মনজুরুল হক
সাবধান! ন্যাটো জোট ছুঁতো খুঁজছে
সুইডেন ও ফিনল্যান্ডের ন্যাটো জোটে যোগ দেওয়া নিয়ে যে ধোঁয়াসা ছিল তা কেটে গেছে। তুরস্ক তার আপত্তি তুলে নিয়েছে। আমরা আগেই জেনেছি এই দুটো দেশের ন্যাটো জোটে যোগ দেওয়া নিয়ে রাশিয়ার আপত্তি থাকলেও সেটা ইউক্রেনের পরিস্থিতির মত নয়। ফিনল্যান্ড এক সময় রুশ সাম্রাজ্যের অংশ ছিল। সে সুবাদে হোক আর একই রকম ভাষাভাষী কিংবা সংস্কৃতিগতভাবে নৈকট্য হোক, রাশিয়া-ফিনল্যান্ড দুটি দেশ দীর্ঘদিন ধরেই বন্ধু ভাবাপন্ন। আরও নির্দিষ্ট করে বললে—ফিনল্যান্ডের জাতীয় অর্থনীতির প্রায় অর্ধেকটা রাশিয়ার উপর নির্ভরশীল। তার পরও রাশিয়া ফিনল্যান্ডের ন্যাটো জোটে যোগ দেওয়া নিয়ে কোনো শর্তারোপ করেনি। শুধু আশা ব্যক্ত করে রেখেছিল; ‘ফিনল্যান্ড নিশ্চয়ই রাশিয়ার সীমান্তে মিসাইল বসিয়ে যুদ্ধ পরিস্থিতি সৃষ্টি করবে না’।
কিন্তু না, রাশিয়া জেশ্চার হিসাবে যা-ই ভাবুক ন্যাটো বসদের ভাবনা ভিন্ন। তারা ফিনল্যান্ডকে অফিসিয়ালি ন্যাটো মেম্বার করার আগেই তাদের গোপন দুরভিসন্ধি লুকোতে পারল না। স্পেনের সম্মেলনে কোনো কিছু চূড়ান্ত হওয়ার আগেই রাশিয়ার সীমান্তের কাছেই ন্যাটো সামরিক ঘাঁটি বসানোর তোড়জোড় শুরু করে দিয়েছে। রাশিয়ার সীমান্ত ঘেষা ছোট ফিনিশ শহর লাপেনরান্টার মেয়র তার শহরে ন্যাটো সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করতে চলেছে। ৪ জুলাই রাশিয়ান স্টেট ডুমার স্পিকার ভ্যাচেস্লাভ ভোলোদিন এই সংবাদ জেনে ফিনল্যান্ড সতর্ক করেছেন।
ভোলোডিন হতাশ হয়ে বলেছেন—‘আমরা আশা করেছিলাম ফিনল্যান্ড ন্যাটো জোটে যোগ দেওয়ার পরও আমাদের মধ্যে সুসম্পর্ক থাকবে, ব্যবসা-বাণিজ্য অব্যহত থাকবে, কিন্তু লাপেনরান্টায় ন্যাটো সামরিক ঘাঁটি করে তারা হতাশ করেছে।
ফিনিশ মিডিয়া ‘ইলে জার্ভা’র খবর অনুযায়ী ন্যাটোতে আনুষ্ঠানিক যোগদান দক্ষিণ কারেলিয়া অঞ্চলের জনগণ এবং ব্যবসার জন্য ‘নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে’ রাশিয়ান ডুমা স্পিকার বলেছেন—‘ মেয়র কীভাবে এমন নিরাপত্তার কথা ভাবেন, যেখানে দুই দেশের মধ্যে সংঘর্ষ শুরু হলে প্রথমেই সামরিক অবকাঠামো লক্ষ্যবস্তু করা হবে? ন্যাটো ঘাঁটি ফিনল্যান্ড বা সুইডেনকে রক্ষা করবে না। বরং এইসব সামরিক ঘাঁটি শহরগুলোর বাসিন্দাদের আক্রমণের মুখে ঠেলে দেবে। প্রায় ৭০ হাজার জনসংখ্যার লাপেনরান্টা রাশিয়ান সীমান্ত থেকে মাত্র ২০ কিলোমিটার দূরে।
এ থেকে আবারও প্রমাণ হলো মার্কিন নেতৃত্বাধীন ন্যাটো জোট ছুঁতো খুঁজছে। যে কোনোভাবে রাশিয়া একবার ন্যাটোভুক্ত কোনো দেশে যেন হামলা করে….।
রাশিয়ার স্পেশাল অপারেশনের লেটেস্ট ডেভেলপমেন্ট
ইউক্রেনীয় বাহিনীর শেষ রেজিমেন্ট লুগানস্ক পিপলস রিপাবলিক থেকে বিতাড়িত হয়েছে। খবর জানিয়েছে রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রী সের্গেই শোইগু। তিনি খবরটি প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকেও জানিয়েছেন। রাশিয়ান সৈন্য এবং ডনবাস বাহিনী লিসিচানস্ককে সম্পূর্ণ দখলে নিয়েছে যেটি লুগানস্কের শেষ বড় শহর যা ২০১৪ সাল থেকে ইউক্রেনের নিয়ন্ত্রণে ছিল। রাশিয়া এই সপ্তাহের শুরুতে লিসিচানস্কের আশেপাশে ভারী লড়াইয়ের খবর দিয়েছিল। শহরের তেল শোধনাগারে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর যুদ্ধ হয়েছে। গত সপ্তাহে সেভারস্কি ডোনেটস নদীর বিপরীতে অবস্থিত শহর সেভেরোডোনেটস্ক থেকে ইউক্রেনীয় সেনারা পিছু হটার পর লিসিচানস্কের দখলের খবর আসে। সেভেরোডোনেটস্ক দখলে জন্য রাশিয়ান ট্রুপস ও লুগানস্ক মিলিশিয়ারা কয়েক মাস ধরে লড়াই জারি রেখেছিল। এখন বাকি রইল ডনেৎস্ক-এর ছুটছাঁট এলাকাগুলো দখলে নেয়ার। এরই মধ্যে ‘ক্লাউন নিধিরাম সর্দার’ জেলেনস্কি হুংকার দিয়েছেন—‘খুব শিগগিরই লুগানস্ক পুর্নদখল করবে ইউক্রেন বাহিনী (কার্যত যারা এখন ওয়ার ফিল্ড ছেড়ে পালাতে পারলে বাঁচে, কারণ চেইন অব কমান্ড পুরোটাই ভেঙে পড়েছে)।
ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া ইউক্রেনে ‘স্পেশাল মিলিটারি অপারেশন’ শুরু করার পর গত সপ্তাহেই প্রথম রাশিয়ার প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইউক্রেনের যুদ্ধাঞ্চল সফর করেছেন। সফর শেষ করেই প্রতিরক্ষামন্ত্রী সের্গেই শোইগু ৪ জুলাই প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের কাছে রিপোর্ট করেছেন। রিপোর্টের বলা হয়েছে—গত দুই সপ্তাহে ইউক্রেন প্রায় ৫ হাজার ৫শ সৈন্য হারিয়েছে, যার মধ্যে ২ হাজার জনেরও বেশি নিহত হয়েছে। মন্ত্রী রাশিয়ান নেতার কাছে তার দ্বিতীয় প্রতিবেদনটি জমা দিলেন বহু দিন পর। তিনি নিশ্চিত করেছেন যে রাশিয়ান এবং মিত্র বাহিনী লিসিচানস্ক শহর দখলের পরে লুগানস্ক পিপলস রিপাবলিকের সরকার যে অঞ্চলটিকে নিজের বলে দাবি করে রাশিয়া তার সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে। ব্যক্তিগতভাবে দেওয়া রিপোর্টটিতে অপারেশনের খুটিনাটি বিভিন্ন দিক তুলে ধরা হয়েছে।
শোইগুর ভাষ্য মতে গত দুই সপ্তাহে ইউক্রেনের সেনাদের ৫ হাজার ৪শ ৬৯ জন নিহত হয়েছে এবং ২ হাজার ২শ ১৮জন আহত। যুদ্ধে কিয়েভের ব্যাপক পরিমাণ আর্ম-উইপনসও ধ্বংস হয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে ১২টি যুদ্ধবিমান, ছয়টি দূরপাল্লার বিমান প্রতিরক্ষা ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা, ৯৭টি রকেট আর্টিলারি লঞ্চার এবং প্রায় ২শ টি ট্যাঙ্ক এবং অন্যান্য ইক্যুইপমেন্টস। ইউক্রেনীয় সেনারা লিসিচানস্কে ছেড়ে যাওয়ার সময় প্রায় ৮০টি গাড়ি সহ কিছু অস্ত্রও ফেলে গেছে।
এর আগে ইউক্রেন প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কিসহ ইউক্রেনের কর্মকর্তারা ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির কথা জানিয়েছিলেন। তাদের প্রতিদিন গড়ে ২শ জন নিহত হচ্ছে বলে দাবি করে পশ্চিমা দেশগুলোকে ইউক্রেনে প্রতিশ্রুত সামরিক সহায়তার গতি ত্বরান্বিত করার আহ্বান জানিয়েছিলেন। ইউক্রেনের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট পেত্রো পোরেশেঙ্কো গত মাসে জার্মান টিভি DW’র কাছে হাত-পা নেড়ে-চেড়ে রাশিয়াকে ব্যঙ্গ করে বয়ান করেছিলেন—সো কল্ড সেকেন্ড পাওয়ারফুল মিলিটারি নাকি ৩ দিনে ইউক্রেন দখল করে নেবে? কই পারল? গেল তো চুপসে…। আমাদের এখন তিনটি জিনিস দরকার—প্রথমত: উইপনস। দ্বিতীয়ত: উইপনস। এবং তৃতীয়ত: উইপনস। সে সময় তার একবারও মনে হয়নি শুধু উইপনস থাকলেই যুদ্ধে জেতা যায় না, সেসব চালানোর জন্য যোগ্য লোকবল দরকার এবং দুর্বল চাঁদমারি দরকার। আনফরচ্যুনেটলি এই মুহূর্তে এর কোনোটাই ইউক্রেনের নেই।
ল্যান্ডস্লাইড ডেভেলপমেন্ট
আমরা আগেই জেনেছি; রাশিয়া তিনটি উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে ইউক্রেনে ‘স্পেশাল মিলিটারি অপারেশন’ পরিচালনা করছে; ইউক্রেনের ডি-নাৎসিফিকেশন, ডি-মিলিটারাইজেশন এবং ডনবাস অঞ্চলের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ। এই তিনটি উদ্দেশ্য হাসিল করতে গিয়ে সবচেয়ে বড় যে ঘটনাটি ঘটেছে সেটাই বিশ্বের কাছে গত ৩৩ বছরের মধ্যে প্রথম বার অনুভূত হচ্ছে… Russia has made a decisive break with the West and is ready to help shape a new world order.
