কাবুল দখলের কাছাকাছি দাঁড়িয়ে তালিবান স্পষ্ট হুমকির সুরে ভারতকে জানিয়ে দিল, ‘আফগানিস্তানে সেনা পাঠালে বিপদ আছে’! কিছুদিন আগেও যখন আফগানিস্তানের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে ভারতের বিন্দুমাত্র ধারণা ছিল না – তখন ‘অতীতের নীতি বদলে তালিবানের সঙ্গেও আফগানিস্তানের শান্তি প্রক্রিয়া নিয়ে আলোচনা করা হচ্ছে’ বলে জানিয়েছিল ভারত সরকার। আদৌতে ভারতের কোন উদ্যোগ দৃশ্যমান হয়নি। ভারতের শান্তি প্রক্রিয়ার আহবান আন্তর্জাতিক মহলে কোন ধরনের আবেদন তৈরি করতে পারেনি।
এত দ্রুত যে পরিস্থিতির অবনতি হবে, তা ভারতের যাবতীয় হিসাবের বাইরে ছিল বলে দেশটির কূটনৈতিকমহলে হতচকিত অবস্থা। অথচ শুধু পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর নন, কাবুল এবং পাকিস্তান নীতিকে নতুন করে সাজাতে দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল প্রধানমন্ত্রীর বিশ্বস্ত জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভালকে। তাঁর তালেবান-দৌত্যও খুব একটা ফলপ্রসূ হয়নি। অন্য দিকে, আফগানিস্তান সরকারের অস্তিত্ব অনুভব করা যাচ্ছে না বর্তমান পরিস্থিতিতে। দেশটি তালিবানদের নির্দেশ মোতাবেক চলছে বলে আন্তর্জাতিকমহলে দৃশ্যমান হচ্ছে। নিঃশব্দে চীন, পাকিস্তান, ইরান, রাশিয়ার মতো দেশগুলির সঙ্গে তালেবান নেতৃত্বের যোগাযোগ এখন স্পষ্ট।
মহাভারতের গান্ধার রাষ্ট্রের কথা অনেকে না জানলেও হিন্দুকুশ পর্বতমালার নাম সবাই জানেন। গান্ধার রাষ্ট্র বা হিন্দুকুশ পর্বতমালা এখন আফগানিস্তান নামে পরিচিত। বিশ্ব রাজনীতিতে এ সময়ে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু ধূসর মরুভুমি ও পাহাড় অধ্যুষিত আফগানিস্তান। কি হবে? এ প্রশ্নের উত্তর কারো জানা নেই? তবে এর কারণ সবাই জানেন, আমেরিকা বা ন্যাটো সেখান থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জোসেফ বাইডেন আগামী ৩১ আগস্টের মধ্যে সকল সৈন্য প্রত্যাহারের ঘোষণা করে বলেছেন, ‘এখন সৈন্যদের ঘরে ফেরার সময় হয়েছে।’ মার্কিন সাবেক প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ (জুনিয়র) এ সিদ্ধান্তকে ‘ভুল’ অভিহিত করে বিশেষত: আফগান নারীদের ভবিষ্যৎ নিয়ে উৎকণ্ঠা প্রকাশ করেছেন। খবরে প্রকাশ, তালেবানরা তাঁদের অধিকৃত অঞ্চলে ১৫-৪৫ বছরের সকল অবিবাহিত, তালাকপ্রাপ্ত বা স্বামী পরিত্যক্ত, বিধবা নারীদের তালিকা চেয়েছে।
