জনতা ব্যাংক থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা লুট হয়ে যাওয়ার খবর আর নতুন কিছু নয়। কিন্তু সাম্প্রতিক অনুসন্ধানে উঠে এসেছে যে এই রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের দুটি শাখা—ঢাকার সাধারণ বীমা ভবন করপোরেট শাখা এবং চট্টগ্রামের আগ্রাবাদ শাখা—ব্যবস্থাপনাগত দুর্বলতা, ক্ষমতার অপব্যবহার এবং পরিকল্পিত জালিয়াতির কারণে প্রায় ৯ হাজার ৪২৮ কোটি টাকার ঋণ কাগজে-কলমে আত্মসাৎ হয়েছে। দুদক এরই মধ্যে পাঁচটি মামলার অনুমোদন দিয়েছে, যেখানে আসামির সংখ্যা ১৬৩ জন। তালিকায় রয়েছে ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান জামালউদ্দিন আহমেদ ও এস এম মাহফুজুর রহমান, সাবেক সিইও ও এমডি মো. আব্দুস সামাদ আজাদ থেকে শুরু করে এস আলম গ্রুপের বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ কর্মকর্তা ও মালিকেরা। এই ঘটনা আর শুধু একটি আর্থিক কেলেঙ্কারি নয়; এটি বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে চলমান কাঠামোগত সংকটের প্রতিচ্ছবি, যেখানে তদারকির ঘাটতি, নৈতিকতার অবক্ষয় এবং প্রভাবশালী গোষ্ঠীর দাপট মিলেমিশে এক গভীর অসুখের সৃষ্টি করেছে।
জনতা ব্যাংক দীর্ঘদিন ধরেই তার বৃহৎ করপোরেট ঋণের ঝুঁকি ব্যবস্থাপনায় সমালোচনার মুখে ছিল। তবে এবার যে তথ্য উঠে এসেছে, তা অনেক বেশি বিস্ময়কর। অনুসন্ধান প্রতিবেদন বলছে, ঋণ অনুমোদনের পর নির্ধারিত শর্তগুলো মানা হয়নি; সহ-জামানত বৃদ্ধি করা হয়নি; অনুমোদনের সীমা অতিক্রম করে ফান্ডেড ও নন-ফান্ডেড ঋণ সৃষ্টির মতো গুরুতর অনিয়ম ঘটেছে; কোথাও কোথাও অঙ্গীকারনামা বা গ্যারান্টিও নেওয়া হয়নি। যেন ব্যাংকের নীতিনির্ধারকরা চোখ বন্ধ করে রেখেছিলেন—অথবা তাদের চোখ বন্ধ রাখার বিনিময়ে কিছু সুবিধা গিয়েছিল অন্য কারও ঝুলিতে। ঋণের তুলনায় খুবই অল্প পরিমাণে এফডিআর জমা রাখা, নিয়মবহির্ভূত আমদানি করা, নির্ধারিত সময়ে ঋণের টাকা পুনরুদ্ধারের কোনো উদ্যোগ না নেওয়া—এসব শুধু নিয়মভঙ্গ নয়, এগুলো একটি উদ্দেশ্যমূলক অর্থনৈতিক অপরাধচক্রের কার্যক্রমের অংশ বলে মনে হয়।
এমন নয় যে এই টাকা একবারে বা একই ধরনের অনিয়মের মাধ্যমে আত্মসাৎ হয়েছে। প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে আলাদা আলাদা প্যাটার্ন দেখা যায়, কিন্তু মূলে আছে একই মানসিকতা—ব্যাংকের সম্পদ মানেই যেন ‘সবার’, আর সে কারণে কেউ যদি প্রভাব খাটিয়ে বা ক্ষমতার আড়ালে থেকে সেই সম্পদ নিজের করে নেয়, তাহলে তাকে থামানোর মতো শক্তিশালী কোনো ব্যবস্থা নেই। উদাহরণ হিসেবে দেখা যায়, এস আলম সুপার এডিবল অয়েল লিমিটেডের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে দায়ের হতে যাওয়া মামলার পরিমাণ ১ হাজার ১৫২ কোটি টাকারও বেশি। আরেকটি মামলায়, এস আলম রিফাইন্ড সুগার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের ক্ষেত্রে আত্মসাৎ হয়েছে ২ হাজার ৩২ কোটি টাকা। অনুরূপভাবে ভেজিটেবল অয়েল, কোল্ড রোল্ড স্টীলস এবং ট্রেডিং কোম্পানি—এস আলম গ্রুপের একাধিক প্রতিষ্ঠানের নামে মোট পাঁচটি মামলার অনুমোদন মিলেছে, যার সবকটির কেন্দ্রবিন্দু একই: ক্ষমতার অপব্যবহার, নিয়ম ভঙ্গ, আর ইচ্ছাকৃত ঋণ জালিয়াতি।
বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত বহু বছর ধরেই অব্যবস্থাপনার শিকার। কিন্তু প্রতিবারই অভিযোগ ওঠে, অনুসন্ধান হয়, মামলা করা হয়, আর তারপর দীর্ঘ নীরবতা। এই নীরবতাই আসলে বড় সমস্যা। কারণ অর্থনৈতিক অপরাধ যদি শাস্তিহীনতার আশ্রয়ে বেড়ে ওঠে, তাহলে তা শুধু ব্যাংকিং খাতকে নয়, পুরো অর্থনীতিকে ঝুঁকিপূর্ণ করে তোলে। জনতার টাকা অর্থাৎ জনগণের টাকা যখন এমনভাবে হাতবদল হয়ে যায়, তখন তা সাধারণ মানুষকে শুধু ক্ষতিগ্রস্তই করে না—বরং রাষ্ট্রের প্রতি তাদের আস্থাও ক্ষুণ্ণ হয়। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের উদ্দেশ্য ছিল উদ্ভাবনী প্রকল্প, কৃষি, শিল্প, ক্ষুদ্র ব্যবসায় সহায়তা প্রদান; কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, বড় অঙ্কের করপোরেট ঋণের ওপরই বেশি ঝুঁকে থাকা আর সেই ঋণের পেছনে রাজনৈতিক প্রভাব, লবিং বা ব্যক্তিগত সম্পর্ক কাজ করা একটা অভ্যাসে পরিণত হয়েছে।
ঋণপ্রহসন যে কতটা গভীরে পৌঁছেছে, তার উদাহরণ মর্টগেজকৃত সম্পত্তির অতিরিক্ত মূল্যায়ন এবং প্রয়োজনের তুলনায় কম সহায়ক জামানত গ্রহণ। ব্যাংকের কর্মকর্তা যখন ঋণগ্রহীতার সঙ্গে যোগসাজশে জামানতের মূল্য বাড়িয়ে দেখান, তখন বাস্তবে সেই মূল্য পুনরুদ্ধার করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। আর কম জামানত নিলে ব্যাংকের ঝুঁকি বহুগুণ বেড়ে যায়। এই দুই প্রক্রিয়া মিলিয়ে ব্যাংকের নিরাপত্তা বেষ্টনী ভেঙে পড়ে। দীর্ঘমেয়াদে দেখা যায়, এসব ঋণ ‘অনাদায়ী ঋণ’ বা খেলাপি ঋণে পরিণত হয় এবং ব্যাংকের ব্যালান্সশিটে বিশাল গর্ত তৈরি করে।
আমাদের আর্থনীতি শুধু সংখ্যার খেলা নয়; এটি মানুষের জীবনের ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলে। একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক যখন হাজার হাজার কোটি টাকা লুটের খাতে চলে যায়, তখন সেই ঘাটতি পুষিয়ে নিতে বিভিন্ন সময়ে সরকারকেই তহবিল ঢালতে হয়। সরকারের এই তহবিল আসে জনগণের করের টাকা থেকে। অন্যদিকে, ব্যাংকের তহবিল সংকটের প্রভাব পড়ে ছোট উদ্যোক্তা, কৃষক, মধ্যবিত্ত ব্যবসায়ীদের ওপর—যাদের সত্যিকার অর্থে ঋণের প্রয়োজন। ফলে একটি চক্র বিশেষ সুবিধা পায়, আর সাধারণ মানুষ বঞ্চিত হয়। অর্থনীতির এই অসম ভারসাম্য দীর্ঘমেয়াদে উন্নয়নের মূল স্রোতকে বাধাগ্রস্ত করে।
