পাবনায় একটি কাগজ কলের রাসায়নিক বর্জ্যে কয়েকশ একর ফসলের জমি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার অভিযোগ উঠেছে। তিন বছর আগে মিল স্থাপনের পর থেকে পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা না থাকায় স্থায়ী জলাবদ্ধতায় অনাবাদি হয়ে পড়েছে ঈশ্বরদী উপজেলার ১০ গ্রামের কয়েকশ একর ফসলি জমি। জলাবদ্ধতা ও কারখানার দূষিত বর্জ্যের কারণে বিলের বুকজুড়ে এখন কচুরিপানার রাজত্ব। একসময় কৃষাণ-কৃষাণীর কর্মচাঞ্চল্যে দিনভর মুখরিত হয়ে থাকত মুলাডুলির ভদ্রার বিল। শত শত একর জমিজুড়ে ফলত ধান, ইক্ষুসহ বিভিন্ন ফসল। এ ফসল দিয়ে জীবন-জীবিকার নির্বাহ করতেন হাজারো কৃষক পরিবার। সেই বিল এখন নীরব নিস্তব্ধ। তিন বছর ধরে এ বিলের কৃষিজমির ফসলের ওপর নির্ভরশীলদের জীবন নিদারুণ অর্থকষ্ট ও হতাশায় ভরে গেছে। পেপার মিলের অপরিশোধিত রাসায়নিক বর্জ্যে নষ্ট হচ্ছে শত শত একর জমির ফসল। দূর্গন্ধযুক্ত মিলের বর্জ্যের সংষ্পর্শে মরছে পুকুরের মাছ, ছড়িয়ে পড়ছে পানিবাহিত রোগ। ১০টি গ্রামের কয়েক হাজার বাসিন্দা পড়েছেন ভয়াবহ স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে।
রশিদ পেপার মিলের বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ উঠলেও আরও কয়েকটি কারখানা সেখানে ইতিমধ্যে গড়ে উঠেছে। তবে পরিবেশ দূষণের কথা অস্বীকার করেছে রশিদ পেপার মিল কর্তৃপক্ষ।
স্থানীয়রা জানান, ২০১৭ সালে পাবনার মুলাডুলির সরাইকান্দি গ্রামের বিএডিসির পানাসি (পাবনা-নাটোর-সিরাজগঞ্জ) সেচ প্রকল্পের আওতাধীন কৃষি জমি ভরাট করে গড়ে তোলা হয় রশিদ পেপার মিল। গ্রামের পানি নিষ্কাশনের পথ বন্ধ করে কারখানা গড়ে তোল, ফলে তিন বছর আগে রশিদ পেপার মিলে উৎপাদন শুরুর পর রাসায়নিক মিশ্রিত দূষিত বর্জ্য ও অপরিশোধিত পানি চাষের জমিতে পড়া শুরু হয়। দুর্গন্ধযুক্ত এই পানিতে ধানসহ বিভিন্ন ফসল নষ্ট হওয়ার পাশাপাশি ব্যাপকভাবে এলাকায় পরিবেশ দূষণ হচ্ছে।
গ্রামবাসীর অভিযোগ, কৃষিজমিতে শিল্প নির্মাণে সরকারি নিষেধাজ্ঞা থাকলেও তা অমান্য করে গ্রামের পানি নিষ্কাশনের ক্যানেল বন্ধ করে কারখানা গড়ে তোলে মিল কর্তৃপক্ষ। উৎপাদন শুরুর পর রাসায়নিক মিশ্রিত দূষিত বর্জ্য ও অপরিশোধিত পানি চাষীদের জমিতে ফেলায় নষ্ট হচ্ছে ধান, ইক্ষুসহ বিভিন্ন ফসল। দুর্গন্ধযুক্ত পানিতে এলাকায় পরিবেশ দূষণের পাশাপাশি ছড়িয়ে পড়ছে নানা চর্মরোগও। ২০১৯ সালের মার্চে বছরভিত্তিতে অবস্থানগত ছাড়পত্র নেয় মিলটি। এ ছাড়পত্রের মেয়াদ এরই মধ্যে শেষ হলেও তারা তা নবায়নের কোনো আবেদন করেনি। পেপার মিল ছাড়াও আশপাশে আরো বেশ কয়েকটি কারখানা গড়ে উঠেছে। জলাবদ্ধতার কারণে এখানকার কৃষকরা বাধ্য হয়েই শিল্প-কারখানার মালিকদের কাছে স্বল্প মূল্যে জমি বিক্রি করে দিচ্ছেন।
সরইকান্দি গ্রামের কৃষক আমজাদ হোসেন বলেন, রশিদ পেপার মিল নির্মাণের স্থান দিয়েই ভদ্রার বিলের পানি বের হয়ে যাওয়ার প্রধান নালা ছিল। ২০১৭ সাল থেকে পেপার মিল নির্মাণ কাজ শুরু হওয়ার পর এই নালা বন্ধ করে দেয়া হয়। বিলের পানি বের হওয়ার আর বিকল্প পথ না থাকায় বিলের শত শত একর জমি জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। এই বিলের জমিতে বছরে দুইটি ফসলের আবাদ করা যেত। জলাবদ্ধতার কারণে এখানে তিন বছর ধরে কোনো আবাদ হয় না।
দাশুড়িয়া এলাকার আফজাল হোসেন জানান, পেপার মিল ছাড়াও আশপাশে আরো বেশ কয়েকটি কারখানা গড়ে উঠেছে। জলাবদ্ধতার কারণে এখানকার কৃষকরা বাধ্য হয়েই শিল্প কারখানার মালিকদের কাছে স্বল্প মূল্য জমি বিক্রি করে দিচ্ছেন।