রাশিয়ার ইন্টারন্যাশনাল এ্যাফেয়ারস কাউন্সিল সদস্য দিমিত্রি ট্রেনিন। তিনি এক দীর্ঘ রিপোর্টে রাশিয়ার এই ‘Decisive break’ এর খুঁটিনাটি বিবৃত করেছেন। এখানে তার সংক্ষিপ্ত কিছু বর্ণনা:
“রাশিয়া পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে একটি তাৎপর্যপূর্ণ ভারসাম্য সৃষ্টি করেছে, এবং একটি নতুন বিশ্ব ব্যবস্থা গঠনের বাস্তবতা মেলে ধরেছে। এটি এখন বিশ্বাস করা সম্ভবত কঠিন কিন্তু – মাত্র আট বছর আগে রাশিয়া প্রাক্তন G8 এর পূর্ণ সদস্য ছিল। তারপর থেকে নাটকীয় পরিবর্তন ঘটেছে।
গত সপ্তাহে বাভারিয়ার এলমাউ ক্যাসেলে G7 নেতাদের মিলিত হওয়ার ঠিক আগে, ব্রিকস-এর ৫টি দেশের প্রতিনিধিরা চীনা প্রেসিডেন্টের সভাপতিত্বে একটি অনলাইন শীর্ষ সম্মেলন করে। G7 বৈঠকে প্রকাশ্যে রাশিয়াকে একটি ‘প্রচ্ছন্ন হুমকি’ হিসাবে সাব্যস্ত করা হয়েছিল, যদিও পরে সে আলোচনা শীর্ষ নেতাদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল।
অনেক দিন গত হয়েছে যখন মস্কো পশ্চিম এবং অ-পশ্চিমের মধ্যেকার বিভাজনরেখা হিসাবে ছিল। ২০১৪ সালে ইউক্রেন সংকটের পর G8 ভেঙে আগের G7 ফর্ম্যাটে ফিরে আসে; গত ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক অভিযানের পরিপ্রেক্ষিতে রুশ-পশ্চিম সংঘর্ষ একটি ফুলস্কেল ‘হাইব্রিড যুদ্ধ’-এ পরিণত হয়। যদিও এখন পর্যন্ত এটি প্রক্সি ওয়ার।
স্নায়ুযুদ্ধের অবসানের পরে, নতুন পশ্চিমের বন্ধু হওয়ার আহ্বানের পরও তা না হয়ে বরং পুরোনো শত্রুতা বেড়ে যাওয়ার পর রাশিয়া এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা এবং ল্যাটিন আমেরিকার সাথে তার সম্পর্ক উন্নয়নে মনোনিবেশ করে। এটি প্রয়োজনীয় হলেও কঠিন কাজ। প্রথমত: অতীত ইতিহাস অনুযায়ী বেশ জড়তা আছে। অন্তত পিটার দ্য গ্রেটের দিন থেকে। রাশিয়ান এলিট সোসাইটি পশ্চিমের দিকে তাকিয়ে থাকে। তাদের চেহারা এবং আচরণে পশ্চিমা প্যাশনও দেখা যায় (যদিও পোশাক এবং শিষ্টাচারের ভেতরকার শরীরটা রাশিয়ান)। তাদের কৌশল ছিল পশ্চিমা প্রতিষ্ঠানগুলোর সাথে খাপ খাইয়ে নেওয়া, চিন্তা-চেতনায় পশ্চিমা ভাবধারা চালু করা (যেমনটা মার্কসবাদের মতো সৃজনশীলভাবে প্রয়োগ হয়েছিল), মহান ইউরোপীয় শক্তি হতে চাওয়া, এবং এভাবেই এক সময় সোভিয়েত আমলের মত একটি বিশ্ব পরাশক্তি হয়ে ওঠা যারা লিসবন থেকে ভ্লাদিভোস্টক পর্যন্ত বৃহত্তর ইউরোপের একটি মূল চালিকা শক্তি হয়ে উঠবে।
এরই মধ্যে প্রথমবারের মতো রাশিয়া উত্তর আমেরিকা, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং ব্রিটেন থেকে শুরু করে জাপান এবং অস্ট্রেলিয়া পর্যন্ত একটি ঐক্যবদ্ধ পশ্চিমা বিশ্বশক্তির মুখোমুখি হয়েছে। এমনকি পশ্চিমে কোনো একটি মিত্র নেই যার দিকে মস্কো যেতে পারে – এমনকি ফিনল্যান্ড, সুইডেন, অস্ট্রিয়া এবং সুইজারল্যান্ডের মতো সাধারণভাবে নিরপেক্ষ রাষ্ট্রগুলোও তাদের নিরপেক্ষতা হারিয়েছে। পশ্চিমের সাথে রাশিয়ার রাজনৈতিক বিচ্ছেদ এইভাবে সম্পূর্ণ হয়েছে, এবং তাদের মধ্যে ছিঁটেফোটা সম্পর্কও নেই। এই বাস্তবতায় ‘হাইব্রিড যুদ্ধ’ই নিয়ামক হতে পারে, যা শেষ হতে কয়েক দশক না হোক, কয়েক বছর তো লাগবে
