বাংলাদেশে উৎপন্ন বিপুল পরিমাণ প্লাস্টিক বর্জ্যকে সড়ক নির্মাণ সামগ্রীতে রুপান্তর করার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। সড়ক ও জনপথ বিভাগ (সওজ) গত চার বছর ধরে এই উদ্যোগ বাস্তবায়ণের প্রস্তুতি নিচ্ছে এবং আগামী তিন বা চার মাসের মধ্যে এটি চূড়ান্ত ফলাফল পাওয়া যাবে বলে জানান সওজ এর অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী এবং এই উদ্যোগের সমন্বয়ক ডা. মো. আব্দুল্লাহ আল মামুন।
তিনি বলেন, “রাস্তা নির্মাণে প্লাস্টিক বর্জ্যের ব্যবহার শুধুমাত্র প্লাস্টিক বর্জ্য সমস্যার টেকসই সমাধান দেবে না, বরং এর মাধ্যমে আরও টেকসই ও সাশ্রয়ী রাস্তা নির্মাণের সুযোগ সৃষ্টি হবে।”
ডা. মো. আবদুল্লাহ আরও বলেন, “বাংলাদেশে রাস্তার স্বল্প আয়ুষ্কালের একটি বড় কারণ বৃষ্টি। তবে প্লাস্টিকের তৈরি রাস্তা ভারী বৃষ্টিতেও কম ক্ষতিগ্রস্ত হবে।”
সড়ক ও জনপথ বিভাগ বর্তমানে প্লাস্টিকের রাস্তা তৈরির নকশা নির্দিষ্টকরণ এবং স্থায়িত্ব পরীক্ষার চূড়ান্ত প্রক্রিয়ায় রয়েছে। জাতীয় ও আঞ্চলিক মহাসড়কের পাশাপাশি পাহাড়ি এলাকায় প্লাস্টিকের রাস্তার পরীক্ষামূলক নির্মাণ হবে।
সওজ বিভাগ ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন (ডিএসসিসি) এবং ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন (ডিএনসিসি) সহ স্থানীয় সরকার সংস্থাগুলোকে এই প্রক্রিয়ায় যুক্ত করা শুরু করেছে।
ডিএসসিসির প্রধান প্রকৌশলী সালেহ আহমেদ বলেন, “ডিএসসিসি ইতোমধ্যে সওজ আয়োজিত প্লাস্টিকের রাস্তা নিয়ে একটি সেমিনারে অংশ নিয়েছে। আমরা এই উদ্যোগের প্রশংসা করেছি এবং বাংলাদেশে প্রযুক্তিটি উপযোগী বা টেকসই হলে এটি নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে।”
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেন, “আমরা সবসময় সুবিধাজনক নতুন প্রযুক্তির সন্ধান করি। প্লাস্টিকের রাস্তার ধারণাটি যদি আরও ভাল মনে হয় এবং প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় সহায়তা করে, তাহলে আমরা এটি কেন প্রয়োগ করব না?”
পরীক্ষিত পদ্ধতি এবং প্রচেষ্টা
প্লাস্টিক রাস্তা কোনো নতুন ধারণা নয়।ইউরোপের অনেক দেশ ১৯৭০ সাল থেকে প্লাস্টিকের রাস্তা তৈরি করছে, প্রতিবেশী ভারতও ২০০০ সালে এই উদ্যোগ নিয়েছিল।
ভারতের তামিলনাড়ু রাজ্যের রাজধানী চেন্নাইয়ের জাম্বুলিংগাম স্ট্রিট ভারতের প্রথম প্লাস্টিকের রাস্তাগুলোর মধ্যে একটি। ভারত এ পর্যন্ত ৩৩, ৭৯৬ কিলোমিটারের প্লাস্টিকের রাস্তা তৈরি করেছে।
বাংলাদেশে বর্তমানে ২১,০০০ কিলোমিটার মহাসড়ক এবং ৩ লাখ ৫০ হাজার কিলোমিটারের বেশি স্থানীয় সড়ক রয়েছে। দেশের বেশিরভাগ প্রধান সড়ক বিটুমিন দিয়ে নির্মিত এবং সাধারণত অল্প সময়ের মধ্যেই তাতে ফাটল ও গর্ত তৈরি হয়।
সওজ এবং স্থানীয় সরকার বিভাগের কর্মকর্তাদের মতে, দেশের প্রায় ৩০% রাস্তা বর্তমানে ফাটল এবং গর্তের কারণে ব্যবহার করা কঠিন।
প্লাস্টিকের রাস্তা নির্মাণের জন্য বাংলাদেশে কতটা উপযোগী সে বিষয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আরলিংটনের ইউনিভার্সিটি অফ টেক্সাসের একটি গবেষণা দল সওজ বিভাগের সঙ্গে কাজ করছে। তারা সম্প্রতি নমুনা সংগ্রহের জন্য দেশের বিভিন্ন আবর্জনার স্তূপ পরিদর্শন করেছে।
প্লাস্টিকের রাস্তা দেশের কোন অংশে উপযোগী হবে তা নির্ধারণ করতে গবেষক দলটি বাংলাদেশের আবহাওয়ার অবস্থাও পর্যবেক্ষণ করছে।
ডা. মো. আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, “প্লাস্টিক ব্যবহার করার আমাদের মূল লক্ষ্য হল বিটুমিন ব্যবস্থার পরিবর্তন করা এবং বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এটিকে আরও টেকসই করা। যদি বিটুমিনের পরিবর্তে প্লাস্টিক ব্যবহার করা যায় তাহলে রাস্তার স্থায়িত্ব বাড়বে।”
