রাজধানীতে প্রকাশ্যে অস্ত্রের ব্যবহার বেড়েছে। কিশোর গ্যাংসহ নানা শ্রেণির অপরাধীরা দাপটের সঙ্গে অস্ত্র ব্যবহার করছে। ছিনতাই, চাঁদাবাজি, ফুটপাত দখল, আধিপত্য বিস্তার, রাজনৈতিক বিরোধ কিংবা সামান্য দ্বন্দ্ব—প্রায় সব ক্ষেত্রেই আগ্নেয়াস্ত্র ও দেশীয় অস্ত্র ব্যবহার করা হচ্ছে। বিশেষ করে রাতে নগরীর নিরাপত্তাহীনতা আরও প্রকট হয়ে উঠেছে। এ পরিস্থিতিতে আতঙ্কে রয়েছেন সাধারণ নাগরিকরা।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পুরো রাজধানীজুড়ে অস্ত্রবাজির পেছনে বিগত জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানের সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অস্ত্র লুটেরাদের ভূমিকা রয়েছে।
পুলিশের তথ্যমতে, গত দুই মাসের তুলনায় রাজধানীতে অস্ত্র ব্যবহার করে সংঘটিত অপরাধের সংখ্যা বেড়েছে। চলতি মাসে অন্তত ৫০টি ঘটনায় দেশীয় অস্ত্র ও আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহৃত হয়েছে।
রাজধানীর উত্তরা এলাকায় সোমবার (১৭ ফেব্রুয়ারি) কিশোর গ্যাং সদস্যরা প্রকাশ্যে এক নারী-পুরুষকে রামদা দিয়ে কুপিয়ে জখম করেছে। মোটরসাইকেলের উচ্চগতির প্রতিবাদ করায় এই হামলা হয়।
১৮ ফেব্রুয়ারি রামপুরার বনশ্রী এলাকায় কাঁচাবাজার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে শ্রমিক দলের নেতা জুয়েলকে গুলি করে তারই দলের আরেকটি গ্রুপ। পরদিন ১৯ ফেব্রুয়ারি উত্তরা এলাকায় একটি চলন্ত বাসে অস্ত্র ঠেকিয়ে ভয়াবহ ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে।
শুধু উত্তরা বা রামপুরা নয়, প্রায় প্রতিদিনই রাজধানীর মিরপুর, মোহাম্মদপুর, যাত্রাবাড়ী, গাবতলীসহ বিভিন্ন এলাকায় অস্ত্রের ভয়াবহ ব্যবহার বেড়েছে। বিশেষ করে রাত নামলেই ছিনতাইকারীরা অস্ত্রের মুখে সাধারণ মানুষকে জিম্মি করে। যে কারণে সম্পদ লুটের পাশাপাশি ঘটছে হতাহতের ঘটনাও।
গত বেশ কিছু দিনের পর্যবেক্ষণে বেরিয়ে এসেছে, সন্ত্রাসীদের অস্ত্রের আঘাতে নারী, শিশু ও বিভিন্ন বয়সের মানুষ মারা যাচ্ছে। শুধু ছিনতাই নয়—চাঁদাবাজি, ফুটপাত দখল, আধিপত্য বিস্তার এবং রাজনৈতিক বিরোধেও অস্ত্রের ব্যবহার অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে।
সম্প্রতি রাজধানীর উত্তরা, মোহাম্মদপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় প্রকাশ্যে অস্ত্রের মহড়া এবং অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে সাধারণ মানুষের ওপর হামলার ঘটনার কয়েকটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়েছে। এসব ভিডিওতে দেখা গেছে, দ্বন্দ্ব বা আধিপত্য বিস্তার নিয়ে সশস্ত্র ব্যক্তিরা জনবহুল সড়ক, বাজার কিংবা আবাসিক এলাকায় আগ্নেয়াস্ত্র ও দেশীয় অস্ত্র ব্যবহার করছে।
ভুক্তভোগীরা বলছেন, অস্ত্র উঁচিয়ে হামলা বা হুমকি দেওয়ার দৃশ্য সাধারণ মানুষের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে, বিশেষ করে পথচারী, দোকানি ও সাধারণ নাগরিকরা শঙ্কিত হয়ে পড়েছেন। কারণ যে কেউ অস্ত্রের আঘাতে হতাহতের শিকার হচ্ছেন।
মোহাম্মদপুরের বাসিন্দা ফয়সাল আরেফিন বলেন, ‘মোহাম্মদপুরজুড়ে কিশোর গ্যাং সদস্যরা প্রকাশ্যে দেশি-বিদেশি অস্ত্র নিয়ে রাস্তায় সাধারণ মানুষের ওপর হামলা করছে। মঙ্গলবার দুপুরেও একদল যুবক অস্ত্র নিয়ে রাস্তায় দাপিয়ে বেড়াচ্ছিল, বেশ কয়েকটি জায়গায় হামলা করেছে। আর রাত নামলেই পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়ে যায়। এখন আমরা আতঙ্কিত হয়ে চলাচল করি, কারণ যেকোনও সময় হয়তো অস্ত্রের মুখে পড়তে হতে পারে।’
মাহফুজ আলম নামে আদাবরের এক বাসিন্দা বলেন, ‘এলাকায় রাতের বেলায় ছিনতাইকারীরা অস্ত্র নিয়ে রাস্তায় নেমে আসে। আমি নিজে বহুবার দেখেছি, সুযোগ পেলেই অস্ত্রধারীরা হামলা করছে। শুধু আমাদের মতো সাধারণ মানুষই নয়, ব্যবসায়ীরাও তাদের ভয়ে আছে। কারণ যেকোনও সময় অস্ত্রের মুখে টাকা, মালামাল ছিনতাই হতে পারে। পুলিশের অভিযানেও তাদের থামানো যাচ্ছে না।’
পুলিশ সদর দফতরের তথ্য অনুযায়ী, ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের সময় দেশের বিভিন্ন থানায় হামলা চালিয়ে ৫ হাজার ৭৫০টি অস্ত্র লুট করা হয়েছিল। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অভিযানে ৪ হাজার ৩৬৬টি অস্ত্র উদ্ধার করলেও এখনও ১ হাজার ৩৮৪টি অস্ত্র অপরাধীদের হাতে রয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এসব অস্ত্রের কারণেই রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় অপরাধ প্রবণতা বাড়ছে।
