পশুপাখি আমরা অনেকেই পুষি। কিন্তু জঙ্গলের পশুপাখিদের কথা কি ভাবে আমাদের এই সভ্যতা। চা বাগানে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে হাতির দল। খাবারের সন্ধানে লোকালয়ে হানা দিচ্ছে চিতা বাঘ। রাতের অন্ধকারে অজানা জন্তুর আতঙ্ক। অথবা সাপের উপদ্রব। এসব হচ্ছে কেন? কেন আচমকা বন্যপ্রাণীদের উপদ্রব এত বাড়ছে?
পরিবেশবিদরা অবশ্য এর জন্য মানুষকেই দুষছেন। বলছেন আসলে আমরাই তো ওদের ঘরে ঢুকে ওদের জীবন অতিষ্ঠ করে তুলেছি। আর আমাদেরই তার মাসুল দিতে হচ্ছে।
বর্তমানে বিশ্বে আশঙ্কাজনক হারে কমছে পোকামাকড়ের সংখ্যা। এতে মারাত্মক হুমকির মুখে পড়ছে প্রকৃতি ও পরিবেশের ভারসাম্য। কমে যাওয়ার এই হার এতটাই উচ্চ যে, চলতি শতকেই বিশ্ব থেকে উধাও হয়ে যেতে পারে সব পোকামাকড়।
এর কারণ হিসেবে জীববিজ্ঞানীরা বলছেন, এই মুহূর্তে পৃথিবী ষষ্ঠ গণবিলুপ্তির হুমকির সম্মুখীন। এরই মধ্যে অন্য বহু জীব-জন্তু-উদ্ভিদ বিলুপ্ত হয়ে গেছে। সেই সঙ্গে ভয়াবহ বিপন্নতার সম্মুখীন মানুষও।
কিন্তু মানুষের চেয়ে ১৭ গুণ বেশি ঝুঁকিতে বিভিন্ন প্রজাতির পোকামাকড়, যা প্রাণীজগতের খাদ্যচক্র, ফুল ও ফলের পরাগায়ন প্রভৃতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ। সাম্প্রতিক এক গবেষণাপত্রে উঠে এসেছে পোকামাকড়ের বিলুপ্তির ভয়াবহ এ তথ্য। খবর দ্য গার্ডিয়ান।
বিজ্ঞান সাময়িকী ‘বায়োলজিক্যাল কনজারভেশন’-এ সোমবার গবেষণা রিপোর্টটি প্রকাশিত হয়েছে। এ গবেষণা রিপোর্ট অনুযায়ী, এখন পর্যন্ত পৃথিবীতে পাঁচটি গণবিলুপ্তি হয়েছে। ৬৬০ লাখ বছর আগে শেষ গণবিলুপ্তিতে পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নিয়েছিল ডাইনোসর।
এর পরই শুরু হয় ইতিহাসের ষষ্ঠ গণবিলুপ্তি। সেই ধারা এখন অব্যাহত রয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় এরই মধ্যে আফ্রিকান রিনোর মতোর প্রাণীগুলো বিলুপ্ত হয়ে গেছে। রিপোর্টের তথ্য মতে, পোকামাকড়ের মধ্যে ৪০% প্রজাতিরও বেশি এখন বিলুপ্তির মুখে এবং এদের এক-তৃতীয়াংশই এখন বিপন্ন।
আবার পোকামাকড় বিলুপ্তির এই হার স্তন্যপায়ী, পাখি ও সরীসৃপদের তুলনায় প্রায় ৮ গুণ। অর্থাৎ অন্যান্য জলচর ও উভচর প্রাণীর চেয়েও ৮ গুণ বেশি হারে বিলুপ্ত হচ্ছে কীটপতঙ্গ। সম্প্রতি কীটপতঙ্গের সংখ্যা ব্যাপক হারে কমে যাওয়ার প্রথম খবর আসে জার্মানি ও যুক্তরাষ্ট্র শাসনাধীন পুয়ের্তো রিকো থেকে। কিন্তু গবেষণা রিপোর্ট মতে, এই সংকট প্রায় সারা বিশ্বের। গবেষণার বেশিরভাগই চালানো হয়েছে পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলো ও যুক্তরাষ্ট্রে।