আফগানিস্তানের অধিকাংশ ভূমি দখল করে নেয়ার পর কাবুলে ঢুকে পড়েছে তালিবান। আফগানিস্তানে এমন টানটান পরিস্থিতির মধ্যে রোববার আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমসমূহকে তালিবানের মুখপাত্র সুহেল শাহিন বলেছেন, ‘যদি ভারতীয় সেনা আফগান সেনাকে সাহায্য করার জন্য এগিয়ে আসে, তা হলে সেটা তাদের জন্য ভাল হবে না। আফগানিস্তানে অন্য দেশের সেনাদের সঙ্গে কী হয়েছে, সেটা সবাই দেখেছে। ভারতীয় সেনা আফগানিস্তানে এলে আগে থেকে সব জেনেই আসবে।’ তবে সেই সঙ্গে আফগানিস্তানের মানুষের জন্য ভারতের অবদানের প্রশংসাও করেছেন তালিবান মূখপাত্র শাহিন। তিনি বলেছেন, ‘আফগানিস্তানের মানুষের জন্য সেতু নির্মাণ, পরিকাঠামোর উন্নতিতে অনেক সাহায্য করেছে ভারত। এতে এখানকার অর্থনৈতিক উন্নতি হয়েছে। এই ভূমিকার জন্য প্রশংসা করছি। কিন্তু আফগানিস্তানের জনগণের আভ্যন্তরীন বিষয়ে মাথা ঘামালে উপযুক্ত জবাব দেওয়া হবে।’
আফগানিস্তানের উত্তপ্ত পরিস্থিতির মধ্যে থেকে নিজেদের নাগরিকদের দেশে ফিরিয়ে নিতে শুরু করেছে আমেরিকা, ভারত, বৃটেন, জার্মানিসহ অন্যান্য দেশ। তালিবান নেতা শাহিন অবশ্য বলেছেন, ‘দূতাবাস ও কূটনৈতিক কর্মকাণ্ডেযুক্ত ব্যক্তিদের কোনও ক্ষতি আমরা করব না। তাদের নিশানা করা হবে না। আমরা সেটা জানিয়েও দিয়েছি। ভারত তাদের নাগরিকদের জন্য যে চিন্তা করছে, সেটা তাদের সিদ্ধান্ত। কিন্তু আমরা তাদের কিছু করব না।’ এই পরিস্থিতিতে আফগানিস্তান বিষয়ক কাতার-জোটের পক্ষ থেকে (ভারত, জার্মানি, তাজিকিস্তান-সহ কিছু দেশ যার সদস্য) জানানো হয়েছে, সামরিক শক্তি খাটিয়ে আফগানিস্তানে সরকার গঠন করা হলে তাকে স্বীকৃতি দেয়া হবে না।
এদিকে, আন্তর্জাতিক রণকৌশলগত বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এই যুদ্ধ পরিস্থিতিতে এই দেশগুলির স্বীকৃতি দেয়া বা না দেওয়ার উপর ঘটনার গতি আদৌ নির্ভর করছে না। এ ব্যাপারে আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের কোনও সন্দেহ নেই যে, বিশ বছর পর তালিবানের এই উত্থানের পিছনে সম্পূর্ণ সহযোগিতা রয়েছে দু’টি বড় দেশ চীন এবং রাশিয়ার। অন্য একটি দেশ পাকিস্তানও যদি আগাগোড়া তালিবানের পাশে না থাকত, তা হলে তারা এই অবিশ্বাস্য ঝড়ের গতিতে সামরিকভাবে অগ্রসর হতে পারত কি-না, তা নিয়েও যথেষ্ঠ প্রশ্ন রয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে ভারতের জন্য তালিবানের হুমকি যথেষ্ট উদ্বেগের ও চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আফগানিস্তান নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান কুটনীতি হচ্ছে- তাঁদের নাগরিকদের দেশে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পারলেই যেন বাঁচে। তার বেশি কোনও আন্তর্জাতিক দায় মেটানোর ইচ্ছা বাইডেন সরকারের আপাতত নেই। উপমহাদেশের দেশগুলো নিজেদের মধ্যে সংঘাতে জড়ালেও বিশেষ কিছু এসে যাবে না বাইডেন প্রশাসনের, যতক্ষণ না তার আঁচ আমেরিকায় গিয়ে পড়ছে। শুধু আমেরিকা নয়। সম্প্রতি ভারতের পুরনো ও পরিক্ষিত বন্ধু রাশিয়ার সঙ্গেও তালিবান প্রশ্নে মতবিরোধ ঘটেছে মোদি সরকারের। একই