দ্বিতীয়ত: মস্কোর অর্থনৈতিক সম্পর্ক মূলত পশ্চিমের সাথে তৈরি হয়েছে। ঐতিহাসিকভাবে রাশিয়া পশ্চিম ইউরোপীয় শিল্পের জন্য আদর্শ সম্পদ ভাণ্ডার ছিল। বলা যেতে পারে ইউরোপ মহাদেশের ‘খাদ্য ভাণ্ডার’, এবং শিল্প পণ্য এবং প্রযুক্তির প্রধান আমদানিকারক।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইইউ এবং ব্রিটেনের রাশিয়ার উপর আরোপিত কঠোর স্যাঙ্কশনগুলো ইউক্রেনে যুদ্ধ বন্ধ হয়ে গেলেও প্রত্যাহার করা হবে না এবং রাশিয়ার বৈদেশিক মুদ্রা এবং সম্পদ বাজেয়াপ্ত করার তিক্ত অভিজ্ঞতা ভবিষ্যতে অর্থনৈতিক সম্পর্কের ওপর বিশাল ছাপ রেখে যাবে।
তৃতীয়ত: সাংস্কৃতিক পরিপ্রেক্ষিতে রাশিয়ানরা ঐতিহ্যগতভাবে নিজেদেরকে ইউরোপের বাকি অংশ থেকে আলাদা ভাবে না।খ্রিস্টধর্ম; প্রাচীন গ্রীস এবং রোমের উত্তরাধিকার; ফরাসি রেঁনেসাঁ এবং জার্মান দর্শন; ইউরোপীয় সাহিত্য এবং শিল্পকলা, সঙ্গীত এবং নৃত্য – এই সমস্তই রাশিয়ার নিজস্ব সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করতে সাহায্য করেছে, সাম্প্রতিক রাজনৈতিক ফাটল এবং ভূ-অর্থনৈতিক পরিবর্তন সত্ত্বেও, রাশিয়ান সংস্কৃতির ভিত্তি অবশ্যই ইউরোপীয়ই রয়ে গেছে।
স্নায়ুযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর থেকে এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা এবং লাতিন আমেরিকার নেতৃস্থানীয় দেশগুলোর সঙ্গে রাশিয়ার অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, প্রযুক্তিগত এবং সামরিকভাবে সব ক্ষেত্রেই যোগাযোগ উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। এমনকি ‘হাইব্রিড যুদ্ধ’ শুরু হওয়ার আগে চীন কেবল রাশিয়ার প্রধান বাণিজ্য অংশীদার হিসাবেই নয়, রাশিয়ার যন্ত্রপাতি ও সামরিক সরঞ্জামের শীর্ষ আমদানিকারক। ভারত সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং রাশিয়ান অস্ত্রের পুরোনো ঐতিহ্যগত আমদানিকারক যারা এখন মস্কোর প্রধান প্রযুক্তি অংশীদার হিসাবে আবির্ভূত হচ্ছে৷ সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত OPEC তেল উৎপাদন নিয়ন্ত্রণে রাশিয়ার প্রধান অংশীদার। তুরস্ক এবং ইরান একটি গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত অঞ্চলে প্রধান স্বাধীন ‘খেলোয়াড়’। ইউক্রেন ঘটনায় অ-পশ্চিমা দেশগুলোর সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ রাশিয়াকে নিন্দা করতে অস্বীকার করেছে – তাদের মধ্যে অনেকগুলো আবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কঠোর চাপ সত্ত্বেও যেমন ভারত। যা মস্কোর জন্য উৎসাহজনক। এই দেশগুলো আমাদের বিরুদ্ধে নয় বরং আমাদের সাথে রয়েছে বলে বিবেচিত হতে পারে। এ ছাড়াও ইন্দোনেশিয়া, আর্জেন্টিনার মত আগ্রহী দেশ রয়েছে যাদেরকে মস্কো জড়িত করতে চাইছে। এটা করার জন্য রাশিয়ার পররাষ্ট্রনীতিতে খানিকটা কৌশলগত পরিবর্তন আনতে হবে। এবং এই ‘নতুন বিশ্বব্যস্থাই’ G7 তথা মার্কিন নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা জোটগুলোকে চ্যালেঞ্জ জানাবে।
অবশেষে ন্যাটোর ‘থলের বেড়াল’ বেরিয়ে পড়েছে!