এছাড়া অস্ট্রেলিয়া, চীন ও দক্ষিণ আফ্রিকাসহ কয়েকটি দেশে। গবেষণায় দেখা গেছে, কীটপতঙ্গের মধ্যে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে মৌমাছি। ১৯৪৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রে ৬০ লাখের মতো মৌ কলোনি ছিল। কিন্তু বর্তমানে তা অর্ধেকে নেমে এসে ৩৫ লাখে দাঁড়িয়েছে।
এছাড়া আরও অন্তত সাড়ে তিন লাখ প্রজাতি পোকামাকড়ের রিপোর্টে বলা হয়েছে, বিলুপ্তির প্রধান কারণ কৃষি। বিশেষ করে কৃষিতে কীটনাশকের বেশি ব্যবহার।
গবেষণা রিপোর্টের অন্যতম লেখক অস্ট্রেলিয়ার সিডনি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ফ্রান্সিসকো সানচেজ বায়ো বলছেন, ‘কীটপতঙ্গের এই হারিয়ে যাওয়া যদি না থামানো যায়, তাহলে যেমনিভাবে পৃথিবীর প্রকৃতি ও পরিবেশ ব্যবস্থার এর মারাত্মক প্রভাব পড়বে, তেমনিভাবে প্রভাব ফেলবে মানুষের বেঁচে থাকার ওপরও।’
সানচেজ জানান, গত ২৫-৩০ বছরে প্রতি বছর ২.৫% হারে পোকামাকড় কমে গেছে। এটা খুবই মর্মান্তিক যে, আগামী ১০ বছরেই ২৫% পোকামাকড় থাকবে না।
বন্যপ্রাণ, ওয়াইল্ড লাইফ। গালভরা শব্দগুলো খাতায় কলমে যতটা কার্যকর বাস্তবেও কী ততটাই কার্যকর? আজকাল বড্ড উঠছে প্রশ্নটা। খাদ্য খাদক সম্পর্ক, বাস্তুতন্ত্র অথবা পরিবেশরক্ষা, এই শব্দগুলো ভূগোলের বইয়ে অথবা সরকারি প্রকল্পে যুগ যুগ ধরে রয়েছে। আর সবকিছুর বারোটা বাজিয়ে দেয়া মানুষ মাঝে মাঝে টের পাচ্ছে আধুনিক সভ্যতার রেজাল্টটা।
ওয়ার্ল্ড ওয়াইল্ড ফান্ডের পরিসংখ্যান বলছে, সভ্যতার শুরু থেকে এখনও পর্যন্ত পৃথিবারী ৮৩% স্তন্যপায়ী এবং ৫০% উদ্ভিদ ধ্বংস করে ফেলেছে মানুষ। প্রায় ৩০০ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণীকে স্রেফ খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে পৃথিবী থেকে মুছে দিয়েছি আমরা।
১৯৭০ সালে সারা পৃথিবীতে যত স্তন্যপায়ী, পাখি, সরীসৃপ ও মাছ ছিল, আজকের দিনে ৬০ ভাগই পৃথিবী থেকে হারিয়ে গেছে কেবল মাত্র মানুষের জন্য।
সভ্যতা আধুনিক থেকে আরও আধুনিক হচ্ছে। জনবসতি বেড়েই চলেছে। সঙ্গে চোরাকারবারীদের চক্র। জঙ্গল কমছে। আজ জঙ্গলের অধিবাসীরা? সুন্দরবনে একশো বাঘের খবরে যতটা না উৎসাহ, তার চেয়ে বেশি উদ্বেগও। জঙ্গল তো কমছে। বাঘেরা থাকবে কোথায়?
সুন্দরবন, যা কিনা পরিবেশের ফুসফুস, সেই সুন্দরবনের কোর এরিয়ার জঙ্গলও নাকি সাফ হয়ে যাচ্ছে। খাদ্যের অভাবে বাঘেরা হানা দিচ্ছে লোকালয়ে, বাঘ ও মানুষের লড়াইয়ে মানুষই জিতছে, আসলে মানুষ হারছে। বন্যপ্রাণ রক্ষা না করতে পারলে সভ্যতাও যে বিপন্ন, কে বুঝছে সেটা! এমনটাই মত ব্যাঘ্রপ্রাণ বিশেষজ্ঞ জয়দেব কুন্ডুর।
মানব সভ্যতার শুরু থেকে আজ পর্যন্ত যত প্রাণী হারিয়ে গিয়েছে, তারা আর ফিরে আসবে না। বন্যপ্রাণ আর প্রকৃতির যে ধ্বংসলীলা চলছে, তাতে মানব সভ্যতারও শেষের শুরু…বলছেন পরিবেশবিদরাই।
এসডব্লিউএসএস/১৬১০
আপনার মতামত জানানঃ