খুন ধর্ষণ শিশু নির্যাতন থেকে শুরু করে চুরি ছিনতাই দস্যুতা। স্বাভাবিক সময়ে যা ঘটত করোনাকালীন অস্থিতিশীলতায় তা যেন আরো লাগামহীন হয়ে উঠছে। অস্বাভাবিকতায় মানুষ হয়ে উঠেছে বেপরোয়া। লোভে কেউ কেউ করছেন খুন, ধর্ষণ কিংবা চুরি ছিনতাই। বিপরীতে স্বর্বস্ব হারিয়ে প্রতারিত আর ভাগ্য বিড়ম্বিত হচ্ছে কেউ কেউ।
মহামারি করোনার বিচ্ছিন্ন বন্দীদশায় যখন দেশ তখন ধকল সামলাতে মাঠে তৎপর রাষ্ট্রীয় আইনশৃঙ্খলাবাহিনীও। এই সময়ে সমাজ বিচ্ছিন্ন বন্দী মানুষের কারো কারো হিংস্রতা ছাড়িয়েছে সব মাত্রা। রাজধানীর বিভিন্ন প্রান্তে ঘটেছে একের পর এক খুন, চুরি, ছিনতাই, ধর্ষণ ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা।
পুলিশের তথ্যই বলছে, রাজধানী ঢাকায় খুন, চাঁদাবাজি, গাড়ি চুরি ও দস্যুতার মতো অপরাধ বেড়েছে। কমেনি ছিনতাইয়ের ঘটনাও। ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) আওতাধীন ৫০টি থানায় গত জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে হওয়া বিভিন্ন মামলার তথ্য বিশ্লেষণ করে অপরাধের এমন চিত্র পাওয়া গেছে।
ডিএমপির তথ্য বলছে, এ বছরের জানুয়ারিতে রাজধানীতে খুন হন নয়জন। ফেব্রুয়ারিতে খুনের ঘটনা ১২টি। এর মধ্যে পাঁচটি খুনের ঘটনাই মিরপুর এলাকায়। মার্চ মাস শেষ হতে এখনো ছয় দিন বাকি। গত ২৫ দিনে আলোচিত একাধিক খুনের ঘটনা রয়েছে। সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার রাতে ব্যস্ত সড়কে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করা হয় মতিঝিল থানা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক জাহিদুল ইসলাম ওরফে টিপুকে। একই ঘটনায় গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন কলেজছাত্রী ছাত্রী সামিয়া আফনান।
খুনের সঙ্গে ঢাকায় মোটরসাইকেলসহ গাড়ি চুরির ঘটনাও বেড়েছে। গত ফেব্রুয়ারি মাসে এ রকম ৩৬টি ঘটনায় মামলা হয়েছে। এর আগে জানুয়ারি মাসে মোটরসাইকেল বা গাড়ি চুরির মামলা হয়েছিল ৩১টি। চাঁদাবাজির ঘটনায় গত দুই মাসে ঢাকায় মামলা হয়েছে ১৬টি। গত মাসে নয়টি ও জানুয়ারি মাসে সাতটি। তবে অনেকে হয়রানি এড়াতে এবং চাঁদাবাজদের হুমকির কারণে মামলা করতে চান না।
করোনার কারণে রাস্তায় মানুষের উপস্থিতি কম থাকায় চুরি ও দস্যুতা কম ছিল। তবে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ায় এখন আগের মতোই রাজধানী কর্মব্যস্ত। এ ছাড়া ঢাকায় মাদকসেবীর সংখ্যা বেড়েছে। মাদকের টাকা জোগাড় করতে চুরি, ছিনতাই ও দস্যুতার মতো অপরাধে জড়াচ্ছে মাদকসেবীরা।
