মনজুরুল হক
রাশিয়া থেকে ক্রুড অয়েল কিনতে যাচ্ছে সরকার। দেরিতে হলেও ভালো উদ্যোগ। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তেল কেনা শুরু হবে এমন নিশ্চয়তা এখন পর্যন্ত নেই। একনেক-এর সভায় সরকারপ্রধান গ্রীণ সিগনাল দেওয়ার পর অন্তত হাফ ডজন টেকনিক্যাল বাধা এসেছে। তার চেয়ে বড় কথা, এইসব বাধা অতিক্রম করে ‘কিনব কীনা’ এমন কথাও উঠেছে। পেছনের কারণ বুঝতে অসুবিধা হয় না। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘বর্তমান পরিস্থিতিতে ভারত এবং অন্যান্য রাষ্ট্র রাশিয়ার কাছ থেকে সরাসরি তেল কিনছে; তাহলে আমরা কিনতে পারি কি না সেটা দেখতে হবে। এর জন্য রাশিয়ার সঙ্গে কথা বলে উপায় খুঁজে বের করতে হবে।‘ এই যে ‘উপায় খুঁজে বের করতে’ বলেছেন, সেখানে ‘আমেরিকান লবির বিশেষজ্ঞরা’ একের পর এক প্রশ্ন তুলে ধরেছেন! রাশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি আছে, কীভাবে পেমেন্ট হবে? ডলারে পেমেন্ট নেবে না, সোয়াপ-এ পেমেন্ট হবে, রুবলে পেমেন্ট দেওয়া যাবে না, আমেরিকা বাগড়া দেবে কীনা, দিলে সেটার ক্ষতি সামলে তেলে লাভ হবে কীনা, বাংলাদেশে ৮০ ভাগ পরিশোধিত তেল কেনে, সেখানে অপরিশোধিত তেল কিনে ভারত থেকে পরিশোধন করে কতটুকু লাভ হবে? এরকম নেগেটিভ বিবৃতি।
এদের কথাবার্তায় মনে হচ্ছে রাশিয়া যেন ‘কন্যা দায়গ্রস্থ পিতা’! এনারা কন্যার পাণিগ্রহণ করে রাশিয়াকে ‘দায়মুক্ত’ করছে! কেন বলছি? প্রতিমন্ত্রীর ভাষ্য দেখুন—‘প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ গত মে মাসে জানিয়েছিলেন, বাংলাদেশে অপরিশোধিত জ্বালানি তেল বিক্রির প্রস্তাব দিয়েছে রশিয়া। তবে রাশিয়ার তেল বাংলাদেশের রিফাইনারিতে ‘পরিশোধনযোগ্য নয়’ জানিয়ে ওই প্রস্তাব এড়িয়ে যাওয়ার ইংগিত সে সময় দিয়েছিলেন তিনি।‘ তার মানে রাশিয়া ‘প্রস্তাব দিয়েছে’! ব্যাপারটা কি এমন যে ‘আমাদের দরকার নেই’?
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ‘রাশিয়া থেকে তেল আমদানির বিল পরিশোধ করা কোনো সমস্যা নয়, সমস্যা হচ্ছে আমরা রাশিয়া থেকে তেল আমদানি করব কি না? এটা একটা রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের বিষয়। রাশিয়া থেকে তেল কিনলে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন যদি বিরাগভাজন হয়, তাহলে এই পথে যাওয়া ঠিক হবে না।
বিশেষজ্ঞদের শঙ্কা, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন অখুশি হলে এই দুই বড় বাজারে বাংলাদেশের ৩৫ বিলিয়ন ডলারের রপ্তানি হুমকিতে পড়তে পারে। বিশেষ করে তারা বাংলাদেশ থেকে পোশাক রপ্তানি না করলে বা কমিয়ে দিলে দেশ বড় ধরনের সংকটের মুখে পড়বে।‘
এইসব বিশেষজ্ঞদের জবানে কার প্রতিধ্বণি বোঝা কষ্টকর নয়। এখন প্রশ্ন হচ্ছে যেখানে সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে ‘উপায় খুঁজে বের করতে’ বলা হচ্ছে, সেখানে তারা কেন একের পর এক নেগেটিভিটি শো করছেন?
