ভারত-যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্য সম্পর্ক নিয়ে সাম্প্রতিক টানাপড়েন অনেকগুলো দিক দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের আচমকা ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপের ঘোষণায় নয়াদিল্লি বিস্মিত ও খানিকটা উদ্বিগ্ন হলেও, তাৎক্ষণিক পাল্টা প্রতিক্রিয়ার বদলে কৌশলী ও সংযত প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে। ভারতের কর্মকর্তারা বুঝতে পারছেন, ট্রাম্পের এই পদক্ষেপ হয়তো সম্পূর্ণ অর্থনৈতিক নয়—এতে রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক হিসাবও রয়েছে।
ভারতের তরফ থেকে এখন যুক্তরাষ্ট্রকে খুশি করার পথ হিসেবে আমদানি বাড়ানোর বিষয়টি বিবেচনায় নেওয়া হচ্ছে। প্রাকৃতিক গ্যাস, যোগাযোগ প্রযুক্তি ও সোনা কেনার পরিমাণ বাড়িয়ে বাণিজ্য ঘাটতি কিছুটা কমানোর আশা করা হচ্ছে। কিন্তু প্রতিরক্ষা খাতে, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান কেনার বিষয়ে ভারত স্পষ্টভাবে অনাগ্রহ প্রকাশ করেছে। মোদি সরকার বরং দেশেই প্রতিরক্ষা প্রযুক্তি উৎপাদনের দিকেই বেশি মনোযোগী।
এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের আর্থিক প্রশাসনের শীর্ষ ব্যক্তিরা ভারতের ওপর দায় চাপিয়েছেন, বাণিজ্য আলোচনা ধীরগতির জন্য। অর্থমন্ত্রী স্কট বেসেন্ট ভারতকে ‘ভালো বৈশ্বিক অংশীদার নয়’ বলে অভিহিত করেছেন এবং রাশিয়ার সঙ্গে ভারতের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক নিয়েও অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। ট্রাম্প নিজেও একাধিকবার ভারতের শুল্কনীতি ও বাণিজ্য বাধাকে ‘কঠিন ও বিরক্তিকর’ বলার পাশাপাশি রাশিয়ার কাছ থেকে জ্বালানি ও অস্ত্র কেনায় শাস্তিমূলক ব্যবস্থার ইঙ্গিত দিয়েছেন। যদিও তিনি নিজেই পরে বলেন, ভারত কী করছে, তিনি তা নিয়ে ‘কেয়ার করেন না’ এবং ভারত ও রাশিয়াকে ‘মৃত অর্থনীতি’ বলেও কটাক্ষ করেন।
এই রকম দ্ব্যর্থবোধক মন্তব্য ট্রাম্পের পরিচিত কূটনৈতিক স্টাইলে পড়ে। বিশ্লেষকদের মতে, এই চাপ সৃষ্টির কৌশল ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গেও তিনি প্রয়োগ করেছিলেন। সেবারও প্রথমে উচ্চ শুল্কের হুমকি দিয়ে পরে তা হ্রাস করেন। ভারতীয় বাণিজ্যবিশেষজ্ঞ অভিজিৎ দাস মনে করেন, ট্রাম্পের বক্তব্য কতটা গুরুত্ব দিয়ে দেখা উচিত, সেটা এখনই বলা কঠিন। তবে ভারতকে আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার কৌশলগত প্রয়োজন রয়েছে।
একইসঙ্গে ভারতের রাজনৈতিক নেতৃত্ব নিজেদের কৃষক ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেওয়ার ঘোষণা দিয়ে একটি ভারসাম্য রক্ষার চেষ্টা করছে। বাণিজ্যমন্ত্রী পীযূষ গোয়েল সংসদে বলেছেন, সব পক্ষের মতামত নিয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হবে। এটি দেখায়, ভারত নিজের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বাস্তবতা ও আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক সম্পর্ক—দুই দিকেই ভারসাম্য রাখতে চায়।
অন্যদিকে, শেয়ারবাজার ও মুদ্রাবাজারে এই উত্তেজনার কিছুটা প্রভাব পড়েছে বটে, তবে সেটা বড় ধরনের ধস নয়। রুপি কিছুটা পড়ে গেলেও পরে তা সামলে নেয়, এবং নিফটি ৫০ সূচকেও সীমিত পতন দেখা যায়। এর মানে, বিনিয়োগকারীরা বিষয়টিকে বড় ধরনের সংকট হিসেবে দেখছেন না—এখনও।
দ্বিপাক্ষিক আলোচনার ভবিষ্যৎ এখন অনেকটাই নির্ভর করছে ভারত কতটা নমনীয় হবে তার ওপর। ট্রাম্প প্রশাসন হয়তো ভারতকে আরও প্রতিরক্ষা চুক্তিতে টানতে চাচ্ছে, যাতে আমেরিকান প্রতিরক্ষা খাত লাভবান হয়। কিন্তু ভারত যে সবকিছু যুক্তরাষ্ট্রের ইচ্ছানুসারে করতে রাজি নয়, সেটিও স্পষ্ট করে দিয়েছে।
তবে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক একেবারেই ছিন্ন হয়ে যাবে, এমন নয়। আগামী দিনে ট্রাম্পের প্রশাসন ভারতে প্রতিনিধি দল পাঠাবে, এবং আলোচনা চলবে—এই আশ্বাস রয়েছে। কোয়াড সামিট সামনে থাকায় কৌশলগত সম্পর্কও অব্যাহত থাকবে বলেই ধারণা।
সর্বোপরি, এই পুরো ঘটনার মাধ্যমে আবারও প্রমাণিত হয়, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য শুধু পণ্য বা শুল্কের লেনদেন নয়; বরং এটি একটি জটিল ভূরাজনৈতিক খেলা। এবং সেই খেলায় নেতৃত্বদানকারী দেশগুলো তাদের সামরিক, কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক লক্ষ্য একসূত্রে বেঁধে এগোয়। মোদি সরকার এখন সেই বাস্তবতা মেনেই পথ হাঁটছে—চাপে পড়ে নয়, বরং নিজেদের স্বার্থ বজায় রেখেই কৌশলী অবস্থান নিচ্ছে।
আপনার মতামত জানানঃ