বাংলার ইতিহাসে পাল বংশ এক গৌরবময় অধ্যায়, যাদের হাত ধরে বৌদ্ধ ধর্ম এ অঞ্চলে রাজধর্মের মর্যাদা পায় এবং বৌদ্ধ সংস্কৃতি, শিক্ষা ও স্থাপত্যের এক অসাধারণ বিকাশ ঘটে। কিন্তু ইতিহাসে যেমন উত্থান থাকে, তেমন পতনও অনিবার্য। পালদের দীর্ঘ ৪০০ বছরের শাসনের অবসানের সঙ্গে সঙ্গেই বাংলার বৌদ্ধ ধর্মও তার ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক উচ্চতা থেকে ধীরে ধীরে হারিয়ে যেতে শুরু করে। একসময় যেই ধর্ম বাংলার প্রধান ভিত্তি ছিল, তা-ই কালের প্রবাহে হয়ে পড়ে প্রান্তিক। প্রশ্ন জাগে—কেন? কিভাবে এত বিস্তৃত, শক্তিশালী এক ধর্মব্যবস্থা প্রায় সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয়ে গেল?
গোপাল দেব ছিলেন পাল বংশের প্রতিষ্ঠাতা—প্রজা কর্তৃক নির্বাচিত বাংলার প্রথম শাসক। তার বংশধররাই বাংলায় বৌদ্ধ ধর্মের অনন্য এক স্বর্ণযুগ তৈরি করেন। নির্মিত হয় বিখ্যাত মহাবিহার, যেমন সোমপুর, বিক্রমশীলা ও নালন্দা, যেগুলো শুধু উপাসনালয় নয়, একেকটি আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয় ছিল। তিব্বত, চীন, মিয়ানমার এমনকি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশে পালদের নির্মাণশৈলীর প্রভাব লক্ষ করা যায়। চট্টগ্রামেও মহাযান মতবাদের প্রভাবে নির্মিত হয়েছে বহু বৌদ্ধমূর্তি ও বিহার।
তবে এ দীপ্তিময় অবস্থান চিরস্থায়ী হয়নি। পাল রাজাদের উদার নীতিতে বৌদ্ধ ধর্মের পাশাপাশি ব্রাহ্মণ্য ও জৈন ধর্মও সমাজে বিকাশের সুযোগ পায়। কিন্তু এই সহাবস্থানের নেপথ্যে গড়ে উঠতে থাকে এক সাংস্কৃতিক সংকট। বৌদ্ধ ধর্ম, বিশেষ করে মহাযান মতবাদ, তন্ত্রসাধনা, দেবী উপাসনা ও হিন্দু শৈব-মাতৃ আরাধনার সংমিশ্রণে নিজস্বতা হারিয়ে ফেলে। বুদ্ধকে পরিণত করা হয় দেবতায়, তার পাশে স্থাপন করা হয় তারারূপী কালী, বসুধাসহ হিন্দু দেবদেবী। এতে ধর্মীয় আধ্যাত্মিকতার চেয়ে প্রতীকময়তা ও আচারপ্রধানতা প্রবল হয়ে ওঠে। বৌদ্ধ ধর্ম হয়ে ওঠে হিন্দুধর্মেরই এক উপধারা। শীল, বিনয়, সংঘ—এই মৌলিক ভিত্তিগুলো দুর্বল হয়ে পড়ে। ভক্তির নামে শুরু হয় গুহ্যসাধনা, যেটা ধর্মকে একরকম বিকৃতির দিকে ঠেলে দেয়।
একই সময়ে বর্মণ ও সেন বংশের রাজারা ব্রাহ্মণ্য ধর্মকে একক পৃষ্ঠপোষকতায় এগিয়ে নেন। রাজদরবারে ব্রাহ্মণদের আধিপত্য, কুলীন ব্রাহ্মণদের বসতি স্থাপন, বৌদ্ধ বিহার দখল এবং বৌদ্ধদের উপর নিপীড়ন—সব মিলিয়ে বৌদ্ধ ধর্ম নিঃশব্দে বিদায় নিতে থাকে। শূন্যপুরাণে যেমন দেখা যায়, বৌদ্ধ নিধনের আহ্বান তোলা হয়। সোমপুর বৌদ্ধবিহারে হিন্দু মূর্তি পাওয়া যায়, বুদ্ধগয়ার মহাবিহারে শিবের প্রতিমা স্থাপন হয়ে যায়। এমনকি বুদ্ধের ধ্যানমগ্ন মূর্তিকে জৈন ধর্মের মহাবীর বলেও চালিয়ে দেওয়া হয়। পাল-পরবর্তী যুগে বৌদ্ধ ধর্ম রাজধর্ম নয়, প্রান্তিক এক সংস্কৃতি হয়ে পড়ে।