প্রধানমন্ত্রীর ওই নির্দেশের পর এ ব্যাপারে কাজ শুরু করেছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। গতকাল পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেন সাংবাদিকদের জানান; ‘আজকে নির্দেশনা এসেছে। আমরা অন্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সমন্ব্বয় করে যে সম্ভাব্যতা আছে, সেগুলো অবশ্যই অনুসন্ধান করব। ’
যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন অখুশি হবে, এবং এই দুই বড় বাজারে বাংলাদেশের ৩৫ বিলিয়ন ডলারের রপ্তানি হুমকিতেও পড়তে পারে। তারা পোশাক রপ্তানি না করলে বা কমিয়ে দিলে দেশ বড় ধরনের সংকটের মুখে পড়বে। এই হুমকিটা তারা ভারতকেও দিয়েছিল, কিন্তু সুবিধা করতে পারেনি। ভারত সব শুনেটুনে নিজের সিদ্ধান্তে অনড় ছিল।
রাশিয়া থেকে ভারতের তেল আমদানি প্রসঙ্গে পররাষ্ট্রসচিব বলেন, ‘ভারতের সক্ষমতা আছে রাশিয়ার অপরিশোধিত তেল পরিশোধন করার, সেই সক্ষমতা যদি আমরা করে নিতে পারি, তাহলে অবশ্যই আমরা আনতে পারব। তবে সেটি হয়তো সময়সাপেক্ষ। ’ ভারত থেকে তৃতীয় দেশ হিসেবে রাশিয়ার তেল আমদানির সুযোগ আছে কি না, জানতে চাইলে সচিব বলেন, ‘আমাদের মন্ত্রণালয়ের (পররাষ্ট্র) পক্ষ থেকে ভারতের সঙ্গে এটি বলা হয়নি। জ্বালানি মন্ত্রণালয় বলেছে কি না, আমি জানি না। ’
এবার ধরে নিতেই হচ্ছে ডিলটা হচ্ছে না। এই ডিলের সঙ্গে ‘যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন যদি বিরাগভাজন হয়’ লাইনটি জুড়ে দেওয়া হয় তাহলে রাশিয়া নিশ্চয়ই হাসতে হাসতে ডিলে স্বাক্ষর করবে না।
অর্থাৎ এখানে আমেরিকার লবির স্টেকহোল্ডাররা যথেষ্ট এক্টিভ। আর সে কারণেই বিনিময় মুদ্রা এবং ডেফার্ড সুযোগ দেবে কিনা সে সব বিবেচনায় তেল কেনার প্রস্তাবনা ভেস্তে যেতে পারে। ৫৪ বছর ধরে তেল পরিশোধনের নতুন কোনো রিফাইনারি তৈরি না করার পেছনেও যে পরিশোধিত তেল কিনে মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় করার টেনডেনসি আছে সেটা পরিষ্কার। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এইসব অথর্ব লোকজন দিয়ে আর যা-ই হোক কল্যাণকর কিছু হবে না। প্রথমে এরা রাশিয়ার তেল কেনার কথা মুখেও আনত না। যখন দেখল ভারত-চীন সস্তায় তেল কিনে সেই তেল আবার অন্য দেশে রপ্তানিও করছে, যখন মুসলিম উম্মাহর ‘পরীক্ষিত বন্ধু’ সৌদি আরব কম দামে তেল দিতে অপারগতা জানাল, যখন ডিজেলের অভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন কমিয়ে দেশের অর্থনীতির কোমর ভেঙে দেওয়া হলো, যখন ২০/২৫ দিনের বেশি জ্বালানি তেলে মজুদ রাখা যাচ্ছে না, তখন বাধ্য হয়ে ‘রাশিয়ার তেল কেনার উপায় খুঁজতে’ নেমেছে।
জানা কথা; যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন অখুশি হবে, এবং এই দুই বড় বাজারে বাংলাদেশের ৩৫ বিলিয়ন ডলারের রপ্তানি হুমকিতেও পড়তে পারে। তারা পোশাক রপ্তানি না করলে বা কমিয়ে দিলে দেশ বড় ধরনের সংকটের মুখে পড়বে। এই হুমকিটা তারা ভারতকেও দিয়েছিল, কিন্তু সুবিধা করতে পারেনি। ভারত সব শুনেটুনে নিজের সিদ্ধান্তে অনড় ছিল। বাংলাদেশের সেই গার্টস নেই। নিজেদের দুর্বলতাগুলো যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের ড্রয়ারে থরে থরে সাজানো। আর সেই ভয় থেকেই হয়ত শেষ পর্যন্ত ‘রাশিয়ার তেল কেনার উপায় খুঁজে পাওয়া যাবে না’। তাহলে ‘অক্টোবর মাস থেকে আর লোডশেডিং হবে না’ কথাটার বিশ্বাযোগ্যতা কোথায়? ‘অচিরেই তেলের দাম সমন্বয় করা হবে’ আশ্বাসের ভিত্তি কী? ‘দ্রব্যমূল্য কমে জনজীবনে স্বস্তি আনবে’ প্রতিশ্রুতিরই বা ভিত্তি কী? দুই নৌকায় পা দিলে বিপদে পড়তে হয়। বাংলাদেশের পা এখন তিন নৌকায়। তাদেরকে বিপদ থেকে কে বাঁচাবে?
মনজুরুল হক, ১৮ আগস্ট, ২২
আপনার মতামত জানানঃ