ভারতের উত্তরাখণ্ড রাজ্যের পাহাড়ি জনপদ উত্তরকাশীতে হঠাৎ নেমে আসা মেঘভাঙা বৃষ্টি ও তৎসংলগ্ন আকস্মিক বন্যা যেন মুহূর্তেই জনজীবনকে তছনছ করে দেয়। ধরালি গ্রাম এবং পার্শ্ববর্তী হর্ষিল উপত্যকা কার্যত নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে প্রবল জলস্রোত, কাদা এবং বিশাল পাথরের আঘাতে। স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, জীবনের এমন ভয়াবহ দৃশ্য তারা আগে কখনো দেখেননি।
এই বিপর্যয়ের কেন্দ্রস্থলে রয়েছে ক্ষীরগঙ্গা নদীর উন্মত্ত স্রোত, যা পাহাড়ি ঢাল বেয়ে নেমে এসে গ্রাম-ঘর, হোটেল, হোমস্টে—সবকিছু ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। মোবাইল ফোনে ধারণ করা কিছু ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে, যেখানে দেখা গেছে মানুষ চিৎকার করে অন্যদের সতর্ক করছে—“পালাও, পালাও”—কিন্তু অনেকেই পালিয়ে বাঁচতে পারেননি।
জেলা প্রশাসনের তথ্য অনুযায়ী, ইতোমধ্যে চারজনের প্রাণহানির খবর নিশ্চিত হওয়া গেছে, তবে নিখোঁজ মানুষের সংখ্যা বেশি এবং মৃতের সংখ্যা বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। সেনাবাহিনী, এনডিআরএফ ও এসডিআরএফ দ্রুত উদ্ধারকাজে নেমেছে। হর্ষিল সেনা ক্যাম্প থেকেও প্রায় ১৫০ সেনা পাঠানো হয়েছে, তবে জানা গেছে, সেখানে কিছু জওয়ানও নিখোঁজ রয়েছেন।
এই দুর্ঘটনার কারণ হিসেবে ‘মেঘভাঙা বৃষ্টি’ বা ক্লাউডবার্স্টকেই দায়ী করা হচ্ছে। আবহাওয়াবিদদের মতে, যখন কোনো ছোট্ট অঞ্চলে (প্রায় ১-১০ কিলোমিটার) এক ঘণ্টায় ১০ সেন্টিমিটারেরও বেশি বৃষ্টি হয়, তখন সেই বৃষ্টিকে মেঘভাঙা বলা হয়। স্বাভাবিক বৃষ্টিপাতের তুলনায় এর তীব্রতা অনেক বেশি এবং এর ফলে সৃষ্ট জলপ্রবাহ ও ভূমিধস ভয়াবহ রূপ নিতে পারে।
এটি ঘটে যখন উষ্ণ আর্দ্র বায়ু ঠান্ডা বায়ুর সংস্পর্শে এসে হঠাৎ করে ঘন মেঘ তৈরি করে। পাহাড়ি এলাকায় ‘অরোগ্রাফিক লিফ্ট’ নামক প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ায় বাতাস উপরের দিকে ওঠে এবং ঠান্ডা হয়ে ঘন মেঘে পরিণত হয়। একসময় সেই মেঘ অতিরিক্ত জল ধরে রাখতে না পেরে হঠাৎ ফেটে পড়ে, ফলে প্রচণ্ড বৃষ্টি হয়। পার্বত্য অঞ্চলে এই বৃষ্টির সঙ্গে নেমে আসে কাদা, পাথর, গাছপালা—যা আকস্মিক বন্যা ও ভূমিধসের আশঙ্কা বাড়িয়ে তোলে।
আবহাওয়ার এমন আচরণ যে ভবিষ্যতে আরও তীব্র হতে পারে, সে বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা একমত। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে মৌসুমি বায়ুর ধরনে পরিবর্তন এসেছে, বেড়েছে বৃষ্টিপাতের সময় ও পরিমাণ। এর ফলে আগে যেসব এলাকায় কম ঝুঁকি ছিল, সেসব অঞ্চলও এখন দুর্যোগপ্রবণ হয়ে উঠছে।
২০১৩ সালে একইরকম মেঘভাঙা বৃষ্টিতে উত্তরাখণ্ডের কেদারনাথে হাজারো মানুষ প্রাণ হারিয়েছিলেন। সেই ঘটনার স্মৃতি এখনও তাজা। এবারও সেই ভয়াবহতার পুনরাবৃত্তি ঠেকাতে যথাসম্ভব প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছিল, কিন্তু প্রকৃতির রুদ্ররূপের কাছে তা অপ্রতুল হয়ে পড়ে।
প্রশ্ন উঠছে, বারবার কেন উত্তরাখণ্ডেই এমন ঘটনা ঘটছে? গবেষণাগারগুলো বলছে, হিমালয় অঞ্চল ভূতাত্ত্বিকভাবে অত্যন্ত ভঙ্গুর এবং জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে এই অঞ্চলে মেঘভাঙা বৃষ্টির সম্ভাবনা বেড়েছে। উত্তরাখণ্ডের প্রতি ইউনিট এলাকায় মেঘভাঙার প্রবণতা ভারতের অন্য যেকোনো হিমালয়সংলগ্ন অঞ্চলের তুলনায় বেশি।
তাছাড়া, অতিরিক্ত পর্যটন, হোটেল নির্মাণ, রাস্তাঘাটের অগোছালো বিস্তার এবং বন উজাড়—সব মিলিয়ে এই অঞ্চলের প্রাকৃতিক ভারসাম্য ভেঙে পড়ছে। ফলস্বরূপ, বৃষ্টির জল শোষণ করার মাটির স্বাভাবিক ক্ষমতা হারিয়ে যাচ্ছে এবং বন্যা আরও ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে।
পাশাপাশি রয়েছে প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতা। মেঘভাঙা বৃষ্টির সঠিক ও আগাম পূর্বাভাস দেওয়া এখনো সম্ভব নয়, বিশেষ করে পাহাড়ি অঞ্চলে। আবহাওয়া দপ্তরের ডপলার রাডার প্রযুক্তি কিছুটা সহায়তা করতে পারলেও হিমালয় এলাকার প্রতিটি অঞ্চলে রাডার স্থাপন সম্ভব হয়নি।
এই পরিস্থিতিতে উত্তরকাশীর বিপর্যয় আমাদের আবার স্মরণ করিয়ে দিল, প্রকৃতি যখন রুদ্ররূপে আবির্ভূত হয়, তখন মানুষ কতটা অসহায়। একইসঙ্গে এটি প্রশ্ন তোলে, আমরা কি প্রকৃতির সঙ্গে লড়াই করছি, না নিজেদের তৈরি দুর্যোগকে ডেকে আনছি?
উত্তরকাশীর এই ভয়াবহতা আমাদের শেখায়, প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষা না করলে, পাহাড়ের বুক চিরে রাস্তা ও হোটেল না বানিয়ে পরিবেশবান্ধব পরিকল্পনা না করলে আগামী দিনে আরও ভয়াবহ বিপর্যয়ের সাক্ষী হতে হবে। এখনো সময় আছে, মানুষ যদি প্রকৃতির পাঠ বুঝতে শেখে।
আপনার মতামত জানানঃ