প্রকৃতির নীরব ও রহস্যময় জীব ছত্রাক—যেগুলোকে আমরা সাধারণত পাতার নিচে লুকিয়ে থাকা অথবা গাছের গুঁড়িতে জন্মানো একাকী অঙ্গজ প্রাণী হিসেবে কল্পনা করি—সেই ছত্রাকেরা কি আদৌ কথা বলতে পারে? যদিও ছত্রাকের মুখ নেই, কান নেই, তবুও নতুন এক বৈজ্ঞানিক গবেষণা বলছে, তারা একধরনের সংকেত-ভাষায় নিজেদের মধ্যে বার্তা আদান-প্রদান করে থাকে। আরও বিস্ময়ের বিষয় হলো—এই ভাষাটি মানুষের ভাষার কাঠামোর সঙ্গে অনেকাংশে সাদৃশ্যপূর্ণ।
যুক্তরাজ্যের ওয়েস্ট অব ইংল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অ্যান্ড্রু অ্যাডামাটজকি সম্প্রতি একটি গবেষণায় দাবি করেছেন, কিছু নির্দিষ্ট প্রজাতির ছত্রাক নিজেদের মধ্যে বৈদ্যুতিক সংকেতের মাধ্যমে একধরনের যোগাযোগ বা সংলাপ গড়ে তোলে, যাকে একপ্রকার “ভাষা” বলা যেতে পারে। তার গবেষণায় দেখা যায়, ছত্রাকেরা প্রায় ৫০টি ভিন্ন ভিন্ন ‘শব্দ’ বা সংকেত ব্যবহার করে, যেগুলোর গঠন মানুষের ভাষার মতোই।
এই গবেষণা প্রকাশিত হয়েছে Royal Society Open Science জার্নালে। এখানে অধ্যাপক অ্যাডামাটজকি চার ধরনের ছত্রাক—এনোকি (enoki), স্প্লিট গিল (split gill), ঘোস্ট ফাঙ্গাস (ghost fungus) এবং ক্যাটারপিলার ফাঙ্গাস (caterpillar fungus)—নিয়ে কাজ করেছেন। তিনি প্রতিটি ছত্রাক-আবৃত সাবস্ট্রেটে খুব সূক্ষ্ম ইলেকট্রোড বসিয়ে তাদের বৈদ্যুতিক সংকেত পরিমাপ করেন। এই বৈদ্যুতিক সংকেতগুলো নির্দিষ্ট প্যাটার্নে ‘স্পাইক’ বা ছোট ছোট তরঙ্গের মতো তৈরি হয়।
এই তরঙ্গগুলোর মধ্যে কখনও একটানা ধারাবাহিকতা দেখা যায়, আবার কখনও এগুলো গুচ্ছ গুচ্ছভাবে উপস্থিত হয়। এই ধারাবাহিক ও গুচ্ছযুক্ত সংকেতগুলোকেই অধ্যাপক ‘শব্দ’ হিসেবে ব্যাখ্যা করেছেন। গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতিটি সংকেত গুচ্ছের দৈর্ঘ্য, ছন্দ এবং গঠন মানুষের শব্দের গড় দৈর্ঘ্যের সঙ্গে মিলে যায়।
স্প্লিট গিল ছত্রাক, যেটি দেখতে প্রবালের মতো ঢেউখেলানো এবং পঁচা কাঠে জন্মায়, সেটিই সবচেয়ে জটিল বৈদ্যুতিক প্যাটার্ন তৈরি করে। গবেষকরা বলছেন, এসব জটিল সংকেত হয়তো খাবারের উৎস বা পরিবেশগত বিপদ সম্পর্কে অন্য অংশে বার্তা পাঠাতে সাহায্য করে।
অ্যাডামাটজকি মনে করেন, এই সংকেতগুলো হতে পারে ছত্রাকের একতাবদ্ধতা বজায় রাখার একটি প্রাকৃতিক পদ্ধতি—একটা তুলনা টানা যায় নেকড়ে বাঘের ডাকের সঙ্গে, যেভাবে তারা একে অপরকে চিহ্নিত ও সংযুক্ত রাখে। আবার হতে পারে, এগুলো খাবার, আলো, আর্দ্রতা বা বিষাক্ত উপাদানের উৎস সম্পর্কে সতর্কতা বা সংবাদ পাঠানোর মাধ্যম।