ন্যাটো বস জেনস স্টলটেনবার্গ নিজেই ‘বেড়ালটিকে’ থলে থেকে বের করেছেন। ১৫ জুন ব্রাসেলসে ন্যাটো সদর দফতরে এক মিডিয়া সম্মেলনে ন্যাটো মহাসচিব জেনস স্টলটেনবার্গ বলেন— ‘মার্কিন নেতৃত্বাধীন ব্লক রাশিয়ার সাথে প্রক্সি ওয়ারের জন্য ইউক্রেনকে ব্যবহার করবে বলে ২০১৪ সাল থেকে প্রস্তুতি নিচ্ছে’! সন্দেহ নেই ন্যাটো সেক্রেটারি জেনারেল জেনস স্টলটেনবার্গের কথাগুলো ইউক্রেনে মস্কোর সামরিক অভিযানের যৌক্তিকতাকে প্রমাণ করেছে।
জেনস স্টলটেনবার্গ এই হিডেন অভিলাশটি বেশ উচ্চস্বরেই সাংবাদিকদের কাছে প্রকাশ করেছিলেন যে তারা ২০১৪ সাল থেকে পূর্ব ইউরোপে ন্যাটোর যুদ্ধ পরিকল্পনায় অস্ত্রশস্ত্র মজুদ, ঘাঁটি নির্মাণ, সামরিক ট্রেনিং সেন্টারগুলো বিশেষভাবে রাশিয়ার কথা মাথায় রেখেই করা হয়েছিল। তিনি আরও বলেন—‘বাস্তবতা হল আমরা ২০১৪ সাল থেকে এর জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি, এই কারণেই আমরা জোটের পূর্ব অংশে আমাদের উপস্থিতি বাড়িয়েছি। কেন ন্যাটো মিত্ররা প্রতিরক্ষা খাতে আরও বেশি বিনিয়োগ করতে শুরু করেছে এবং কেন আমরা প্রস্তুতি বাড়িয়েছি? কারণ রাশিয়া ২০১৪ সাল থেকে পূর্ব ডনবাসে শক্তি প্রয়োগ করছে’।যদিও তিনি এ কথা উল্লেখ করতে ভুলে গেছেন যে, ২৪ ফেব্রুয়ারী ২০১৩ সালে কিয়েভে ‘ইউরোমাইডান’ কেন্দ্র করে বেসামরিক সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ার জন্য পশ্চিমা শক্তিগুলোর প্রত্যক্ষ ভূমিকা ছিল যা মাইডান অভ্যুত্থান এবং তার রেশ হিসাবে বর্তমান পরিস্থিতির জন্ম দিয়েছে। ইউক্রেনের মাটিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রর প্রভাবে ‘সিভিল সোসাইটি’ গোষ্ঠীগুলোর মাধ্যমে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল, তারাই মূলত বিশৃঙ্খলার জন্য দায়ী ছিল।
এমনকি তৎকালীন ইউরোপীয় ও ইউরেশীয় বিষয়ক মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী নুল্যান্ড ২০১৪ সালের এপ্রিলে স্বীকার করে বলেছিলেন ‘ওয়াশিংটন ইউক্রেনে ‘গণতন্ত্র বিকাশ করতে’ ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করেছে, কারণ এই ধরনের প্রচেষ্টা গণতন্ত্রের জন্য দরকারী।
সেই সময়ে রাশিয়ার সবচেয়ে বড় ‘অপরাধ’ ছিল কিয়েভকে জাতীয় উন্নয়নের বিকল্প পথ দেখানো। আর সে কারণেই ২১ নভেম্বর, ২০১৩ তারিখে মার্কিন কূটনৈতিক বাহিনী দ্রুত পদক্ষেপ নিয়ে তৎকালীন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভিক্টর ইয়ানুকোভিচকে দিয়ে ‘ইউরোপীয় ইউনিয়ন-ইউক্রেন অ্যাসোসিয়েশন চুক্তি (AA)’ স্বাক্ষর করাতে চেয়েছিল। ইয়ানুকোভিচ সেটা না করার আকস্মিক সিদ্ধান্ত নেয়ায় পশ্চিমা শক্তি তাকে ক্ষমতা থেকেই উচ্ছেদ করে দেয়।
নুল্যান্ড যখন মাইডান অভ্যুত্থানের রক্তারক্তির মধ্যে কিয়েভে একাধিক সফর করছিলেন, জন ম্যাককেইন এবং মার্কিন রাষ্ট্রদূতের সাথে স্ন্যাকস আউট করছিলেন, তখন খুব অদ্ভুত ঘটনাগুলো ঘটছিল যার কোনো ব্যাখ্যা আজও মেলেনি।
আজ অবধি কুখ্যাত ‘মাইডান স্নাইপারদের’ তদন্ত থেকে কোনও রিপোর্ট আসেনি কারা কয়েক ডজন বিক্ষোভকারী এবং পুলিশ অফিসার উভয়কেই হত্যা করেছিল? কয়েকজন স্নাইপারের মতে, তারা একজন মার্কিন কর্মকর্তার কাছ থেকে সরাসরি আদেশ পেয়েছিলেন। এটি কি এমন কিছু হতে পারে যা ন্যাটো বা ন্যাটোর সাথে যুক্ত কেউ অনুমোদন দিতে পারে? এটা নিশ্চিতভাবে বলা অসম্ভব, কিন্তু হত্যাকাণ্ড জনসাধারণকে প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ করে দাবানলের মত হয়ে ওঠে যাতে শেষ পর্যন্ত ইয়ানুকোভিচকে দেশ থেকে পালিয়ে বাঁচতে হয়।
সে সময় রয়টার্সও কিয়েভের নির্দোষীতা সম্পর্কে নিশ্চিত ছিল না, তারা জিজ্ঞেস করেছিল ‘২০১৪ সালে কেন পুলিশ সদস্যদের হত্যার অভিযোগে কাউকে অভিযুক্ত করা হয়নি? বিশেষ করে প্রসিকিউটর এবং তদন্তের দায়িত্বে থাকা মন্ত্রী সকলেই ইন্ধন দিয়েছিলেন’।
