যশোরের অভয়নগরে ঘটে যাওয়া ব্যবসায়ী শাহনেওয়াজ কবীর ওরফে টিপুকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা এই চাঞ্চল্যকর ঘটনাটি নিছক একটি ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব নয়—বরং এটি একটি ভয়াবহ সামাজিক সংকটের প্রতিচ্ছবি, যেখানে রাজনীতি, সাংবাদিকতা ও সন্ত্রাস এক অশুভ ত্রিমুখী চক্রে পরিণত হয়েছে। এই চক্রের মুখে পড়ে শুধু একটি পরিবারই নিঃস্ব হয়ে যায়নি, বরং পুরো সমাজ নিরাপত্তাহীনতার ভয়াল শ্বাস নিতে বাধ্য হচ্ছে।
২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ঘটে যাওয়া এই নির্যাতনের ঘটনা শুধু পৈশাচিকতা নয়, বরং রাষ্ট্রের আইনি কাঠামো ও ন্যায়বিচারের প্রতি এক ভয়াবহ প্রশ্নচিহ্ন। একজন ব্যবসায়ীকে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে বারবার টাকার দাবি, শরীরের অর্ধেক অংশ বালুতে পুঁতে রেখে ভয়ভীতির মাধ্যমে টাকা আদায়—এসব কাহিনি যেন কোনো মাফিয়া সিনেমার দৃশ্য। অথচ এটি বাস্তব। আর সেই বাস্তবতার নাম—আসাদুজ্জামান জনি, একজন পদ স্থগিত হওয়া বিএনপি নেতা, ও মফিজ উদ্দিন, একজন সাংবাদিক, যিনি নওয়াপাড়া প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক পদেও আছেন।
বিচারপ্রার্থিনী আসমা খাতুনের ভাষ্যমতে, প্রথমে তাঁকে ব্যাংক অ্যাকাউন্টে দুই কোটি টাকা পাঠাতে বাধ্য করা হয়। এরপর দ্বিতীয় দফায় আরও দুই কোটি টাকার জন্য তাঁর স্বামীকে গর্তে পুঁতে বালু চাপা দেওয়া হয়, যাতে ভয় পেয়ে সব অর্থ দিয়ে দেন। পূবালী ব্যাংক ও সাউথ বাংলা ব্যাংকের হিসাব ব্যবহার করে টাকা স্থানান্তর হয় এবং এক কোটি টাকার চেকও আদায় করা হয় সাংবাদিক মফিজের মাধ্যমে। এ ধরনের সুনির্দিষ্ট আর্থিক তথ্য ও ঘটনার বর্ণনা শোনার পরও প্রশাসনের নীরবতা আরও বেশি আতঙ্কজনক।
বলা হচ্ছে, অভয়নগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এখনো লিখিত অভিযোগ পাননি, যদিও সেনা ক্যাম্পে দেওয়া অভিযোগের তিনদিন পেরিয়ে গেছে এবং থানায় মৌখিকভাবে সব জানানো হয়েছে। এমনকি অভিযুক্তদের একজনের ফোন বন্ধ, অন্যজন নিজেকে অস্বীকার করে লাইন কেটে দেন। তাহলে বিচার কোথায়? নিরাপত্তা কোথায়?
এই ঘটনায় সবচেয়ে বেশি আলোচনায় এসেছে যে বিষয়টি, তা হলো—রাজনীতিবিদদের অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়া। রাজনৈতিক পরিচয়ের কারণেই কি এই ঘটনাগুলো দিনের পর দিন ধামাচাপা পড়ে যাচ্ছে? স্থানীয় রাজনীতি যদি এভাবে অপরাধের আশ্রয়দাতা হয়ে ওঠে, তাহলে সাধারণ মানুষের বেঁচে থাকা কীভাবে নিরাপদ থাকবে?