তবে তিনি এটাও বলেছেন, “এটা হতেই পারে যে, ছত্রাক আসলে কিছু বলছে না। হয়তো এটা কেবল তাদের শারীরিক বৈশিষ্ট্যের ফল। কারণ, ছত্রাকের বাড়ন্ত প্রান্তগুলি বৈদ্যুতিকভাবে চার্জ থাকে, এবং সেই চার্জ যখন দুটি ইলেকট্রোডের মাঝ দিয়ে যায়, তখন স্বাভাবিকভাবেই একটি বৈদ্যুতিক স্পাইক তৈরি হয়।”
তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো—এই স্পাইক বা সংকেতগুলো এলোমেলো নয়। এতে রয়েছে ছন্দ, রয়েছে কাঠামো। অনেকেই একে হঠাৎ ঘটা জৈবিক ঘটনা বলে মনে করলেও অধ্যাপক অ্যাডামাটজকি মনে করেন, এতে রয়েছে সুসংবদ্ধতা ও উদ্দেশ্য।
সবারই মত এই নয়। ইউনিভার্সিটি অব এক্সেটারের জীববিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড্যান বেবার, যিনি ব্রিটিশ মাইকোলজিক্যাল সোসাইটির সদস্য, এই ব্যাখ্যাকে একটু বেশি কল্পনাপ্রসূত বলে মনে করেন।
তিনি বলেন, “আমরা আগেও ছত্রাকের মধ্যে ছন্দবদ্ধ পুষ্টি পরিবহণের ঘটনা দেখেছি, যেখানে নির্দিষ্ট সময় পরপর ছত্রাকের ভেতরে খাদ্য উপাদান স্থানান্তর ঘটে। নতুন এই গবেষণায় যে বৈদ্যুতিক সংকেত পাওয়া গেছে, সেগুলোর হার আগের nutrient pulses-এর সঙ্গে মিলে যায়।”
তবে তিনি সাবধান করে বলেন, “এই সংকেতগুলোকে ভাষা হিসেবে ব্যাখ্যা করার আগে আরও বিস্তৃত গবেষণা, পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষার প্রয়োজন। এখনই আমরা গুগল ট্রান্সলেটে ‘Fungus’ ভাষা খুঁজে পেতে যাচ্ছি না!”
ভাষা শুধু শব্দ নয়—তাতে থাকতে হয় অর্থ, প্রসঙ্গ, প্রেরণা এবং প্রতিক্রিয়া। ছত্রাকের এই সংকেতগুলোতে অর্থ বা উদ্দেশ্য আছে কিনা, কিংবা তারা একে অপরের প্রতিক্রিয়ায় কিছু পরিবর্তন ঘটায় কিনা—তা এখনও পরিষ্কার নয়।
তবে যেটা নিশ্চিত, তা হলো—ছত্রাক শুধু আমাদের খাবার বা ওষুধের উৎস নয়, বরং প্রকৃতির জটিল যোগাযোগ ব্যবস্থার এক অংশ। যেভাবে গাছেরা একে অপরের সঙ্গে ‘ওডর’ বা ‘বাষ্প’ এর মাধ্যমে কথা বলে, ঠিক সেভাবেই ছত্রাকেরা হয়তো বৈদ্যুতিক সংকেতের মাধ্যমে একে অপরের সঙ্গে কথোপকথন চালায়।
এই গবেষণা হয়তো আমাদের জীবজগতের অজানা জটিলতা সম্পর্কে নতুন চোখে দেখতে সাহায্য করবে। হয়তো একদিন আমরা সত্যিই জানব—ছত্রাকেরা কী বলছে, কেন বলছে, এবং তারা কীভাবে জ্ঞানের বিস্তার ঘটায়।
আর সেদিন হয়তো ‘Fungus’ ভাষা শুধু গবেষণাগারে নয়, মানুষের কল্পনার বাইরেও জায়গা করে নেবে।
এই গবেষণা যদিও এখনও প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে এবং অনেক প্রশ্নের উত্তর অনিষ্পন্ন, তবুও এটি আমাদেরকে জীবনের অজানা স্তরগুলো সম্পর্কে নতুন কৌতূহল জাগিয়ে তোলে। আমরা যতই এগোচ্ছি, ততই বুঝতে পারছি—জীবন, এমনকি ছত্রাকের জীবনও, হয়তো আমাদের ধারণার চেয়ে অনেক বেশি রহস্যময় ও বুদ্ধিদীপ্ত।
আপনার মতামত জানানঃ