রাজধানীতে ছিনতাইয়ের ঘটনায় গত জানুয়ারি মাসে পাঁচটি ও ফেব্রুয়ারিতে আরও পাঁচটি মামলা হয়েছে। তবে ডিএমপির এ মামলার তথ্যে প্রকৃত চিত্র উঠে আসে না। কারণ, ছিনতাইয়ের ক্ষেত্রে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ভুক্তভোগীরা থানায় গিয়ে মামলা করেন না।
পুলিশ বলছে, করোনার কারণে রাস্তায় মানুষের উপস্থিতি কম থাকায় চুরি ও দস্যুতা কম ছিল। তবে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ায় এখন আগের মতোই রাজধানী কর্মব্যস্ত। এ ছাড়া ঢাকায় মাদকসেবীর সংখ্যা বেড়েছে। মাদকের টাকা জোগাড় করতে চুরি, ছিনতাই ও দস্যুতার মতো অপরাধে জড়াচ্ছে মাদকসেবীরা।
ফেব্রুয়ারি মাসের অপরাধ পর্যালোচনা নিয়ে গত রোববার ডিএমপি সভা করেছে। সভায় অপরাধ নিয়ন্ত্রণে থানাভিত্তিক অপরাধীদের তালিকা তৈরি করে দ্রুত গ্রেপ্তারের নির্দেশ দেন ডিএমপি কমিশনার মোহা. শফিকুল ইসলাম।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা বলছেন, এক সময় ঢাকার একেকটি এলাকায় একেকটি সন্ত্রাসী গ্রুপের আধিপত্য দেখা যেত। সুব্রত বাইন, ডাকাত শহীদ, শাহাদত, কিলার আব্বাস, জিসান, শাহিন শিকদার- প্রত্যেকেই হয়ে উঠেছিল নিজ নিজ এলাকার ত্রাস।
২০০১ সালে ২৩ জন শীর্ষ সন্ত্রাসীর নাম ঘোষণা করা হয়েছিল। এরপর তাদের গ্রেপ্তারে শুরু হয় অভিযান। এ রকম অভিযানে ডাকাত শহীদসহ দু’জন মারা গেছেন। ১৩ জন ভারত, যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশে পলাতক। অন্যরা কারাগারে বন্দি। এক কথায়, এলাকাভিত্তিক সন্ত্রাসীদের রমরমা দাপটের দৃশ্য বদল হয়েছে।
বিপরীতে এখন রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের দাপট লক্ষ্য করা যাচ্ছে। তবে আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার কম হওয়ায় খুনোখুনির ঘটনা কমেছে। ২০১৪ সালে ঢাকায় ২৬২টি খুনের ঘটনা ঘটে।
কিন্তু ২০২১ সালে খুনের ঘটনা ১৬৬টি। সাত বছরের ব্যবধানে খুনের ঘটনা কমেছে ৯৬টি। ২০১৫ সালে রাজধানীতে হত্যার শিকার হন ২২৬ জন, ২০১৬ সালে ১৬৫, ২০১৭ সালে ২১৮, ২০১৮ সালে ২১৬, ২০১৯ সালে ২০৮ ও ২০২০ সালে ২১৯ জন।
তবে ঢাকায় চুরি-ছিনতাইয়ে তেমন হেরফের হয়নি। যদিও এ ধরনের অপরাধের শিকার ভুক্তভোগীদের অনেকে পুলিশ পর্যন্ত যান না। খাতা-কলমে চুরি-ছিনতাইয়ের মামলার চেয়ে প্রকৃত ঘটনা অনেক বেশি। কারণ অনেক সময় থানার রেকর্ডে এই ধরনের ঘটনায় ‘হারানোর’ সাধারণ ডায়েরি করে এলাকার চিত্র স্বাভাবিক বলে দেখানো হয়।
