্রশিক্ষণে শুধু রাজনৈতিক কর্মী নয়, প্রশাসনিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরাও যুক্ত আছেন। বিশেষত ভাটারার ওই কনভেনশন সেন্টারের সিসিটিভি ক্যামেরা বন্ধ রাখা এবং ভাড়াটে মালিকের সঙ্গে পূর্বপরিকল্পিত যোগাযোগ, এই পুরো ষড়যন্ত্রকে আরও স্পষ্ট করে তোলে। কনভেনশন সেন্টারটির সাবেক মালিক গোপালগঞ্জের বাসিন্দা বায়জিদ ও এর ম্যানেজারকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।
এই পরিস্থিতিতে সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, মেজর সাদেকের বিরুদ্ধে অভিযোগ তদন্তাধীন। তদন্তে দোষী প্রমাণিত হলে সেনাবাহিনীর প্রচলিত আইন অনুযায়ী কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সেনা সদর দপ্তরে আয়োজিত এক ব্রিফিংয়ে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নাজিম-উদ-দৌলা বলেন, সেনাবাহিনী এই বিষয়ে সম্পূর্ণ সতর্ক এবং পেশাদারভাবে তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছে।
অন্যদিকে পুলিশ প্রশাসনও বলছে, রাজধানীতে কোনো ধরনের বিশৃঙ্খলা বা নাশকতা ঠেকাতে তারা সর্বদা প্রস্তুত। ডিএমপির মিডিয়া উইংয়ের উপ-পুলিশ কমিশনার মুহাম্মদ তালেবুর রহমান জানিয়েছেন, এই ষড়যন্ত্রের সঙ্গে জড়িত প্রত্যেককে আইনের আওতায় আনা হবে এবং ঢাকায় কোথাও নাশকতার পরিকল্পনা থাকলে তা কঠোরভাবে প্রতিহত করা হবে।
বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য এই পরিস্থিতি বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেশব্যাপী এই ধরনের প্রশিক্ষণ ও ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে সরকার উৎখাতের যে পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে, তা দেশের নিরাপত্তা ব্যবস্থার প্রতি একটি সরাসরি হুমকি। সেইসাথে এই ঘটনায় সাবেক ও পলাতক নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের সম্পৃক্ততা ইঙ্গিত দেয়, রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা নষ্ট করতে একটি সুপরিকল্পিত, বহুমাত্রিক রাজনৈতিক ও গোয়েন্দা জোট সক্রিয় হয়ে উঠেছে।
এই ধরনের উদ্যোগ কেবল অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি হুমকি নয়, বরং দেশের সার্বভৌমত্ব, সংবিধান ও সাধারণ মানুষের নিরাপত্তার প্রশ্নেও বড় ধরনের উদ্বেগ সৃষ্টি করছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে এখন বড় দায়িত্ব হলো এসব প্রশিক্ষণ, অর্থায়ন ও পরিকল্পনার মূল চক্রটিকে চিহ্নিত করে বিচারের আওতায় আনা, যাতে ভবিষ্যতে কেউ রাষ্ট্রীয় স্থিতিশীলতা নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে না পারে।
আপনার মতামত জানানঃ