এমনকি সে সময় পশ্চিমা মিডিয়াকেও প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়— কেন পশ্চিমা মিডিয়া কিয়েভের ডনবাসের গোলাগুলির খবর দিয়েছে? কেন লিখেছে ‘গত আট বছরে লক্ষ লক্ষ রাশিয়ান পাসপোর্টধারীদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে’? কেন তারা ইউক্রেনীয় বাহিনীর নৃশংসতা এবং যুদ্ধাপরাধের বর্ণনা দিয়েছিল যাদের মধ্যে অনেকেই সরাসরি নব্য-নাৎসি- আজভ ব্যাটালিয়ন? (এই বাহিনী নির্বিচারে স্কুল, হাসপাতাল এবং আবাসিক এলাকায় বোমা বর্ষণ করছিল)।
জেন্স স্টলটেনবার্গের মন্তব্য অনুযায়ী নির্মম বাস্তবতা হল ইউক্রেন ইতিমধ্যেই ন্যাটোর একটি ‘ডি ফ্যাক্টো প্রক্সি সদস্য’ এবং তা সেই ২০১৪ সাল থেকেই।
ইউরোপীয় বিশেষজ্ঞ মেয়ারশাইমার ব্যাখ্যা করেছেন—ন্যাটো জোট ২০১৪ সালে ইউক্রেনের সামরিক বাহিনীকে প্রশিক্ষণ দেওয়া শুরু করে এবং আট বছরে গড়ে ১০ হাজার সেনাকে প্রশিক্ষিত করে।
হোয়াইট হাউসে যে-ই থাকুন না কেন ইউক্রেনে অস্ত্র সাপ্লাই অব্যহতভাবে ঘটেছে। ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে ট্রাম্প প্রশাসন অন্যান্য ন্যাটো রাষ্ট্রগুলোর সাথে ইউক্রেনে ‘প্রতিরক্ষামূলক’ অস্ত্র পাঠাতে শুরু করে, যখন কিয়েভ রাশিয়ার সীমান্তে অনুষ্ঠিত যৌথ সামরিক মহড়ায় প্রধান ভূমিকায় ছিল। ৩২টি দেশের নৌবাহিনীসহ জুলাই ২০২১ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউক্রেন যৌথভাবে ব্ল্যাক সাগরে বার্ষিক নৌ মহড়া করেছিল। যা ছিল এখন পর্যন্ত ওই অঞ্চলের সবচেয়ে বড় নৌ-মহড়া। একই বছর সেপ্টেম্বরে ইউক্রেনীয় সেনাবাহিনী ‘র্যা পিড ট্রাইডেন্ট-২০২১’ পরিচালনা করে।
কেউ কেউ যুক্তি দিতে পারে যে ইউক্রেন ন্যাটোর বাহিনীতে যোগদান করা সঠিক ছিল এই বিবেচনায় যে রাশিয়া ক্রিমিয়ান প্রজাতন্ত্রকে ‘দখল’ করেছে এবং এটিকে তার ‘সাম্রাজ্যে’ যোগ করে নিয়েছে। ন্যাটো এবং এর অংশীদার রাষ্ট্র জুড়ে এই দৃষ্টিভঙ্গি ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে।বাস্তবে ক্রিমিয়ান জনগণ একটি গণতান্ত্রিক গণভোটের আয়োজন করে এবং ৯৭% ক্রিমিয়ান জনগণ রাশিয়ান ফেডারেশনে পুনরায় যোগ দিতে চায়। সেই গণভোট-এর পর প্রেসিডেন্ট পুতিন রাষ্ট্রীয় ডুমাতে আনুষ্ঠানিক সমর্থনের পরে একটি ডিক্রিতে স্বাক্ষর করেন এবং ক্রিমিয়াকে একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসাবে স্বীকৃতি দেন – এক ফোঁটা রক্তপাত ছাড়াই।
উপরের সবগুলো ইন্সিডেন্ট যোগ দিলে যা বেরিয়ে আসে সেটা বেড়াল নয়, একটি রঙ্গিন উলে বোনা রুসোফোব!
এবার রিসেপ তাইয়িপ এরদোগান উবাচ
তুরস্ক বলেছিল যে তারা সুইডেন এবং ফিনল্যান্ডের আবেদনে বাধা দেবে যদি না তারা সন্তোষজনক আশ্বাস না পায় যে নর্ডিক দেশগুলো কুর্দি গোষ্ঠীগুলিকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসাবে চিহ্নিত করবে, বিশেষ করে কুর্দিস্তান ওয়ার্কার্স পার্টি (PKK)।
তুরস্ক বলেছে যে তারা এখন সন্তুষ্ট। মঙ্গলবার এরদোগানের কার্যালয় থেকে প্রকাশিত এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘তুরস্ক সন্ত্রাসী সংগঠনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করেছে, তুরস্ক যা চেয়েছিল তা পেয়েছে।‘
তিন নেতার স্বাক্ষরিত স্মারকলিপিতে বলা হয়েছে যে ফিনল্যান্ড এবং সুইডেন জাতীয় নিরাপত্তার বিষয়ে তুরস্ককে ‘তাদের পূর্ণ সমর্থন নিশ্চিত করবে’। এর মানে হলো এখন ফিনল্যান্ড ও সুইডেন PKK গোষ্ঠিকে ‘সন্ত্রাসী’ বলবে, তাদের দেশে আশ্রয় নেয়া পিকেকে সদস্যদের ঘাড় ধরে তুরস্কে ফেরৎ পাঠাবে, সুইডেন প্রায় ১ লাখ কুর্দি শরণার্থীদের এবং সিরিয়ার ওয়াইপিজির সদস্যদের ফেরৎ পাঠাবে। এইসব নিশ্চয়তা দেশ দুটি দিচ্ছে ন্যাটো সদস্য হতে। আর তুরস্ক দেশদুটোকে ব্ল্যাকমেইল করে তার ‘ঘরের শত্রু’ বিপ্লবী, স্বাধীনতা সংগ্রামীদের দেশে ফিরিয়ে এনে হত্যা করে বিদ্রোহ দমন করবে। ভারী অদ্ভুত নৃশংস এক খেলা!
