চীন একটি অ্যাপের মাধ্যমে স্মার্ট ফ্রিজ, ল্যাপটপ, লাইট বাল্ব এবং অন্যান্য যন্ত্রপাতি নিয়ন্ত্রণ করে যুক্তরাজ্যের যে কারো বিরুদ্ধে গুপ্তচরবৃত্তি চালাতে পারে।
সম্প্রতি ওয়াশিংটন-ভিত্তিক কনসালটেন্সি, অবজারভ, ওরিয়েন্টেট, ডিসাইড, অ্যাক্ট (ওওডিএ) কর্তৃক প্রকাশিত প্রতিবেদনে এমন দাবি করে বলা হয়েছে, অনেক দেরি হওয়ার আগেই যুক্তরাজ্য সরকারের এ বিষয়ে কিছু করা উচিত।
বৃটিশ ট্যাবলয়েড ডেইলি মেইল এ খবর দিয়ে নিজেদের এক প্রতিবেদনে জানাচ্ছে, বেইজিংয়ে নিযুক্ত সাবেক কূটনীতিক, চার্লস পার্টন লিখিত ওই প্রতিবেদনে সতর্ক করে বলা হয়েছে: এটাই জেগে ওঠার সময়। স্বাধীন এবং উন্মুক্ত দেশগুলোকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নিজেদের ‘সাপ্লাই চেইন’ থেকে চীনের তৈরি মডিউল নিষিদ্ধ করা উচিত।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তিনটি চীনা কোম্পানি; Quectel, Fibocom এবং China Mobile, স্মার্ট ডিভাইসের বৈশ্বিক বাজারের ৫৪ শতাংশে আধিপত্য বিস্তার করছে।
গাড়ি এবং গার্হস্থ্য যন্ত্রপাতিগুলোতে এম্বেড করা মাইক্রোচিপগুলো জাতীয় নিরাপত্তার জন্য ‘বিস্তৃত’ হুমকি সৃষ্টি করে কারণ চীন লাখ লাখ বৃটিশদের বিরুদ্ধে গুপ্তচরবৃত্তি চালানোর জন্য তাদের ‘অস্ত্র তৈরি’ করতে পারে।
ওই মডিউলগুলো ল্যাপটপ, ভয়েস-কন্ট্রোলড স্পিকার, স্মার্ট ঘড়ি, স্মার্ট এনার্জি মিটার, ডোরবেল ক্যামেরা, পুলিশ বডি ক্যাম, ক্যাশপয়েন্ট, গাড়ি এবং এমনকি হট টবেও পাওয়া যায়। এগুলো তথ্য সংগ্রহ করে এবং চীনা সরকারের কাছে তা হস্তান্তর করতে পারে।
তবে এমন অভিযোগ নতুন কিছু নয়। এর আগে গত বছরের জুলাই মাসে এফবিআই প্রধান এবং ব্রিটেনের অভ্যন্তরীণ গোয়েন্দা সংস্থার নেতারা চীনা সরকার সম্পর্কে একই সতর্কতা উত্থাপন করেন। তারা ব্যবসায়ী নেতাদের সতর্ক করে বলেন, বেইজিং প্রতিযোগিতামূলক লাভের জন্য তাদের প্রযুক্তি চুরি করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে।
এফবিআই ডিরেক্টর ক্রিস্টফার রে, চীনের অর্থনৈতিক গুপ্তচরবৃত্তি এবং হ্যাকিং অপারেশনের নিন্দা করার পাশাপাশি, বিদেশে ভিন্নমতকে দমন করার জন্য চীন সরকারের প্রচেষ্টা সম্পর্কে দীর্ঘস্থায়ী উদ্বেগের বিষয়টি পুনর্ব্যক্ত করেন।
রে বলেন, আমরা ধারাবাহিকভাবে দেখতে পাচ্ছি যে, চীনা সরকার আমাদের অর্থনৈতিক এবং জাতীয় নিরাপত্তার জন্য সবচেয়ে বড় দীর্ঘমেয়াদী হুমকি সৃষ্টি করেছে।
চীনের বিরুদ্ধে বিভিন্ন দেশের ওপর গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগ বহুদিনের। গণতান্ত্রিক দেশগুলোয় এ ধরনের গুপ্তচরবৃত্তি ও রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার নিয়ে দেশটিকে ২০২১ সালে সতর্ক করে দেয় নেদারল্যান্ডস, ফিনল্যান্ড এবং কানাডার গোয়েন্দা সংস্থাগুলো।
সে সময় আমেরিকান নিউজ ওয়েবসাইট অ্যাক্সিওসে প্রকাশিত খবরের বরাত দিয়ে দ্য ফ্রন্টেয়ার পোস্ট জানিয়েছিল, নেদারল্যান্ডসের গোয়েন্দা বিভাগ ডাচ জেনারেল ইন্টেলিজেন্স অ্যান্ড সিকিউরিটি সার্ভিস একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল। দেশের জাতীয় নিরাপত্তায় রক্ষায় হুমকি সৃষ্টি করছে এমন বিষয়গুলো সেখানে উল্লেখ করা হয়।
