
সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন ব্যাংকের পরিচালক ও শীর্ষ কর্মকর্তাদের অনিয়ম-দুর্নীতির তথ্য নিয়ে আলোচনার মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক সব ব্যাংকের পরিচালক, ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) এবং তার নিচের দুই পদের কর্মকর্তাদের কোথায় কোন ব্যবসা ও আয়ের উৎস আছে, তার তথ্য প্রতিবছর নিজ নিজ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের কাছে জমা দিতে নির্দেশ দিয়েছে। তারা যদি পারিবারিক সূত্রে সম্পদ বা ব্যবসায়ের অংশীদার হন, সে তথ্যও জমা দিতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক গত বৃহস্পতিবার ব্যাংকগুলোকে এ নির্দেশনা দিয়েছে। আর এমন এক সময়ে ব্যাংকগুলোর নিয়ন্ত্রক সংস্থার এই নির্দেশনা এল যখন খোদ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তাদের বিষয়েই তথ্য চেয়েছে আদালত। অর্থ পাচার রোধ ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের তদারক-নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা বিভাগ, আর্থিক প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন বিভাগসহ সংশ্লিষ্ট বিভাগে গত এক যুগে কোন কোন কর্মকর্তা দায়িত্বে ছিলেন, তাদের নাম, পদবী, ঠিকানাসহ বিস্তারিত জানতে চেয়ে একইদিনে ওই আদেশ দিয়েছে হাইকোর্ট। সবমিলিয়ে দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকটি বিব্রতকর এক অবস্থানে রয়েছে।
ব্যাংকের পরিচালক ও শীর্ষ ব্যাংকারদের সম্পদের তালিকা জমা দেয়ার নির্দেশনাটি অনেক পুরনো। ১৯৯১ সালের ব্যাংক কোম্পানি আইনের ১৮ ধারার ২ উপধারায় এ বিষয়টির উল্লেখ রয়েছে। আইনে এ-সংক্রান্ত নির্দেশনা সুস্পষ্ট থাকলেও তা দীর্ঘদিনেও অনুসরণ করা হয়নি। কিছু ব্যাংক এ নির্দেশনা অনুসরণ করলেও তা থেকে বিরত থেকেছে বেশির ভাগ ব্যাংকই। অন্যদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকও তালিকাভুক্ত ব্যাংকগুলো আইন অনুযায়ী পরিচালক ও শীর্ষ ব্যাংকারদের সম্পদের হিসাব রাখছে কিনা, সে বিষয়টিও এতদিন খতিয়ে দেখেনি। এ অবস্থায় প্রথমবারের মতো এ নিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে বাংলাদেশ ব্যাংক
দেশের সব ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও পরিচালনা পর্ষদকে পাঠানো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সার্কুলারে বলা হয়েছে, ব্যাংক কোম্পানি আইনের ১৮ ধারার (২) উপধারা অনুযায়ী ব্যাংক-কোম্পানির প্রত্যেক পরিচালক, ব্যবস্থাপনা পরিচালক বা প্রধান নির্বাহী ও তার নিম্নতর দুই স্তর পর্যন্ত কর্মকর্তার নিজের বাণিজ্যিক, আর্থিক, কৃষি, শিল্প ও অন্যান্য ব্যবসার নাম, ঠিকানা ও অন্য বিবরণ এবং পারিবারিক ব্যবসায়িক স্বার্থসংশ্লিষ্টতার বিবরণ প্রতি বছর লিখিতভাবে পরিচালনা পর্ষদকে জানানোর বাধ্যবাধকতা আছে।
ব্যাংক কোম্পানি আইনের এই বিধান পরিপালনের জন্য এখন থেকে প্রতি পঞ্জিকা বছর শেষে পরবর্তী বছরের ২০ জানুয়ারির মধ্যে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকে ওই বিবরণ দাখিল করতে হবে। তবে, ৩১ ডিসেম্বর, ২০২০ সমাপ্ত বছরের জন্য এ-সংক্রান্ত বিবরণীসমূহ চলতি বছরের ২৮ ফেব্রুয়ারির মধ্যে ব্যাংকে দাখিল করা যাবে। দাখিলকৃত বিবরণীসমূহ পরবর্তী পর্ষদ সভায় উপস্থাপন করতে হবে। ব্যাংক-কোম্পানি কর্তৃক এই বিবরণীসমূহ যথাযথভাবে সংরক্ষণ নিশ্চিত করতে হবে।
অন্যদিকে অর্থ পাচার (মানি লন্ডারিং) প্রতিরোধে বাংলাদেশ ব্যাংক ব্যর্থ কি না তা সংস্থাটির কাছে জানতে চেয়েছে উচ্চ আদালত। একই সঙ্গে ২০০৮ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংকে কর্মরত কর্মকর্তাদের তালিকাসহ তথ্য চেয়েছে হাইকোর্ট। ওই সময় থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের অডিট বিভাগ, ফাইন্যান্সিয়াল ইনস্টিটিউশন, মার্কেট ডিভিশনসহ বিভিন্ন আর্থিক বিভাগে কর্মরতদের তালিকা আগামী ১৫ ফেব্রুয়ারির মধ্যে প্রতিবেদন আকারে দাখিল করতে বলা হয়েছে। বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি মহিউদ্দিন শামীমের ভার্চুয়াল হাইকোর্ট বেঞ্চ গত বৃহস্পতিবার এ আদেশ দেয়।
অর্থপাচার রোধে সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তার ব্যর্থতা আছে কি না, ব্যর্থ হয়ে থাকলে কেন হলেন, অর্থপাচারের বিষয়টি তারা টের পেয়েছিলেন কি না, পেয়ে থাকলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছিলেন কি না, তাদের ইন্ধন বা যোগসাজশে অর্থপাচার হয়েছে কি না, তাও জানাতে নির্দেশ দিয়েছে আদালত।
পরিচালক ও শীর্ষ ব্যাংক কর্মকর্তাদের সম্পদের বিবরণী জমা দেয়ার বাধ্যবাধকতার বিষয়টিকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন সংশ্লিষ্ট বিশ্লেষকরা। তারা মনে করেন, ব্যাংক খাতে সুশাসনের জন্যই পরিচালক ও শীর্ষ ব্যাংকারদের আয়-ব্যয় ও সম্পদের তথ্যে স্বচ্ছতা থাকা দরকার। বাংলাদেশ ব্যাংক এখন নতুন করে নির্দেশনা দেয়ায় বিষয়টি ত্বরান্বিত হবে।
এদিকে ব্যাংকের কর্মকর্তা কর্মচারীদের নাম ঠিকানাসহ হাইকোর্ট তালিকা চাওয়ায় বিব্রতকর অবস্থায় পড়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। দেশের বিভিন্ন ব্যাংকের অনিয়ম আর দুর্নীতি রোধে বাংলাদেশ ব্যাংকের উদ্যোগ গ্রহণের দিনেই একই কারণে বাংলাদেশ ব্যাংক কর্মকর্তাদের তালিকা চেয়ে আদালত নির্দেশ দিলে ব্যাংকটি এক পরীক্ষার সামনে পড়ে যায়। তবে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, বিদেশে অর্থপাচারের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের যোগসাজেশ থাকতে পারে। এক্ষেত্রে অন্যান্য ব্যাংকের সাথে বাংলাদেশ ব্যাংক কর্মকর্তাদের হিসাব আদালতের চাওয়ায় যৌক্তিকতা আছে বলে মনে করেন তারা।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/২০০২
আপনার মতামত জানানঃ