অপরাধ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ ওমর ফারুক বলেন, ‘অবৈধ অস্ত্রের সহজলভ্যতা অপরাধ বৃদ্ধির অন্যতম কারণ। এগুলো ছিনতাই, ডাকাতি, চাঁদাবাজি ও রাজনৈতিক সহিংসতায় ব্যবহৃত হচ্ছে। কঠোর অভিযান ছাড়া পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। বরং অপরাধীদের অবাধে অস্ত্র ব্যবহার চলমান থাকলে পর্যায়ক্রমে ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে।
সাবেক আইজিপি নূরুল হুদা বলেন, ‘লুট হওয়া অস্ত্র আইনশৃঙ্খলার জন্য বড় হুমকি। এগুলো সংঘবদ্ধ অপরাধ চক্রের কাছেও রয়েছে। জননিরাপত্তা রক্ষায় এসব অস্ত্র দ্রুত উদ্ধার করতে হবে। এছাড়াও জুলাই আন্দোলনের পরবর্তীতে অপরাধপ্রবণ মানুষের সাহস বেড়েছে। এজন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর ভূমিকার বিকল্প নেই।’
‘পুলিশের কাছে অপরাধীদের তালিকা আছে, তাদের সক্ষমতাও রয়েছে’ বলেও বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ বাংলা ট্রিবিউনকে জানিয়েছেন। তাদের পরামর্শ, থানা পুলিশের ওপর নির্ভর না করে যৌথ অভিযান ও গোয়েন্দা তৎপরতা বাড়ালে এসব অস্ত্র উদ্ধার ও অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে পুলিশ সদর দফতরের এআইজি (মিডিয়া অ্যান্ড পিআর) এনামুল হক সাগর বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বাকি অস্ত্র উদ্ধারে অভিযান অব্যাহত আছে। জননিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পুলিশের পাশাপাশি সাধারণ মানুষকেও সহযোগিতা করতে হবে।’
দুয়েকটি রাজনৈতিক দলের অভ্যন্তরীণ অস্থিরতা; অপরাধীদের নিয়ন্ত্রণহীনতায় অস্ত্রবাজি ও অপরাধপ্রবণতা বাড়ছে বলেও মনে করছেন কেউ কেউ। রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারে অনেক সন্ত্রাসীর হাতে অস্ত্র তুলে দেওয়া হয় বলেও অভিযোগ রয়েছে।
একজন রাজনৈতিক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘রাজনীতির নামে কিছু গোষ্ঠী অস্ত্রের মাধ্যমে ক্ষমতা বজায় রাখতে চায়, যা সমাজের জন্য হুমকি।’
আর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে প্রতিটি থানায় সিটিজেন ফোরাম (কমিউনিটি পুলিশ) গঠন করা হয়। অভিযোগ রয়েছে, অনেক জায়গায় এই ফোরামের সদস্যরাও বিভিন্ন অপরাধে জড়িত।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, কার্যকর সিটিজেন ফোরাম হলে অপরাধ প্রতিরোধ ও সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব। কমিউনিটি পুলিশিং ব্যবস্থাও শক্তিশালী করতে হবে।
অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহার রোধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর আরও কঠোর হওয়া জরুরি। পাশাপাশি জনগণের সচেতনতা বৃদ্ধি ও অস্ত্রধারীদের দ্রুত চিহ্নিত করার ওপর জোর দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ ওমর ফারুক বলেন, ‘থানা সিটিজেন ফোরামে অযোগ্য ও অপরাধীরা জায়গা পেয়েছে। পুলিশের উচিত গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে কমিটি পুনর্গঠন করা ও অপরাধ দমনে আরও কঠোর হওয়া।’
তিনি আরও বলেন, ‘সিটিজেন ফোরাম ওপর নির্ভর না করে পুলিশের ইন্টেলিজেন্স ইউনিট ও অন্যান্য সংস্থার সহায়তায় যৌথ অভিযানে মাধ্যমে দ্রুত অস্ত্রবাজদের দমন করতে হবে। এখনই ব্যবস্থা না নিলে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হতে পারে।’
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী সম্প্রতি সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘রাজধানীসহ সারা দেশে সাঁড়াশি অভিযান চালিয়ে অস্ত্রধারীদের গ্রেফতার করা হচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে পুলিশ নিরলসভাবে কাজ করছে।’
একই কথা জানিয়েছেন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাও। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘কিশোর গ্যাং ও অবৈধ অস্ত্রধারীদের বিরুদ্ধে বিশেষ অভিযান পরিচালিত হচ্ছে। দেশীয় অস্ত্রের ব্যবহার বন্ধেও পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে, যাতে অপরাধীদের দ্রুত আইনের আওতায় আনা যায়।’
আপনার মতামত জানানঃ