এর পর আসে বিদেশি আক্রমণের পর্ব—তুর্কি সেনাপতি বখতিয়ার খলজির আগমনে মগধের বিহারসমূহ ধ্বংস হয়ে যায়। ওদন্তপুর, বিক্রমশীলা, নালন্দা—সব জ্ঞানকেন্দ্র ধ্বংস হয়। পাল বংশের শেষ রাজা গোবিন্দপাল নিজের সামান্য বাহিনী নিয়ে প্রতিরোধের চেষ্টা করলেও নিঃশেষ হন। এই ধ্বংসের সময় অনেক ভিক্ষু তিব্বত, নেপাল, আরাকান বা সিংহলে পালিয়ে যান। সংঘহীন বিহারগুলো আর ধর্ম টিকিয়ে রাখতে পারে না। ধর্ম হয়ে পড়ে নিঃশব্দ।
অথচ তুর্কিরা যখন হিন্দু সমাজকে সামাল দিতে পারে না, তখন বৌদ্ধ ধর্ম কেন টিকে থাকতে পারল না? কারণটা নিহিত ছিল বৌদ্ধদের কেন্দ্রিকতাবাদে। বিহারভিত্তিক ধর্মচর্চা ছিল বৌদ্ধদের প্রধান শক্তি, যার অবকাঠামো ধ্বংস হলে বৌদ্ধ ধর্মের পাট চুকতে সময় লাগেনি। আর এক্ষেত্রে সেন ও বর্মণ আমলে রাজপৃষ্ঠপোষকতা হারানো, ব্রাহ্মণ্য আধিপত্য ও অভ্যন্তরীণ বিকৃতিই ছিল বৌদ্ধ ধর্মের পতনের মূল কারণ।
তবে চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামে বৌদ্ধ ধর্ম টিকে ছিল। আরাকানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা, মহাযানের অবশিষ্ট প্রভাব, পগাঁ সাম্রাজ্যের আনোরহতার মাধ্যমে থেরবাদ প্রচার—এসব মিলিয়ে চট্টগ্রামে বৌদ্ধ ধর্ম নতুন রূপে আত্মপ্রকাশ করে। ১৮৭০-এর দশকে সারমেধ মহাথেরো এসে থেরবাদ প্রতিষ্ঠা করেন। ক্রমে মহাযান রূপ স্তিমিত হয়, এবং বৌদ্ধ সমাজ থেরবাদ ঘরানায় আত্মস্থ হয়।
চট্টগ্রামেরই সন্তান কৃপাশরণ মহাস্থবির ছিলেন ভারতের বৌদ্ধ পুনর্জাগরণের পথিকৃৎ। তিনি কলকাতায় বৌদ্ধ ধর্মাঙ্কুর সভা গড়ে তুলেছিলেন। তার পথেই পরে আম্বেদকার বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করেন। কক্সবাজারের রামুতে উ চন্দ্রমনি উপসম্পাদা লাভ করেন—বাংলাদেশ থেকে শুরু করে ভারতের মধ্যেও বৌদ্ধ ধর্মের আধুনিক পুনর্জাগরণের শিকড় চট্টগ্রামের বৌদ্ধদের হাত ধরে বিস্তার লাভ করে।
এই ইতিহাস আমাদের বলে, পাল রাজত্বের শেষের দিকে বৌদ্ধ ধর্ম নিজের চরিত্র হারিয়ে ফেলে, তান্ত্রিকতা ও হিন্দু প্রভাব তার মৌলিক নীতিকে বিপন্ন করে, রাজপৃষ্ঠপোষকতা হারিয়ে এক অসহায় ধর্মে পরিণত হয়, যার শেষ ধাক্কা দেয় তুর্কি আক্রমণ। কিন্তু শেষ বলে কিছু নেই। ইতিহাস ঘুরে দাঁড়ায়। সেই প্রান্তিক ধর্মও নতুন আলোয় ফের উঠে দাঁড়ায়—চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামের মানুষদের হাতে। আজ সেই উত্তরাধিকারই বহন করছে বাংলাদেশের বৌদ্ধ সমাজ।
আপনার মতামত জানানঃ