মনজুরুল হক
নরসিংদি রেল স্টেশনে এক নারীর পরনে জিন্স ও টি-সার্ট দেখে ঈমান-আক্বিদা চলে গেল বলে উত্তেজিত মতলববাজরা মেয়েটিকে আক্রমণ করে। তাৎপর্যপূর্ণ হলো এই আক্রমনে একজন নারী সবচেয়ে বেশি খাপ্পা হয়ে মেয়েটিকে বিবস্ত্র করতে চায়! এক পর্যায়ে মেয়েটি স্টেশনমাস্টারের রুমে ঢুকে বাঁচতে পারে।
এই ঘটনা নিয়ে ফেনিয়ে লেখার কিছু নেই। এরকম হবে জানা কথা। কেন হবে? কারণ এই উন্মত্ত জনগোষ্ঠি দীর্ঘদিন ধরে এ ধরণের অন্যায় করে পার পেয়েছে শুধু নয়, বাকি সমাজের কাছে পুরস্কৃত হয়েছে। সমাজের এই ভয়ঙ্কর দশা রাতারাতি হয়নি। কেন হয়েছে সেটার ব্যাখ্যা দিতে গেলেও বিরাট লেখা দরকার। ইচ্ছে করে না। কেন? কারণ ওরা এই সমাজের ‘পাহাড়’। আমাদেরকে করে রাখা হয়েছে মাটির ঢেলা। তাই খুব সংক্ষেপে:
রাষ্ট্রীয়ভাবে ধর্মকে হাতিয়ার করার ইতিহাস অনেক পুরোনো। বাংলাদেশের সকল শাসকই কাজটা করেছেন। সামাজিকভাবে শিক্ষিতজনরা অনবরত করে যাচ্ছেন। এগুলোর সবই রাজনৈতিক হাতিয়ার। সারারাত ক্লাবে মদ গিলে বেড কাঁপিয়ে বাড়ি ফেরার সময় সুশীলগণ রিকসায় বসা যুগলকে ‘এত রাতে বাইরে কেন’ বলে নসিয়ত মারায়।
যে রাজনৈতিক জনশক্তি প্রগতিশীলতা দিয়ে ষাট-সত্তর-আশির দশকে এসব রুখে দিত, তারা এডওয়ার্ড গুরুর ‘ওরিয়েন্টালিজম’ গিলে এইসব ব্যাভীচারে দোষ দেখেন না। এই বাঞ্চোৎগুলো মার্কসবাদের মধ্যেও তালেবানী জিহাদ খুঁজে পায়। বোরখা যার যার চয়েস বলে ফতোয়া দেয়। দাঁড়াবার জায়গা বেদখল দেখেও ভাবে ‘সমাজতন্ত্র আসলে সব ঠিক হয়ে যাবে’! যাকগে।
শেষ করি… সকল যানবাহনে, পান দোকানে, মার্কেটে, রাস্তাঘাটে, অলিতে-গলিতে, বাড়িতে-বাইরে অশ্লীল ওয়াজ বাজে। গাছে গাছে ল্যামিনেটেড কাগজে ‘আল্লাহু’ ‘আলহামদুলিল্লাহ’ ‘সুবহানআল্লাহ’ ঝুলছে। ট্রেনে টয়লেটের পাশে ওজুখানা বানানো হয়েছে। ট্রেনের মাইকে সর্বক্ষণ দোয়া-দুরুদ বাজে। কাঁচাবাজারের শতভাগ দোকানে দোয়া-দুরুদ বাজে। বয়ষ্ক রিকসাচালক সার্ট পরা নারী যাত্রীকে পর্দা করতে বলে। বাসে-ট্রেনে-লঞ্চে-স্টিমারে ড্রাইভার-হেল্পার-অচেনা যাত্রী নারী যাত্রীদের পর্দা করতে বলে। নামাজের সময় যানবাহন থামিয়ে বাকি যাত্রীদের নেমে নামাজ পড়তে বলে…..
অর্থাৎ গোটা সমাজে সকলেই ছবক দেয়া, নসিয়ত করা, ধর্মের দাওয়াত দেয়া, পর্দা করতে বলা, নামাজে যেতে বলা, ধর্ম পালন করতে বলা খুবই স্বাভাবিক এবং অবশ্য পালনীয় কর্তব্য ভাবা হচ্ছে। এই কাজে কেউ পিছিয়ে নেই। আগে শুধু মোল্লারা বলত। এখন সবাই ধর্মের সেনানী। সকলেই ধর্ম প্রচারক। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা হাতে নিয়ে প্রচার করে।
সুতরাং নরসিংদীর এই ঘটনার মত হাজার হাজার ঘটনা ঘটতেই থাকবে। সরকার বলবে-‘আমরা দোষীদের শাস্তি দিচ্ছি, অনেকের জেল হয়েছে, হাইকোর্ট ফতোয়া দেয়া নিষিদ্ধ করেছে, সরকারের কাছে সকল ধর্ম সমান’। এসব ছেলে ভোলানো কথা। সত্যি হলো এটা ৯৫% মুসলিমের দেশ। এই অধিকারে সকলেই ফতোয়ার অধিকারী। সকলেই সমাজের রক্ষাকর্তা, এবং এটা রাষ্ট্রীয়ভাবেই প্রচারে প্রতিষ্ঠিত। কোনো সন্দেহ নেই এসবে সরকারের কোনো ক্ষতি নেই। তাই তারা বালিতে মুখ গুঁজে আছে। এটা নিশ্চিত যে আজকে ধর্মাশ্রয়ী গোষ্ঠি রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসলে কালকেই রাষ্ট্রের সকল কর্মকর্তা-কর্মচারী এই জাহেলিয়াত হৃষ্টচিত্তে মেনে নেবে। কারণ এসব চালু হলেও ঘুষ-দুর্নীতি-ব্যাভীচার-বদমায়েশি-ধর্ষণ-বলাৎকার-চুরি-ডাকাতিতে ছেদ পড়বে না।
আমরা নরসিংদীর ওই গ্রুপটির কারও শাস্তি চাই না। একটা দুটো বিচ্ছিন্ন অপরাধীকে শাস্তি দিয়ে জোয়ার ঠেকানো যাবে না। চাই জোয়ারটা ভালোভাবে ছড়িয়ে পড়ুক। মুক্তিযুদ্ধ করে স্বাধীন হওয়া একটা দেশের জনগণের ক্রুয়েল রিয়েলিটি বোঝা দরকার আছে। নিজের প্রিয় কন্যা সন্তানটিকে যখন জনসমক্ষে মুখে-পেটে আলকাতরা মাখিয়ে বলা হবে-‘মাগী এইভাবে আর বাইর হবি না’- তার আগে পর্যন্ত এই নষ্ট অবিমৃষকারী জাতির বোধদয় হবে না। একটা চরম রিলিজিয়াস এনার্কি এই জাতির অনাগত ভবিষ্যৎ।
আপনার মতামত জানানঃ