এরদোগান একদিকে ন্যাটো জোটভুক্ত পশ্চিমা ‘খাস চামচা’ রোল প্লে করছে, আবার পুতিনকে মৃদু আশ্বস্ত করছে-আমরা তোমাদের বিরুদ্ধে অলআউট স্যাঙ্কশনে নেই। একবার সুইডেন-ফিনল্যান্ডের ন্যাটোভুক্তির বিরোধীতা করছে, আবার ‘উপঢৌকন’ পেয়ে বিরোধীতা তুলেও নিচ্ছে। এরই মধ্যে আবার ক্ষমতার দাপট দেখাতে পশ্চিমা সংবাদ মাধ্যমকে ব্লক করছে। তাও যে-সে মাধ্যম নয়, খোদ জার্মান ডয়চে ভেলে (DW) এবং মার্কিন আন্তর্জাতিক রেডিও স্টেশন ভয়েস অফ আমেরিকা (VoA)র ওয়েবসাইটগুলো ব্লক করেছে৷
ইতিমধ্যে DW-এর পরিচালক, পিটার লিমবার্গ আদালতে এই পদক্ষেপকে চ্যালেঞ্জ করার ঘোষণা দিয়েছেন। লিমবার্গ ফিনান্সিয়াল টাইমসের সাথে একটি সাক্ষাত্কারে বলেছেন—‘ডিডব্লিউ ব্লকের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেবে’। VoA-এর অধিকর্তা ইউএস এজেন্সি ফর গ্লোবাল মিডিয়া (ইউএসএজিএম) তুর্কি কর্তৃপক্ষের ‘সেন্সরশিপ’-এ অগ্নিশর্মা হয়েছেন।
মিনহোয়াইল ৩ জুলাই তুরস্ক শস্য বহনকারী একটি রুশ পতাকাবাহী জাহাজ আটক করেছে। যদিও রাশিয়ার কর্তৃপক্ষ এখনও এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেনি।
ইউক্রেন অভিযোগ করে আসছিল- দেশে চলমান সংঘাতের কারণে সমুদ্রপথে তার শস্য রপ্তানি করতে পারছে না, আনুমানিক ২৫ মিলিয়ন টন শস্য বর্তমানে দেশের বন্দরে আটকে আছে। কিয়েভ এর আগে রাশিয়াকে তার শস্য ‘চুরি’র জন্য অভিযুক্ত করেছে – যা মস্কো অস্বীকার করেছে।
কিয়েভ রাশিয়ান পতাকাবাহী জাহাজটি ইউক্রেনীয় শস্যের ‘অবৈধ’ পরিবহনে জড়িত ছিল বলে দাবি করার পর তুরস্ক রাশিয়ান পণ্যবাহী জাহাজ জব্দ করেছে (খবর- রয়টার্স)ইউক্রেনকে তুরস্ক আশ্বস্ত করেছে- ‘আমাদের পূর্ণ সহযোগিতা রয়েছে। জাহাজটি বর্তমানে বন্দরের প্রবেশপথে দাঁড়িয়ে আছে, তুরস্কের কাস্টমস কর্তৃপক্ষ এটিকে আটক করেছে।‘ ইউক্রেনীয় কূটনীতিকরা তুর্কি কর্তৃপক্ষকে জাহাজ- ঝিবেক ঝোলিকে আটক করার জন্য অনুরোধ জানানোর দু’দিন পর এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে এই যুক্তিতে যে এটি ‘চুরি করা’ ইউক্রেনীয় কৃষি পণ্য পরিবহন করছিল।
জাহাজটি বার্দিয়ানস্কের আজভ সাগর বন্দর থেকে রওনা হয়েছে, যা মারিউপোল শহরের কাছে।যেখানে রাশিয়ান বাহিনী এবং ডনবাস মিলিশিয়ারা নিয়ন্ত্রণ করছে।নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন ইউক্রেনীয় কর্মকর্তার বরাত দিয়ে রয়টার্স জানিয়েছে, বার্দিয়ানস্কে জাহাজটিতে প্রায় ৪ হাজার ৫শ টন শস্য বোঝাই করা হয়েছিল। কাজাখস্তান ভিত্তিক কেটিজেড এক্সপ্রেস কোম্পানি, যেটি জিবেক ঝোলির মালিক, রয়টার্সকে বলেছে যে জাহাজটি গ্রীন লাইন নামে একটি রাশিয়ান ফার্মের কাছে লিজ দেওয়া হয়েছিল, যা কোনও নিষেধাজ্ঞার অধীন নয়।
এইসব জয়ী জয়ী অবস্থা দেখে এরদোগান আরও এক কাঠি বেড়ে হুমকি ঝেড়েছে- ‘তুরস্কের কাছে বিশ্বের সেরা সামরিক বাহিনী থাকবে। আমরা আমাদের সমস্ত সামরিক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানকে এক ছাদের নিচে জড়ো করেছি। এই যৌথ কাঠামোতে, আমরা একটি আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থা তৈরি করেছি যা বিশ্বের উদাহরণ এবং আজকের চাহিদা মতে যথাযথ। তুর্কি প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়্যেপ এরদোগান আঙ্কারার সামরিক বাহিনীকে বিশ্বের ‘এক নম্বর’ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