ডিএমপির তথ্য বলছে, ২০২১ সালে রাজধানীতে চুরির ঘটনা ঘটেছে এক হাজার ২৬টি, ২০২০ সালে ৮৭৪টি, ২০১৯ সালে এক হাজার ৮৭টি, ২০১৮ সালে ৮৬৯টি, ২০১৭ সালে ৭৮৯টি, ২০১৬ সালে ৯৫৬টি, ২০১৫ সালে ৯৬৮টি ও ২০১৪ সালে ৮৮২টি। আর ২০২১ সালে ছিনতাইয়ের ঘটনায় মামলা হয় ১৪৫টি, ২০২০ সালে ১৭৬টি, ২০১৯ সালে ১৫৫টি, ২০১৮ সালে ২১৬টি, ২০১৭ সালে ২১৮টি, ২০১৭ সালে ১০৩টি, ২০১৬ সালে ১৩২টি, ২০১৫ সালে ২০৫টি ও ২০১৪ সালে ২৬৫টি।
মহামারির সময়ে বেপরোয়া এই ধর্ষণের কারণ খুঁজতে গিয়ে সমাজ ও মনোবিজ্ঞানীরা জানান, সামাজিক ও নৈতিক অবক্ষয়ই এ জন্য দায়ী।
অপরাধ বেড়ে যাওয়ার কারণ হিসাবে বিশ্লেষকরা বলছেন, মানুষের মধ্যে অপরাধপ্রবণতা তৈরি হওয়ার অনেক কারণ আছে৷ কিন্তু তার মধ্যে অন্যতম নিরাপত্তাহীনতা৷ কাজের নিরাপত্তা, খাদ্যের নিরাপত্তা, সুস্থ সমাজের নিরাপত্তা— এই বিষয়গুলি যে কোনো মানুষের মনকে প্রভাবিত করে৷ করোনার সময় গোটা বিশ্ব জুড়ে দুইটি বিষয় নিয়ে মানুষ অত্যধিক রকমের উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন৷ এক বেঁচে থাকার অধিকার এবং দুই কাজের অধিকার৷
তাদের বক্তব্য, গত একশ বছরে মানুষ বিশ্ব জোড়া মহামারি বা প্যানডেমিক দেখেনি৷ রোগ হলে তার প্রতিকার আছে, এই ধারণা মানুষের মনের মধ্যে ঢুকে গিয়েছে৷ রোগ আছে, কিন্তু ওষুধ নেই এই ভাবনাটিই এক চরম নিরাপত্তাহীনতা তৈরি করেছে মানুষের মধ্যে৷ তার উপর লকডাউনের কারণে মানুষ কাজ হারাতে শুরু করেছেন৷ প্রথম বিশ্বে তাও কাজের নিরাপত্তা আছে৷ কিন্তু তৃতীয় বিশ্বে সেটুকুও নেই৷ ফলে মানুষ দিশাহীন হয়ে পড়েছে৷ কাজ হারানো মানুষ বুঝতে পারছেন না কীভাবে সংসার চলবে৷ যাদের কাজ আছে, তারা বুঝতে পারছেন না আগামীকাল তা থাকবে কিনা৷ এই পুরো বিষয়টি মানুষের মনের উপর প্রভাব ফেলছে৷ মানুষ মানসিকভাবে হিংস্র হয়ে উঠছে৷ একই সঙ্গে বাড়ছে অপরাধপ্রবণতা।
তারা বলেন, অপরাধ আগে ছিল না এমন নয়৷ কিন্তু অপরাধের চরিত্র বদলেছে করোনাকালে৷ বেড়েছে সংখ্যায়৷ যত দিন যাবে, নিরাপত্তাহীনতা যত বাড়বে সংখ্যাও বাড়তে থাকবে৷ এটাই মনুষ্য সমাজের স্বাভাবিক প্রবৃত্তি৷
বিশ্লেষকরা বলছেন, অপরাধ নিয়ন্ত্রণে সামাজিক সচেতনতার পাশাপাশি নজর দিতে হবে কর্মসংস্থানের দিকেও। একইসাথে নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলাবাহিনীকে নিতে হবে নানা প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৩২৬
আপনার মতামত জানানঃ