প্লাস্টিক হলো সিনথেটিক বা সেমি-সিনথেটিক ও নিম্ন গলনাঙ্কবিশিষ্ট পদার্থ, যা তাপীয় অবস্থায় যেকোনো আকার ধারণ করতে পারে এবং পুনরায় কঠিনে রূপান্তরিত হতে পারে। প্লাস্টিক স্থায়ী, সহজলভ্য, সস্তা এবং সহজে বহনযোগ্য হওয়ায় আমরা সবাই প্লাস্টিক ও প্লাস্টিকজাত দ্রব্য ব্যবহারে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি। স্বল্পোন্নত দেশ থেকে শুরু করে উন্নয়নশীল এমনকি উন্নত দেশেও প্লাস্টিক একটি নিত্য ব্যবহার্য বস্তু। শিল্পোন্নত দেশগুলোতে বিভিন্ন পণ্য বাজারজাতকরণের জন্য প্লাস্টিক চাহিদা ব্যাপক। দিনের পর দিন প্লাস্টিকের ব্যবহার বেড়েই চলেছে।
প্লাস্টিক আমাদের দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গে এমন ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে গেছে যে আমরা উপলব্ধি করতে পারিনি প্লাস্টিক আমাদের এবং আমাদের পরিবেশের জন্য কতটা ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমরা যেসব প্লাস্টিক জাতীয় দ্রব্যাদি ব্যবহার করি, সেগুলো তৈরি হয় তেল, প্রাকৃতিক গ্যাস প্রভৃতি জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার করে। প্লাস্টিকের গামলা, বালতি, চায়ের কাপ, স্ট্র, পানির বোতল, জগ, কোমল পানীয়র পাত্র ইত্যাদি আরও অনেক ক্ষেত্রে প্লাস্টিক ব্যবহৃত হয়ে থাকে। বাংলাদেশে প্রতিবছর মাথাপিছু প্রায় পাঁচ কেজি প্লাস্টিক দ্রব্যাদি ব্যবহৃত হয়। বিশেষজ্ঞদের মতে ২০৩০ সালের মধ্যে এর পরিমাণ ৩৪ কেজিতে গিয়ে দাঁড়াতে পারে। আকার ও ওজনে সুবিধাজনক হলেও প্লাস্টিকের বোতল স্বাস্থ্য ও পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, প্লাস্টিকের পাত্রে কিছু রেখে খাওয়া ও প্লাস্টিকের বোতলে পানি পান করা ক্যানসারের কারণ হতে পারে। প্লাস্টিকের পাত্রে খাবার গরম করলেও ক্ষতিকর রাসায়নিক উপাদান বের হয়ে খাবারের মধ্যে প্রবেশ করতে পারে। ফলে অ্যাজমা, অটিজম, হরমোনজনিত সমস্যা হতে পারে। গত কয়েক শতাব্দীতে প্লাস্টিক থেকে তৈরি নানা দ্রব্য আমাদের জীবনযাপনের ধারাকে হয়তো বদলে দিয়েছে কিন্তু প্লাস্টিক পণ্যের ব্যবহার শেষে আমাদের জন্য যে বিষাক্ত হয়ে উঠছে, তা অজানা নয়।
বছরে প্লাস্টিক উৎপাদনে ব্যবহার হয় ১৭ মিলিয়ন ব্যারেল তেল। আমরা সবাই জানি যে গ্রিনহাউস প্রক্রিয়ার ফলে পৃথিবীর তাপমাত্রা বেড়ে যায়। গ্রিনহাউস গ্যাসগুলোর মধ্যে একটি হচ্ছে কার্বন ডাই-অক্সাইড। এক আউন্স পরিমাণ প্লাস্টিক বা পলিথিন প্রস্তুত করলে পাঁচ আউন্স কার্বন ডাই-অক্সাইড বায়ুতে নির্গত হয়। এক সমীক্ষায় দেখা যায়, প্রতিবছর প্লাস্টিক উৎপাদনে প্রায় ১৭ মিলিয়ন ব্যারেল তেল ব্যবহার করা হয়। এক কেজি প্লাস্টিক উৎপাদনে প্রায় দুই থেকে তিন কেজি পরিমাণ কার্বন ডাই-অক্সাইড নির্গত হয়। সুতরাং একটি প্লাস্টিক ব্যাগ তৈরি করতে প্রায় তার তিন গুণ কার্বন ডাই-অক্সাইড বায়ুতে প্রবেশ করে, যা গ্রিনহাউস প্রক্রিয়ার গ্যাসগুলোর অনুপাতে প্রভাব বিস্তার করছে।
এবার সেই প্লাস্টিক-পলিথিন থেকে তেল-গ্যাস উৎপাদনের পদ্ধতি আবিষ্কার করেছেন বলে দাবি করেছেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) রসায়ন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মাহমুদুর রহমান।
স্বল্প খরচে মাটি দিয়ে অনুঘটকের মাধ্যমে পাইরোলাইসিস পদ্ধতিতে প্লাস্টিক ও পলিথিন থেকে জ্বালানি তেল ও গ্যাস উৎপন্ন করতে সফল হয়েছেন তিনি। পরিবেশ দূষণকারী বর্জ্য প্লাস্টিককে তরল জ্বালানিতে রূপান্তরের গবেষণা প্রকল্পের অংশ হিসেবে গবেষণায় তিনি এই সাফল্য পেয়েছেন।