এইসব ঘোষণা এমনি এমনি বাতাসে ভাসছে না। এরদোগান এখন স্পষ্টতই উসকানি দেয়ার জায়গায় বসে আছেন। এই দিক থেকে তুরস্কের উসকানি (মনে রাখা দরকার সিরিয়া যুদ্ধে রাশিয়ার সহযোগীতার সময় তুরস্ক ইচ্ছা করেই একটি Su-57 জেট ফাইটার ভূপাতিত করে, যার পাইলটের মৃত্যু ঘটে। সে সময় এরদোগান পুতিনের কাছে ‘দুর্ঘটনাবশত:’ বলে ক্ষমাও চেয়েছিলেন)। অন্যদিকে পোল্যান্ড ও লিথুয়ানিয়ার রাশিয়ান ছিটমহল ‘কালিনিগ্রাদ’ অবরুদ্ধ করার ঘোষণা সব একসূত্রে গাঁথা। প্রচ্ছন্ন উসকানি। তারা চাইছে রাশিয়া যেন রাগে-ক্রোধে ভুল করে হলেও কোনো একটি ন্যাটোভুক্ত দেশে আক্রমণ করে বসে! তাহলেই সমস্বরে হুংকার ছেড়ে রাশিয়াকে উচিৎ শিক্ষা দেয়ার অনেকদিনের খায়েশ বাস্তবায়ন করা যাবে। আজকে ইউক্রেন ন্যাটোভুক্ত নয় বলে সেটা ডিরেক্টলি করা যাচ্ছে না। তখন সরাসরি আর্টিকেল-৫ অনুযায়ী পুরো ন্যাটো জোট রাশিয়ার উপর হামলে পড়তে পারবে।
লিথুয়ানিয়ার বোধদয়:
রাশিয়ার কালিনিনগ্রাদ অঞ্চলের আংশিক বাণিজ্য অবরোধের প্রতিক্রিয়ায় মস্কো লিথুয়ানিয়ার অর্থনীতির অর্ধেক নামিয়ে আনতে পারে বলে হুমকি দিয়েছেন কালিনিগ্রাদের গভর্নর। সম্ভবত এইসব দিক বিবেচনায় রেখে শিথুয়ানিয়া কালিনিগ্রাদ অবরোধ-চিন্তা থেকে সরে এসেছে। কালিনিনগ্রাদ অঞ্চলের গভর্নর আন্তন আলিখানভ সোমবার রাশিয়ান সংবাদপত্র ভেদোমোস্তিকে বলেছেন, ‘রাশিয়া যদি বাল্টিক দেশগুলোতে আসা এবং বাইরে যাওয়া পণ্যগুলোর উপর পাল্টা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে তাহলে বাল্টিক দেশগুলোর পরিবহন খাত ধ্বংস হয়ে যেতে পারে।‘ গভর্নর আরও বলেন—‘রাশিয়া লিথুয়ানিয়ান অর্থনীতির অর্ধেক অদৃশ্য করে দিতে পারে। লিথুয়ানিয়া বুঝতে পারছে না যে কালিনিনগ্রাদ অঞ্চল রাশিয়ার অংশ এবং আমাদের উদ্ধার করার জন্য কেউ তো অবশ্যই আছে। আমরা ছিটমহলে বসবাস করলেও রাশিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন নই।‘
ঠিক এইরকম পরিস্থিতিতে আজ (৬ জুলাই আলজাজিরা) যুদ্ধের ১৩৩তম দিনে রাশিয়া ডনেৎস্ককে পুরোপুরি কব্জা করবার জন্য ব্যাপক গোলাবর্ষণ করেছে। স্লোভিয়ানস্ক শহর দখলের জন্য সাঁজোয়া বাহিনী এবং বম্বার্ড ইউনিট একসঙ্গে আক্রমণ করেছে। আইজ্যউম শহর দখলের জন্য যৌথ বাহিনী লড়াই জোরদার করেছে। পুতিন যেমন কুল হেডেড, ঠিক তেমন নন প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট দিমিত্রি মেদভেদভ। তিনি যুক্তরাষ্ট্রকে হুশিয়ার করে দিয়েছেন; তারা যদি রাশিয়ার বিরুদ্ধে আর্বিট্রেশনে যায় তাহলে প্রয়োজনে রাশিয়া নিউক্লিয়ার উইপন ইউজ করবে, যেটা গ্লোবাল ডেভাস্টেশন ঘটিয়ে দিতে পারে।
ফেসবুক হ্যাশট্যাগ : #chronicles_of_russia_ukraine_war_68
——————————
Monjurul Haque
7th July 2022
আপনার মতামত জানানঃ