এত বড় অঙ্কের টাকা—মোট চার কোটি টাকার চাঁদাবাজি—এবং ভয়াবহ শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের মতো ঘটনার সুনির্দিষ্ট বিবরণ থাকা সত্ত্বেও তদন্তে কোনো অগ্রগতি নেই, অভিযোগের পরও প্রশাসনের পক্ষ থেকে ভুক্তভোগীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়নি—এই চিত্র প্রমাণ করে যে রাষ্ট্রীয় যন্ত্রের দায়িত্ব পালনে এক ধরনের অদ্ভুত নির্লিপ্ততা কাজ করছে।
এদিকে, এই ঘটনার আরেকটি ভয়াবহ দিক হলো সাংবাদিকতার অপব্যবহার। সাংবাদিকতা যেখানে দুর্নীতির বিরুদ্ধে কণ্ঠস্বর তোলার কথা, সেখানে একজন প্রেসক্লাব নেতাই যদি অপরাধের ভাগীদার হয়ে ওঠেন, তাহলে বাকিদের ওপর আস্থা থাকবে কীভাবে? মফিজ উদ্দিনের ভূমিকা শুধু একটি পেশার বিশ্বাসঘাতকতা নয়, বরং সাংবাদিকতার নৈতিকতা, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও জনমানুষের উপর প্রভাবের এক নির্মম অপব্যবহার।
এই ঘটনার রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটও গুরুত্বপূর্ণ। আসাদুজ্জামান জনির পদ স্থগিত হলেও তাঁর প্রতাপ যে এখনো সক্রিয়, তা এই নির্যাতনের মাধ্যমে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তাঁর ‘ব্যক্তিগত কার্যালয়’ই যদি নির্যাতন ও চাঁদাবাজির ঘাঁটি হয়ে থাকে, তাহলে বোঝাই যায় স্থানীয় রাজনীতি কতটা সহিংসতা ও দখলদারিতে পরিণত হয়েছে।
এমন একটি সময়ে, যখন বাংলাদেশে রাজনৈতিক উত্তেজনা ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি বারবার প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে, এই ধরনের ঘটনা যেন আরও একবার প্রমাণ করে দেয়, সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা এখন আর কোনো রাজনৈতিক দলের অগ্রাধিকার নয়। বরং রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় অপরাধীরা আরও বেপরোয়া হয়ে উঠছে।
শাহনেওয়াজ কবীরের পরিবার আজ সর্বস্বান্ত। তাঁদের ব্যবসা বন্ধ, বাড়ি ছাড়া কিছুই নেই, ছেলের পরীক্ষার ফরম পূরণের টাকা পর্যন্ত নেই—এমন চিত্র শুধু একটি পরিবারের ব্যক্তিগত দুঃখ নয়, বরং এটি পুরো রাষ্ট্রযন্ত্রের ব্যর্থতার প্রতীক। এই ঘটনা যেন আমাদের সামনে প্রশ্ন তোলে—আমরা কী ধরনের রাষ্ট্র গড়ে তুলেছি, যেখানে বিচার চাওয়ার পরও কেউ এগিয়ে আসে না?
এই ঘটনার পূর্ণাঙ্গ তদন্ত হওয়া জরুরি। অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ না করলে এটি শুধু আরও অপরাধীদের সাহস জোগাবে। একমাত্র জনমতের চাপ, গণমাধ্যমের নির্ভীক প্রতিবেদন ও সুশীল সমাজের সোচ্চার অবস্থানই পারে এই ধরনের অপরাধ রুখে দিতে।
এই ঘটনায় শাহনেওয়াজ কবীরের পরিবার যদি ন্যায়বিচার না পায়, তাহলে সেটি শুধু একটি মামলার অবসান নয়—বরং দেশের বিচার ব্যবস্থার ওপর মানুষের আস্থা হারানোর একটি ভয়াবহ নজির হয়ে থাকবে। তাই এখন সময়—নির্বিচারে ব্যবস্থা নেওয়ার, সত্যকে প্রতিষ্ঠা করার এবং সেইসব রাজনৈতিক ও সাংবাদিক পরিচয়ধারীদের মুখোশ উন্মোচন করার—যারা ক্ষমতা ও প্রভাবের জোরে সাধারণ মানুষের জীবন ধ্বংস করে দেয়।
আপনার মতামত জানানঃ