প্রতিবেদনটিতে বলা হয়, চীনের সাইবার-গুপ্তচরবৃত্তি নেদারল্যান্ডসের ব্যাংকিং, জ্বালানী এবং অবকাঠামোসহ সামগ্রিক অর্থনীতিতে ‘আসন্ন হুমকি’ হয়ে উঠেছে।
নেদারল্যান্ডসভিত্তিক গবেষণা সংস্থা ক্লিনজেনদেয়াল ইনস্টিটিউটের গবেষক তিয়েস ড্যামস অ্যাক্সিওসকে জানান, ‘পর্দার অন্তরালে নেদারল্যান্ডসের গোয়েন্দা সেবা সংস্থাগুলোর অন্যতম আলোচনার বিষয় হয়ে উঠেছে চীন। জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থা এআইভিডি এবং এনসিটিভির নেতৃত্বে তারা অর্থনৈতিক খাতে চীনের গুপ্তচরবৃত্তি এবং রাজনৈতিক প্রভাবের বিষয়টিতে গুরুত্ব দিচ্ছে।’
নেদারল্যান্ডসের মতো ফিনল্যান্ডের গোয়েন্দা বিভাগও চীনের গুপ্তচরবৃত্তি নিয়ে উদ্বিগ্ন। ফিনিশ সিকিউরিটি অ্যান্ড ইন্টিলিজেন্স সার্ভিসের পরিচালক আন্টি পেল্টারি চীন ও রাশিয়াকে উদ্বৃত করে জানান, স্বৈরাচারী দেশগুলো ‘ফিনল্যান্ডের গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো নিজেদের আয়ত্তে নেয়ার চেষ্টা করছে।’ চীনের প্রযুক্তি কোম্পানি হুয়াওয়েকে কোনভাবেই ফিনল্যান্ডে ফাইভজি নেটওয়ার্ক স্থাপনের অনুমতি দেয়া হবে না বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
অন্যদিকে কানাডার সিকিউরিটি ইন্টিলিজেন্স সার্ভিসের পরিচালক ডেভিড ভিগন্যাল্টের বক্তব্য উদ্বৃত করে অ্যাক্সিওসের প্রতিবেদনে জানানো হয়, ‘অর্থনৈতিক, প্রযুক্তি, রাজনীতি এবং সামরিক প্রতিটি দিক থেকেই ভূ-রাজনৈতিক সুবিধা পাওয়া যাবে এমন কৌশলগুলো প্রয়োগ করছে চীন। এছাড়া রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার সব উপকরণগুলো ব্যবহার করে চীন এমন সব কার্যক্রম পরিচালনা করছে যা আমাদের জাতীয় নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্বে প্রত্যক্ষ হুমকি হয়ে উঠছে।’
তিনি আরো জানান, ‘এই কার্যক্রমগুলো আমাদের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার সীমা অতিক্রম করছে।’
বেইজিং কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে একের পর এক মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগের প্রেক্ষিতে বিশ্বের অনেক দেশই চীনা কোম্পানি হুয়াওয়েকে ফাইভজি নেটওয়ার্ক স্থাপনের অনুমতি দিচ্ছে না। এ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চীনের সম্পর্কে ব্যাপক টানাপোড়েন চলেছে। ২০১৮ সালের আগস্টে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ট ট্রাম্প জাতীয় নিরাপত্তা রক্ষার স্বার্থে দেশের সব মন্ত্রনালয়কে হুয়াওয়ে এবং জেডটিইর তৈরি যেকোন নেটওয়ার্ক সরঞ্জাম ব্যবহার না করার নির্দেশ দিয়ে ডিক্রি সই করেন। যুক্তরাজ্য সরকারও এ নিয়ে সতর্ক অবস্থানে রয়েছে।
দেশটির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে তাদের সব ফাইভজি নেটওয়ার্ক হুয়াওয়েমুক্ত করার কাজ শুরু করা হবে; আর এই কার্যক্রম চলবে ২০২৭ সাল পর্যন্ত।
এসডব্লিউএসএস/১৮০৩
আপনার মতামত জানানঃ