পরিবেশ দূষণের অন্যতম কারণ হলো প্লাস্টিক। যে কোন বড় শহরের আবর্জনার স্তুপের বড় একটা অংশ জুড়ে আছে হাজার হাজার, লক্ষ লক্ষ প্লাস্টিক। প্লাস্টিক এখন মহাসাগরের গভীর তলদেশেও ছড়িয়ে গেছে, ঢুকে পড়েছে তিমির মত নানা প্রাণীর পেটে, মানুষের খাবারে, এমনকি মানব ভ্রুণের প্ল্যাসেন্টাতেও ঢুকে পড়েছে প্লাস্টিকের কণা।
এক হিসেবে বলা হয়, একটি মাত্র প্লাস্টিক ব্যাগ মাটিতে মিশে যেতে সময় লাগে প্রায় ১ হাজার বছর। এজন্য প্লাস্টিক বর্জ্য কীভাবে সহজে রিসাইকল করা যায়, এটাই বিজ্ঞানীদের কাছে এক বড় চ্যালেঞ্জ। পরিবেশ সংগঠন গ্রিনপিস বলছে, ২০১৫ সাল নাগাদ পৃথিবীতে ৬৩০ কোটি টন প্লাস্টিক ছড়িয়ে পড়েছে; যার মাত্র ৯ শতাংশই রিসাইকল হয়েছে।
কিছু প্লাস্টিক রিসাইকল করা যায়, কিন্তু অন্য কিছু প্লাস্টিক রিসাইকল করা খুব কঠিন। এতে সমস্যা হচ্ছে, অন্য আবর্জনার মত প্লাস্টিক পচে-গলে মাটিতে মিশে যায় না, এটা টিকে থাকে শত শত বছর। এক ধরনের প্লাস্টিক আছে যাকে বলে পি ই টি (পলিইথাইলিন টেরেপথালেট); যা ব্যবহার করা হয় নানা রকমের পানীয়ের বোতল তৈরির জন্য। এগুলো সহজে নষ্ট হয়না।
এই পিইটি-কে ফাঙ্গাস দিয়ে ধ্বংস করা যায় কিনা সেটাই পরীক্ষা করে দেখছেন বায়োহম নামে একটি বায়ো-ম্যানুফ্যাকচারিং ফার্মের প্রধান বায়োটেক প্রকৌশলী সামান্থা জেংকিন্স। জেংকিন্সের প্রকল্পের লক্ষ্য ছিল জৈব-ভিত্তিক পদার্থকে ইনসুলেশন প্যানেল তৈরিতে কীভাবে ব্যবহার করা যায় সেটা পরীক্ষা করা।
কিন্তু এই প্লাস্টিক-খেকো ‘ক্ষুধার্ত ফাঙ্গাস’ তাদের গবেষণাকে নিয়ে গেল অন্য আরেক দিকে। বায়োহম এখন কাজ করছে কিভাবে এই ফাঙ্গাসের আরো শক্তিশালী একটা জাত তৈরি করা যায়; যা হয়তো একসময় প্লাস্টিক বর্জ্য থেকে পরিবেশকে মুক্ত করতে পারবে।
তিনি ফাঙ্গাসটি প্রসঙ্গে বলেন, “আপনি প্লাস্টিক দিচ্ছেন, ফাঙ্গাসটা সেই প্লাস্টিক খেয়ে ফেলছে। তার পর ফাঙ্গাস জন্ম দিচ্ছে আরো ফাঙ্গাসের – আর সেটা থেকে আপনি নানা রকম বায়ো-মেটিরিয়াল বা জৈবপদার্থ তৈরি করতে পারছেন। সেটা নানা কাজে লাগানো যেতে পারে, খাবার তৈরির জন্য, পশুর জন ফিডস্টক তৈরিতে, এমনকি এন্টিবায়োটিক তৈরির কাজে।”
তার কোম্পানির একটি গবেষণা প্রকল্পের কাজের জন্য তিনি কয়েকরকম ফাঙ্গাস নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাচ্ছিলেন। এর মধ্যে একটি ফাঙ্গাস তার গবেষণার গতিপথ ঘুরিয়ে দেয়।
তিনি বলেন, “ধরুন, একটা শস্যকণা ভর্তি জারে এক দলা ফাঙ্গাস গজিয়েছে। ব্যাপারটা দেখতে মোটেও উত্তেজনাকর বা আকর্ষণীয় কিছু না। কিন্তু যেই জারটা খোলা হলে দারুণ এক ব্যাপার দেখা গেল। দেখা গেল, জারটা বায়ুরোধী করার জন্য যে প্লাস্টিকের স্পঞ্জ দেয়া ছিল ফাঙ্গাসগুলো সেটাতে ক্ষয় ধরিয়েছে, এবং অন্য যে কোন খাবারের মতই সেটাকে হজম করে ফেলেছে।”
প্লাস্টিক-খেকো ফাঙ্গাস আর ব্যাকটেরিয়া নিয়ে আরো কিছু বিজ্ঞানী কাজ করে সাফল্য পেয়েছেন। এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা সম্প্রতি ই-কোলাই নামে একধরনের ব্যাকটেরিয়ার ল্যাবরেটরিতে তৈরি সংস্করণ ব্যবহার করেছেন টেরেপথ্যালিক এসিডকে ভেঙে ভ্যানিলিন তৈরির কাজে; যা খাবারের সুগন্ধি হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এই টেরেপথ্যালিক এসিড হচ্ছে পিইটি থেকে পাওয়া একটি অণু।
এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব বায়োলজিক্যাল সায়েন্সেস-এর ড. জোয়ানা স্যাডলার বলছেন, “আমাদের পরীক্ষানিরীক্ষা এখনো প্রাথমিক স্তরে রয়েছে, এই প্রক্রিয়াটিকে আরো কার্যকর ও অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক করার জন্য আরো কাজ করতে হবে। কিন্তু এটি অত্যন্ত উত্তেজনাকর সূচনা, এবং এ প্রক্রিয়াটাকে উন্নত করার পরে ভবিষ্যতে এর বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহারযোগ্য হবার সম্ভাবনাও আছে।”
অন্যদিকে জার্মানির লাইপজিগে হেলমহোল্টৎস সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্টাল রিসার্চ-এর একটি দল আরেকটি গবেষণায় উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি ঘটিয়েছে। এই দলটি ‘সিউডোমোনাম এসপি টিডিএ-ওয়ান’ নামে এক ধরনের ব্যাকটেরিয়াকে পলিইউরিথেন ভাঙার জন্য ব্যবহার করছে। স্থানীয় একটি আবর্জনা ফেলার জায়গায় এই ব্যাকটেরিয়াটি পাওয়া গিয়েছিল।
সূত্র মতে, এই ব্যাকটেরিয়া প্লাস্টিকের কিছু অংশ খেয়ে ফেলে, আর বাকি অংশ কার্বনডাইঅক্সাইড হিসেবে বাতাসে মিশে যায়। সিউডোমোনাস তার এনজাইম ব্যবহার করে পলিইউরিথেনকে ভেঙে ফেলে। এছাড়া অন্য আরো কিছু ক্ষুদ্র অণুজীব আছে যারা প্লাস্টিক খায়।
লাইপজিগের গবেষক দলটি এই ব্যাকটেরিয়ার জিনোম বিশ্লেষণ করেছে; যাতে এসব এনজাইমের জেনেটিক গঠন বের করা যায়। এখন এসব পদ্ধতি বাণিজ্যিকভাবে লাভজনক হবে কিনা তা নিয়ে কিছু প্রশ্ন আছে।
মিশিগান স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রামানি নারায়ণ বলছেন, এগুলো খুবই আগ্রহ-উদ্দীপক গবেষণা, তবে এসব প্রযুক্তিকে বর্তমানে প্রমাণিত বাণিজ্যিক পদ্ধতিগুলোর সাথে প্রতিযোগিতা করতে হবে।
বর্তমান বাণিজ্যিক পদ্ধতিগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি এগিয়ে গেছে কারবিওস নামে একটি ফরাসী কোম্পানি। তারা জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মাধ্যমে কম্পোস্টের মধ্যে পাওয়া একটি এনজাইমের সংস্করণ তৈরি করেছে; যা পিইটি ভাঙতে পারে।
কারবিওস সম্প্রতি ল’রিয়েল এবং নেসলের মত দুটি বড় প্রতিষ্ঠানের সাথে যৌথভাবে কাজ করেছে। এরপর তারা ঘোষণা করেছে যে তারা পুনর্নবায়িত প্লাস্টিক থেকে বিশ্বে প্রথমবারের মত “ফুড-গ্রেড” পিইটি প্লাস্টিক বোতল তৈরি করেছে।
কারবিওসের ডেপুটি প্রধান নির্বাহী মার্টিন স্টেফান বলছেন, তাদের প্রযুক্তি দিয়ে যে কোন পিইটি বর্জ্য এখন যে কোন রকম পিইটি পণ্যে রিসাইকল করা সম্ভব। তবে এভাবে উৎপাদিত প্লাস্টিক বোতলের দাম পেট্রোকেমিক্যাল থেকে তৈরি বোতেলর চেয়ে দ্বিগুণ বেশি। কিন্তু তা সত্ত্বেও স্টেফান বলছেন, এই প্রযুক্তি থেকেও একসময় স্বল্প দামের বোতল তৈরি সম্ভব হবে। লাইপজিগ ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউটের এ্যানালিটিকাল কেমিস্ট্রির অধ্যাপক ড. উলফগ্যাং জিমারমান বলছেন, কারবিওসের এই প্রযুক্তি সম্ভাবনাময়।
তার মতে, পিইটি বোতল এনজাইম ব্যবহার করে রিসাইকল করা সম্ভব, তবে পিইটি বোতলের এনজাইম ঠেকানোর ক্ষমতা আছে। সেকারণে এনজাইম প্রয়োগের আগে এই বোতলকে প্রি-ট্রিটমেন্ট করে গলিয়ে ফেলতে হবে। তাতে আবার অতিরিক্ত জ্বালানি খরচ হবে। অর্থনৈতিকভাবে এবং কার্বন ফুটপ্রিন্ট কমানোর দিক থেকে এটা আমার কাছে খুব অর্থপূর্ণ মনে হচ্ছে না।
স্টেফানও স্বীকার করেন যে এনজাইম ব্যবহার করে রিসাইক্লিং করার পরিসর এখনো খুবই সীমিত। তিনি বলেন, আমরা এখন পর্যন্ত মাত্র দুটি পলিয়েস্টার রিসাইকল করার প্রযুক্তি তৈরি করেছি; যা বছরে সাড়ে সাত কোটি টন উৎপাদিত হয়। কিন্তু এর সাথে তুলনা করুন, পৃথিবীতে মোট প্লাস্টিক উৎপাদন হয় ৩৫ কোটি টন। তাই আমাদের এখনো অনেক কাজ করতে হবে।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/১৩০০
আপনার মতামত জানানঃ