দুদকের সাম্প্রতিক পদক্ষেপ নিঃসন্দেহে ইতিবাচক। তবে এটি প্রথম ধাপ। দুদক তদন্ত করবে, মামলা চলবে—কিন্তু যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হবে, তাদের বিচার কীভাবে হবে? আমাদের বিচারব্যবস্থার গতির কথা অনেকেই জানেন। বড় অঙ্কের আর্থিক অপরাধকাণ্ডে আসামিদের বেশিরভাগই দীর্ঘদিন আদালতে নানা কৌশলে মামলা ঝুলিয়ে রাখতে সক্ষম হন। ফলে শাস্তির উদাহরণ খুব কমই তৈরি হয়। অথচ শাস্তির দৃষ্টান্ত তৈরি হওয়া জরুরি, কারণ তাতেই আগামী দিনে কারও পক্ষে একই ধরনের জালিয়াতি করতে সাহস পাওয়া কঠিন হবে। দুর্নীতি দমন কমিশনের কার্যকারিতা অনেকটা নির্ভর করে রাজনৈতিক সদিচ্ছার ওপর। যদি প্রভাবশালী ব্যক্তিরা আইনের বাইরে থেকে যান বা ‘অপ্রকাশ্য চাপে’ তদন্ত বাধাগ্রস্ত হয়, তাহলে এই আত্মসাতের মামলাগুলোর ভবিষ্যৎও অনিশ্চিত হয়ে পড়বে।
এই ঘটনার আরেকটি দিক হলো করপোরেট গভর্ন্যান্স। ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, অডিট বিভাগ এবং নিয়ন্ত্রক সংস্থার মধ্যে সমন্বয়ের অভাব প্রায়ই বড় ধরনের আর্থিক ঝুঁকি তৈরি করে। ঋণ অনুমোদন প্রক্রিয়ার মধ্যে যদি স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা না থাকে, তাহলে ব্যাংকিং ব্যবস্থা দুর্বল হয়ে পড়ে। বিশেষজ্ঞরা দীর্ঘদিন ধরে বলে আসছেন, ব্যাংকের পরিচালন কাঠামোতে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ কমানো, পেশাদারিত্ব বাড়ানো এবং ঋণ ঝুঁকি ব্যবস্থাপনায় আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসরণ জরুরি। কিন্তু বাস্তবে এসব পরামর্শ কতটা কার্যকর হয়েছে, তা এই মামলাগুলোই প্রমাণ করে।
এক সময় বাংলাদেশের অর্থনীতি নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে যে আস্থা ছিল, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তা নড়বড়ে হয়ে গেছে ব্যাংক খাতের সমস্যা, বৈদেশিক মুদ্রার সংকট এবং আর্থিক শৃঙ্খলার অভাবে। জনতা ব্যাংকের এই বিশাল অঙ্কের অনিয়ম শুধু একটি প্রতিষ্ঠানের সমস্যা নয়; এটি পুরো দেশের আর্থিক ব্যবস্থার সংকটের প্রতিফলন। এই সংকট কাটিয়ে উঠতে হলে আইনের শাসন এবং আর্থিক খাতে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। শুধু মামলা নয়—ব্যাংকিং খাতের কাঠামোগত সংস্কার, কঠোর তদারকি, এবং ক্ষমতার অপব্যবহারের বিরুদ্ধে শূন্য সহনশীলতা প্রয়োজন।
শেষ পর্যন্ত, জনগণের অর্থের নিরাপত্তাই রাষ্ট্রের দায়িত্ব। জনতা ব্যাংকের মতো প্রতিষ্ঠানে যখন হাজার হাজার কোটি টাকার আত্মসাতের ঘটনা ঘটে, তখন তা আমাদের সবার জন্য একটি সতর্কসংকেত। এই সংকেত উপেক্ষা করলে অর্থনীতি আরও দুর্বল হবে, ক্ষত আরও গভীর হবে। তাই এখনই প্রয়োজন কঠোর পদক্ষেপ, আইনের যথাযথ প্রয়োগ এবং স্বচ্ছতার পরিবেশ তৈরি করা। কারণ একটি ব্যাংক কেলেঙ্কারের বিচার শুধু অপরাধীদের সাজা নয়—এটি ভবিষ্যতের আর্থিক স্থিতিশীলতার জন্য একটি বার্তা: কারও প্রভাব বা ক্ষমতা জনগণের অর্থ লুট করার লাইসেন্স হতে পারে না, কখনোই নয়।
আপনার মতামত জানানঃ