জলবায়ু পরিবর্তন বৈশ্বিক খাদ্য ব্যবস্থায় বড় ধরনের চাপ ফেলতে যাচ্ছে। দীর্ঘায়িত খরার কারণে এরই মধ্যে ফসলের বপন ও উত্তোলন মৌসুমে বড় ধরনের পরিবর্তন এসেছে। এখন গ্রীষ্মকালীন উত্তাপ দেখা দিচ্ছে সময়ের আগেই। আবার মৌসুমি বৃষ্টিপাত হচ্ছে দেরিতে। ফসলের আবাদ ও কর্তন মৌসুমের ক্ষেত্রেও এ প্রবণতারই বহিঃপ্রকাশ দেখা যাচ্ছে।
‘বাংলাদেশ’স এগ্রিকালচার, ন্যাচারাল রিসোর্সেস অ্যান্ড রুরাল ডেভেলপমেন্ট সেক্টর অ্যাসেসমেন্ট অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজি’ শিরোনামে মার্চে প্রকাশিত ওই প্রতিবেদনের বক্তব্য অনুযায়ী, ২০৫০ সালের মধ্যে শুধু জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণেই জিডিপির ২ শতাংশ হারাবে বাংলাদেশ। এর সঙ্গে সঙ্গে বাড়বে ফসলের রোগবালাই এবং পোকামাকড়ের আক্রমণও। এমনকি মোটামুটি সহনীয় মাত্রার জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষেত্রেও দেশে ধান উৎপাদন কমবে ১৭ শতাংশ। গমের ক্ষেত্রে এ হার ৬১ শতাংশ। এ ফসলহানির প্রধানতম কারণ হবে দীর্ঘায়িত দাবদাহ ও খরা।
ধুঁকছে কৃষিক্ষেত্র
রাজধানী ঢাকায় গতকাল দিনের বেলায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি ছাড়িয়ে যায়। তবে দেশে সর্বোচ্চ উঠেছিল চুয়াডাঙ্গায়—৪২ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এখন পর্যন্ত এটিই এ মৌসুমের সর্বোচ্চ তাপমাত্রার রেকর্ড। অনাবৃষ্টি আর দাবদাহে বিভিন্ন জেলা থেকে পাওয়া যাচ্ছে আম ঝরে যাওয়াসহ ফসল নষ্টের খবর। আবহাওয়া অধিদপ্তরের ভাষ্যমতে, এ তাপপ্রবাহ বজায় থাকতে পারে আরো কিছুদিন।
এরই মধ্যে দেশের ফসল উৎপাদনে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত নানা ক্ষতি দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে। কিছুদিন আগেই দিনে ও রাতের তাপমাত্রায় ব্যাপক পার্থক্য থাকায় বিভিন্ন জেলায় ধানে ব্লাস্ট রোগের সংক্রমণ দেখা দেয়। এতে ফসলের কিছুটা ক্ষতি হয়েছে। আবার বর্তমানে দাপদাহের কারণে ধানের চিটাসহ বিভিন্ন ধরনের ক্ষতি হওয়ার শঙ্কা রয়েছে।
খরার মধ্যে চুয়াডাঙ্গাসহ আক্রান্ত জেলাগুলোর কৃষকরা এখন মারাত্মক বিপাকে পড়েছেন। তীব্র রোদে খেতে কাজ করতে গিয়ে সমস্যা হচ্ছে তাদের। বোরো ধান ও সবজি খেতে প্রতিদিনই সেচ দিতে হচ্ছে। এতে একদিকে কৃষকের সেচব্যয় বেড়েছে, অন্যদিকে চাপ পড়েছে ভূগর্ভস্থ পানির ওপর।
চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার বোয়ালমারী গ্রামের কৃষক মফিজুর রহমান বলেন, ‘ধানে সেচ দিয়ে আর পারছি না। দাম বেশি ডিজেলের। এত দামে ডিজেল কিনতে গিয়ে আর পোষাচ্ছে না। খুবই কষ্টে চাষাবাদ করতে হচ্ছে।’
ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল রিসার্চের ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. আইনুন নিশাত বণিক বার্তাকে বলেন, কৃষি জলবায়ুর ওপর নির্ভর করে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে আবহাওয়া অসহিষ্ণু হবে। বৃষ্টির সময়ে পরিবর্তন হবে। লবণাক্ততা বাড়বে। গত আষাঢ়-শ্রাবণে স্বাভাবিকের তুলনায় অনেক কম বৃষ্টি হয়েছে। আবার ভাদ্র-আশ্বিনে স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি বৃষ্টি হয়েছে।
প্রতিটি ফসলের জন্য একটা নির্ধারিত সময় রয়েছে। এদিক-সেদিক হলে ফলন কমে যাবে বা সমস্যা সৃষ্টি হবে। এ বছর অনেক জায়গায় আমন মৌসুমের ধান দেরিতে রোপণ করা হয়েছে। আমরা সবসময় বলি নভেম্বর-ডিসেম্বরে বোরো ধান লাগাতে। কিন্তু জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে মানুষ ধান লাগাচ্ছে। কাটতে কাটতে জুন হয়ে যাচ্ছে।