অবস্থা ইরান ও ব্রিটেনের সঙ্গেও। তালিবান রাশিয়াকে আশ্বাস দিয়েছে, তারা নিশ্চিন্তে থাকতে পারে, তালিবানদের এই যুদ্ধ আফগানিস্তানের বাইরে গড়াবে না। ফলে তালেবানি সন্ত্রাস নিয়ে মাথা গলাতে চায় না মস্কো। অনুরূপ আশ্বাস পেয়েছে ভারতের আদি ও অকৃত্রিম সহচর ইরানও। তাই ইরান আফগানিস্তানের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে উচ্চবাচ্য করছে না।
অন্যদিকে ব্রিটেনের পক্ষ থেকেও ভারতকে জানিয়ে দেয়া হয়েছে, তালেবান যদি ক্ষমতায় আসে, তবে তাদের স্বীকৃতি দিতে কোনও সমস্যা নেই। আফগানিস্তান-পাকিস্তান নীতির ক্ষেত্রেও ব্রিটেনের সমর্থন রয়েছে পুরোপুরিভাবে ইসলামাবাদের দিকে, এমন আশঙ্কা ছড়াচ্ছে দক্ষিণ ব্লকে। ব্রিটেন বরাবর মনে করে আসছে, তাদের ভূ-কৌশলগত অবস্থানের জন্য পাকিস্তানই ওই অঞ্চলের নিরাপত্তা বহাল রাখতে সবচেয়ে বেশি কার্যকরী। ফলে আফগানিস্তান এ বর্তমানে তালিবান রাষ্ট্র হয়ে উঠলে তাতে পাকিস্তানের প্রভাব বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। সে ক্ষেত্রে তাদের বিরুদ্ধে লড়াইটা আপাতত একাই লড়তে হবে নয়াদিল্লিকে।
প্রশ্ন হচ্ছে, রাশিয়া ও আমেরিকার পর পরাশক্তি চীন কি আফগান বধ্যভূমিতে প্রবেশ করবে? অন্য দুই পরাশক্তির চেয়ে আফগানিস্তানে চীনের কিছু বাড়তি সুবিধা আছে। আফগানিস্তানের সাথে চীনের সীমান্ত আছে। অনেকদিন ধরে চীন আফগানিস্তান কব্জায় নিতে চাচ্ছে, কারণ সেদেশের রুপার খনি, এবং সাথে রয়েছে সোনা, ইউরেনিয়াম ও লিথিয়াম। ওআরএফ (ওভারসিজ রিসার্স ফাউন্ডেশন) একধাপ এগিয়ে প্রশ্ন করেছে, ভারত-চীন-পাকিস্তান কি আফগান প্রশ্নে একসাথে কাজ করতে পারে? আফগান থেকে মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহার ঐ অঞ্চলে ‘শূন্যতা’ সৃষ্টি করবে তা সত্য, সেই শূন্যস্থান পুরণ করবে কে? মোল্লা ওমরের তালিবান সরকারের বর্বরতার কথা বিশ্ব জানে, আবার কি তালেবান সরকার আসছে? কাবুলে ক্ষমতাসীন আফগান সরকার গত কুড়ি বছর কি করেছে? আফগানিস্তান প্রশ্নে আন্তর্জাতিকভাবে নিঃসঙ্গ ভারতের বর্তমান পরিস্থিতিতে কুটনীতি কি হতে পারে?
এটা অস্বীকার করার কোন অবকাশ নাই, আফগানিস্তানে তালিবানের উত্থান ও চীন-পাকিস্তানের ভূমিকা ভারতের গলার কাঁটা হয়ে উঠেছে। দেশটির ক্ষমতারকেন্দ্রে তালিবান থাকলে ভারতের আভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে বিরাট প্রভাব পড়বে। কাশ্মীর ইস্যুতে ভারত অনেক নমনীয় আচরণ করতে বাধ্য হবে। যার কারণে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে কেন্দ্রের সাথে বিদ্যমান জাতিগত ও আঞ্চলিক সমস্যাগুলো মাথাচড়া দিয়ে উঠবে। সবমিলিয়ে ভারতকে আগামীতে কঠিন রাজনৈতিক বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে।
আপনার মতামত জানানঃ