মুলাডুলি ইউনিয়নের ৬নং ওয়ার্ড সদস্য আব্দুল আজিজ জানান, ভদ্রার বিল থেকে পানি ক্যানেল হয়ে নদীতে গিয়ে মিশত। বর্ষা মৌসুম ছাড়া অন্য দুটি মৌসুমে গ্রামের চাষীরা বছরে দুটি ফসল পেতেন। কিন্তু রশিদ পেপার মিলসহ কয়েকটি শিল্প প্রতিষ্ঠান নিষ্কাশনের পথ বন্ধ করে স্থাপনা নির্মাণ করেছে। ফলে পানি নির্গমনের পথ বন্ধের কারণে সৃষ্ট স্থায়ী জলাবদ্ধতায় গত তিনবছর ধরে অনাবাদী হয়ে পড়েছে উপজেলার সরাইকান্দি, লক্ষ্মীকোলা, চাঁদপুর, দরগাপাড়া, কারিগরপাড়া, দেবীপুর, বহরপুর, রামচন্দ্রপুর গ্রামের প্রায় ৫০০ একর কৃষিজমি। রাসায়নিক মিশ্রিত দুর্গন্ধযুক্ত পানি পুকুরে মেশায় মারা যাচ্ছে মাছও। তিনি জানান, কর্তৃপক্ষের কাছে ক্ষতিপূরণ ও প্রতিকার চেয়ে উল্টো মিলেছে ভয়-ভীতি ও হুমকি।
তবে নীতিমালা মেনে পরিবেশবান্ধব পদ্ধতিতে উৎপাদন চলছে জানালেও সংবাদকর্মীদের কারখানায় প্রবেশ করতে দেয়নি কর্তৃপক্ষ। সাক্ষাতেও কথা বলেননি রশিদ পেপার মিল মালিক কিংবা তার কোনো প্রতিনিধি। পরে কয়েকদিন টানা চেষ্টার পর প্রতিষ্ঠানটির নির্বাহী পরিচালক জহিরুল হকের সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়।
তিনি দাবি করেন, রশিদ পেপার মিলে জার্মান প্রযুক্তির ইফ্লুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্লান্ট (ইটিপি) ব্যবহার হচ্ছে। মেশিন অ্যাডজাস্ট করতে কিছুটা অসুবিধা হওয়ায় পানি অন্যের জমিতে চলে গেছে। এটি সমাধান হয়ে যাবে। একটি পুকুরের তিন-চারটি মাছ মারা গেছে। এ নিয়ে মাথাব্যথার কিছু নেই বলেও দাবি করেন তিনি।
কৃষিজমিতে শিল্পায়নের ব্যাপারে জহিরুল ইসলাম বলেন, কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগে কারখানা স্থাপন হয়েছে। সরকারি অনুমোদন নিয়ে সব কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে।
পাবনা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক কৃষিবিদ আ. কাদের জানান, বিষয়টি জানার পর জেলা প্রশাসকসহ সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে আলোচনা করে বিধিগত ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।
কৃষিজমি নষ্ট করে শিল্পায়নের সুযোগ নেই বলে জানিয়েছেন পাবনা জেলা প্রশাসক কবীর মাহমুদ। তিনি বলেন, কৃষিপ্রধান এলাকায় ফসলি জমিতে কীভাবে এ শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়েছে, তা খতিয়ে দেখা হবে। সাধারণ কৃষকদের ক্ষতি করে কোনো শিল্পপ্রতিষ্ঠান চলতে পারে না। এ ব্যাপারে প্রশাসনিক পদক্ষেপ নেয়া হবে।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের দাবি, কৃষি জমি নষ্ট হয় এমন জমিতে কারখানা নির্মাণের অনুমতি কিভাবে পরিবেশ অধিদপ্তর ও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর দেয় সেখানে ভাববার অবকাশ রয়েছে। এমন অবৈধভাবে শিল্প কারখানা নির্মাণের ফলে একদিকে যেমন হ্রাস পাচ্ছে আবাদের জমি, অন্যদিকে খাদ্য সংকটে পড়ছে দেশ ও দেশের খাদ্যভাণ্ডার। আবাদি যে জমি ক্ষতিগ্রস্ত হয় তেমন জমিতে কারখানা নির্মাণ করে কিভাবে এতোটি বছর বুক সটান করে এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী নিজেদের অর্থভাণ্ডার বাড়াচ্ছে আর এতে প্রশাসন থেকে শুরু সংশ্লিষ্ট অধিদপ্তরের নীরব ভূমিকা নিয়ে হতাশা প্রকাশ করেন তারা। অতিশীঘ্র কারখানা বন্ধসহ কৃষি জমি চাষাবাদের উপযোগী করে তোলার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তিদের প্রতি আহ্বান জানান তারা। একইসাথে এই তিন বছরে কৃষকেরা যে পরিমাণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তা পূরণের দাবি জানান।
এসডাব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৭৫৫
আপনার মতামত জানানঃ