এতে প্রাকৃতিক দুর্যোগের মুখোমুখি পড়ার শঙ্কা তৈরি হচ্ছে। ২০৫০ সাল নাগাদ তাপমাত্রা যে হারে বাড়ার শঙ্কা রয়েছে তাতে পরাগায়ন বাধাগ্রস্ত হবে। তখন নানা সমস্যা তৈরি হবে। উপকূলীয় লবণাক্ততা বাড়ছে, তা আরো বাড়বে। হাওর অঞ্চলে বন্যা, দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে বর্ষার শেষদিকে বৃষ্টি বেশি হওয়া, উত্তরবঙ্গে খরা, সার্বিকভাবে তাপমাত্রা বৃদ্ধি ও এর কারণে পোকামাকড়ের আক্রমণ বেড়ে যাওয়া—এসব প্রভাব ধীরে ধীরে দেখা যাবে। এসব সমস্যা ২০-৩০ বছর পর কৃষিতে মারাত্মক হয়ে দেখা দেবে।’
জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সংকটগুলো ফসলের উপকারী পোকামাকড়ের অস্তিত্বকেও এখন হুমকির দিকে ঠেলে দিয়েছে। আবার এ সমস্যাকে আরো প্রকট করে তুলেছে কৃষিতে নির্বিচারে রাসায়নিক ও কীটনাশক প্রয়োগ। বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও সাবেক কৃষি সচিব মো. নাসিরুজ্জামান বলেন, জলবায়ু পরিবর্তন ধীরে ধীরে হচ্ছে। ধান বা অন্যান্য ফসলে আমরা বিষ দিচ্ছি। কিন্তু এগুলোর কারণে উপকারী পোকামাকড়গুলোও মারা যাচ্ছে। যেগুলো আসলে বাড়তি তাপমাত্রার মধ্যে ফসলকে বিভিন্ন সংকট থেকে রক্ষা করে।
সমাধানের পথ কি খোঁজা হচ্ছে?
বাংলাদেশে ভবিষ্যৎ সংকট মোকাবেলায় তাপসহিষ্ণু জাত উদ্ভাবনে গুরুত্ব দেয়া প্রয়োজন বলে মনে করছেন কৃষি খাতসংশ্লিষ্টরা। তাদের ভাষ্যমতে, জলবায়ুসহিষ্ণু জাতগুলো নিয়ে গবেষণার বৈচিত্র্য বাড়াতে হবে। এছাড়া কৃষকদের প্রণোদনার মাত্রা বাড়ানোর মাধ্যমেও জলবায়ুসহিষ্ণু জাত সম্প্রসারণে তাদের আকৃষ্ট করতে হবে।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব রবীন্দ্রশ্রী বড়ুয়া বলেন, দাবদাহের বিষয়টি একেবারেই সাম্প্রতিক। এবার তাপমাত্রা অপ্রত্যাশিতভাবে বেড়েছে। বোরোকে সামনে রেখে আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা করে সেচ নিয়ে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। বোরোয় কোথাও সেচ নিয়ে সমস্যা হয়নি। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সৃষ্ট সংকটে সব দেশই ভুগছে। বাংলাদেশে যা তাপমাত্রা, তার চেয়ে বেশি অনুভূত হচ্ছে, কারণ আর্দ্রতা অনেক কমে গেছে।
গত বছরের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে বন্যার আগেই ধান কাটা শেষ করায় আমরা গুরুত্ব দিয়েছি। এবারও দাবদাহের বিষয়টি আগে থেকেই আমরা গুরুত্বসহকারে দেখছি। এখনো কোনো খারাপ খবর পাইনি। এমন হয়নি যে কোথাও সেচ দেয়া যাচ্ছে না। প্রতি বছরই জলবায়ু পরিবর্তনে সৃষ্ট সংকটগুলো নতুন নতুন সমস্যা হিসেবে সামনে আসছে।
জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় গঠিত ইন্টারগভর্নমেন্টাল প্যানেল ফর ক্লাইমেট চেঞ্জের (আইপিসিসি) এক প্রতিবেদনের ভাষ্য অনুযায়ী, দাবদাহের মাত্রা বৃদ্ধি ও বন্যার প্রকোপ এরই মধ্যে বিভিন্ন প্রাণী ও উদ্ভিদের সহনশীলতার মাত্রাটি অতিক্রম করে ফেলেছে। চরমভাবাপন্ন এসব আবহাওয়াগত সংকট এখন একসঙ্গে দেখা দিচ্ছে। ফলে এগুলোর প্রভাবও এমন এক পর্যায়ে পৌঁছাচ্ছে, যার ব্যবস্থাপনাও অনেক কঠিন হয়ে পড়ছে।
পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন উপমন্ত্রী হাবিবুন নাহার বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তন একটি বৈশ্বিক সমস্যা। বাংলাদেশ এককভাবে আসলে কিছু করতে পারবে না। জলবায়ু পরিবর্তন বিশ্বব্যাপীই হচ্ছে। তবু জলবায়ুকেন্দ্রিক বিভিন্ন সম্মেলনে বাংলাদেশ জোর গলায় সবসময় কথা বলে।’
এসডব্লিউ এসএস /১৬৩০
আপনার মতামত জানানঃ