তিনি আরও জানান, রাস্তা নির্মাণের বিভিন্ন অংশে বিভিন্ন ধরনের প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবহার করা যায় কিনা সেটিও তারা খতিয়ে দেখছেন।
বাণিজ্যিক মডেল
রাস্তা নির্মাণের মাধ্যমে বর্জ্য ব্যবস্থাপনার বাণিজ্যিক মডেল নিয়ে আলোচনার জন্য সওজ বিভাগ অচিরেই সকল স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে একটি জাতীয় সেমিনার করবে।
সওজ কর্মকর্তাদের মতে, সারাদেশে প্লাস্টিকের রাস্তা নির্মাণ শুরু করার আগে একটি টেস্ট প্রোটোকল, ডিজাইন প্রোটোকল, নির্মাণ প্রোটোকল এবং বাণিজ্যিক মডেল তৈরি করা হবে।
বিভাগটি বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশনকে (বিএসটিআই) উপাদান পরীক্ষার প্রোটোকল প্রস্তুত করতে এবং অন্যান্য সরকারি সংস্থার প্রকৌশলী ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের নকশা তৈরি করার কাজে যুক্ত করবে।
সওজ বিভাগ ইতোমধ্যেই বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশ কাউন্সিল অফ সায়েন্টিফিক অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিসার্চ (বিসিএসআইআর), পরিবেশ অধিদপ্তর এবং বিভিন্ন কর্পোরেশনের সঙ্গে একাধিক বৈঠক করেছে বলে জানিয়েছেন বিভাগটির কর্মকর্তারা।
বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক শামসুল হক বলেন, “রাস্তা পাকা করতে প্লাস্টিক কার্যকর। এটি ব্যয়বহুল হতে পারে, তবে এটি প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থপনার একটি টেকসই সমাধান দেবে।”
ওয়ার্ল্ড পপুলেশন রিভিউ অনুসারে, ২০২১ সালে বাংলাদেশ ১,০২১,৯৯০ টন প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপন্ন হয়েছে এবং ২৪,৬৪০ টন বর্জ্য সাগরে পড়েছে।
বাংলাদেশে প্লাস্টিক শিল্প
মানব সভ্যতার অগ্রযাত্রায় যেসকল আবিষ্কার মাইলফলক সৃষ্টি করেছে তাতে নতুন সংযোজন ঘটে ১৯০৭ সালে, বিজ্ঞানী লিও বেইকল্যান্ডের হাত ধরে প্লাস্টিকের এর প্রধান উপাদান ব্যাকলিট আবিষ্কারের মাধ্যমে। ষাটের দশকে বাংলাদেশে শুরু হওয়া প্লাস্টিক শিল্পের ক্রমবর্ধমান বিকাশ আগামীর বাংলাদেশকে কর্মসংস্থান ও বৈদেশিক রপ্তানি আয়ের সম্ভাবনা তৈরি করছে।
বাংলাদেশের প্লাস্টিক শিল্পের শুরু হয়েছিল ১৯৬০ সালে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের আওতায় যা পরিপূর্ণ ভাবে বিকশিত হতে থাকে ১৯৯০ এর পর থেকে। ১৯৮৯ সালে বাংলাদেশের প্লাস্টিক তৈরির কাঁচামাল পলিমার গ্রানুউল এর আমদানি ছিল প্রায় ১০০০ টন যা ২০০৭ সালে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৯৮০০০ টনে।
দেশে ও দেশের বাইরে উৎপাদিত প্লাস্টিকের বাজার ক্রমশ বর্ধমান। ইউনেস্ক্যাপ (দ্যা ইকোনমিক এন্ড সোশাল কমিশন ফর এশিয়া প্যাসিফিক )-এর এক সমীক্ষা মতে, সঠিক নীতি প্রয়োগ করা হলে বাংলাদেশের প্লাস্টিক শিল্প ২০১৫ সালের মধ্যে ২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং ২০২০ সালের মধ্যে ৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের এক বিশাল বাজারে পরিণত হবে।
দেশের জিডিপি ও কর্মসংস্থান খাতে এক অভূতপূর্ব পরিবর্তন এনেছে প্লাস্টিক পণ্যের দেশীয় ও বৈদেশিক বাজার। বাংলাদেশী প্লাস্টিকের প্রধান রপ্তানি গন্তব্য হলো চীন, যুক্তরাজ্য, ইইউভুক্ত দেশ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা সহ মধ্যপ্রাচ্যের কিছু দেশ। বাংলাদেশের জিডিপিতে প্লাস্টিক খাতের অবদান প্রায় ১ শতাংশ ।
এসডব্লিউ/এসএস/১৮০০
আপনার মতামত জানানঃ