গবেষণা প্রকল্পের তত্ত্বাবধায়ক রসায়ন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মাহমুদুর রহমান বলেন, ‘ক্যাটালিস্ট বা অনুঘটকের মাধ্যমে পাইরোলাইসিস পদ্ধতিতে প্লাস্টিক ও পলিথিন থেকে জ্বালানি তেল ও গ্যাস উৎপন্ন হয়। প্রথমে মাটি থেকে সিলিকা অ্যালুমিনা ভেঙে ক্যাটালিস্ট তৈরি করা হয়েছে।
সেই ক্যাটালিস্ট দিয়ে প্লাস্টিককে ভেঙে ডিজেল, পেট্রল, কেরোসিন জাতীয় জ্বালানি তেল তৈরি করেছি। এই জ্বালানি তেল দিয়ে ছোট ও মাঝারি নৌকার ইঞ্জিনও চালনা করা সম্ভব। এ ছাড়া জেনারেটরের মাধ্যমে এ জ্বালানি দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের চারপাশে অনেক প্লাস্টিক বর্জ্য পড়ে থাকে। এসব পরিবেশের জন্য হুমকি এবং মাটির উর্বরতা নষ্ট করে। এই প্লাস্টিক পলিথিন ধুয়ে পরিষ্কার করে জ্বালানি উৎপাদনের উপযোগী করা সম্ভব। মাটি ও প্লাস্টিক দুটি উপাদানই আমাদের হাতের কাছে পাওয়া যায়। এতে করে খুব অল্প খরচে সরকার চাইলে জ্বালানি সংকটের এই সময়ে তেল উৎপাদন করতে পারবে।’
মাহমুদুর রহমান আরও বলেন, ‘এই জ্বালানি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যেতে পারে। কারণ জ্বালানির বেশির ভাগ অংশ ডিজেল, পেট্রল ও কেরোসিন থেকে আসে। সরকারের কাছ থেকে গবেষণার জন্য বড় আকারের তহবিল পেলে বড় আকারে উৎপাদনের জন্য একটি প্লাস্টিক রিসাইক্লিং প্ল্যান্ট স্থাপন করতে পারব।’
‘আমাদের দেশে প্রচুর পরিমাণে একক ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক-পলিথিন রয়েছে। ঢাকার বুড়িগঙ্গা নদী এবং অন্যান্য নদী ও খাল থেকে প্লাস্টিক সংগ্রহ করে তা ডিজেল, পেট্রল ও কেরোসিনে রূপান্তরিত করা যাবে। সেই সঙ্গে পরিবেশের ওপর বর্জ্যের প্রভাবও কমে যাবে।’
এই প্রকল্পের মাধ্যমে দেশে একটি বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনা যাবে বলে দাবি গবেষকদের। বর্তমানে প্লাস্টিক দূষণ একটি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই প্রকল্পের মাধমে দূষণ কাটিয়ে বর্জ্য প্লাস্টিককে জ্বালানিতে রূপান্তর করে এর সংকটও মোকাবেলা করা যাবে। এই জ্বালানিকে বাণিজ্যিকভাবেও উৎপাদন করা যাবে বলে জানান এই অধ্যাপক।
গবেষণা প্রকল্পটির ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে তিনি বলেন, ‘জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের ল্যাবে এসব পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানো হয়েছে। পরবর্তী সময়ে তহবিল বা বাজেট পেলে বড় আকারে গবেষণা করার চেষ্টা করব।’
গবেষণা প্রকল্পটি ‘ইউরোপিয়ান জার্নাল অফ ইনঅর্গানিক কেমিস্ট্রি, ওয়াইলি’ নামের একটি বিখ্যাত আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। এই গবেষণার মূল উদ্দেশ্য ছিল একক ব্যবহারের বর্জ্য পলিথিনকে জ্বালানিতে রূপান্তর করে পরিবেশ রক্ষা করা।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব অর্থায়নে এই গবেষণা প্রকল্পে বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. নাফীস আহমেদ, ড. জয়ন্ত কুমার সাহা এবং রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ড. সুব্রত চন্দ্র রায় সার্বিক সহযোগিতা করেছেন। এ ছাড়া একই বিভাগের শিক্ষার্থী মো. আরিফুল রহমান ও জুনায়েদ মাহমুদ শুভ গবেষণায় সহযোগী হিসেবে কাজ করেছেন।
এসডব্লিউ/এসএস/১৩৪০
আপনার মতামত জানানঃ
![Donate](https://statewatch.net/wp-content/uploads/2021/06/xcard.jpg.pagespeed.ic.qcUrAxHADa.jpg)
আপনার মতামত জানানঃ