গণতন্ত্রের ধূয়া তুলে যে ইউরোপীয় দেশগুলোর মুখ ফেনিয়ে গেছে, এক সময় এরাই বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছলে বলে কৌশলে উপনিবেশ গড়ে তুলেছিল। সম্পদের পাহাড় গড়তে এরা নির্বিচারে মানুষ হত্যা করতেও দ্বিধা করেনি। তাদের উপনিবেশের বাসিন্দারা ছিল ‘ ইতর প্রাণী’ । আর তারা ছিলেন ত্রাতা।
আফ্রিকার প্রাকৃতিক সম্পদ কুক্ষিগত করতে হেন অপকর্ম নেই যা করেনি ইউরোপীয়রা। তাদের কাছে আফ্রিকার মানুষ ছিল ওরাং ওটাং। ইউরোপের গোত্রভুক্ত ফ্রান্স ১৯ শতকের শুরুতে উপনিবেশ বিস্তার করতে শুরু করে। বর্তমানে ফ্রান্সের আয়তন ৬ লাখ ৭৪ হাজার ৮৪৩ বর্গ কিলোমিটার। অথচ ১৯৬০ সাল পর্যন্ত সাম্রাজ্যবাদী এ দেশটির অধিভুক্ত এলাকা ছিল ১ কোটি ১৬ লাখ ৭২ হাজার ১৫৭ বর্গকিলোমিটার। এর মধ্যে বড় একটি অংশ ছিল আফ্রিকা মহাদেশে।
১৮৩০ সালে আলজেরিয়া দখলের মধ্য দিয়ে আফ্রিকায় প্রবেশ করে ফ্রান্স। তারা দেশটি শাসন করে ১৯৬২ সাল পর্যন্ত। প্রায় ১৩০ বছরের ‘সভ্যতার মিশনে’ তারা ৫৬ লাখের বেশি আলজেরীয়কে হত্যা করেছে বলে জানিয়েছে আলজেরিয়ার সরকার। ফ্রান্সের হিসাব অনুযায়ী দশ লাখ আলজেরীয় এবং এক লাখ ফরাসি নিহত হয়েছে।
আলজেরিয়া ও ফ্রান্সের মধ্যে ভিসাসংক্রান্ত জটিলতাসহ অন্যান্য কূটনৈতিক জটিলতা চলছে। এমন পরিপ্রেক্ষিতে আলজেরিয়া সরকারের পক্ষ থেকে ফরাসি শাসনামলে নিহতের সংখ্যা ফের তুলে আনা হলো।
আলজেরিয়ার প্রেসিডেন্ট কার্যালয় এক বিবৃতিতে জানায়, ১৮৩০ সাল থেকে ১৯৬২ সাল পর্যন্ত ১৩২ বছরের ফরাসি শাসনে ৫৬ লাখের বেশি মানুষ নিহত হয়।
ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাখোঁ সম্প্রতি দাবি করেন, আলজেরিয়ায় ফরাসি শাসনামলে হতাহতদের নিয়ে দেশটির ইতিহাস সত্যের ওপর ভিত্তি করে নির্মিত নয়। বরং ফ্রান্সের প্রতি বিদ্বেষের জায়গা থেকে আলজেরিয়ার ইতিহাস রচিত হয়েছে।
মাখোঁর ওই বক্তব্যে ক্ষুব্ধ হন আলজেরিয়ার জনগণ। এর পরপরই দেশটির প্রেসিডেন্ট কার্যালয়ের পক্ষ থেকে বিবৃতিটি দেয়া হয়।
বিবৃতিতে বলা হয়, ‘ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট মাখোঁ আমাদের ৫৬ লাখ ৩০ হাজার শহীদকে অপমান করেছেন। আলজেরিয়ার অভ্যন্তরীণ বিষয়ে ফ্রান্সের অযাচিত হস্তক্ষেপ আমরা সরাসরি প্রত্যাখ্যান করছি।’
অভিযান চলাকালে নৃশংসভাবে আলজেরীয় নারীদের ধর্ষণ করে ফরাসি সেনারা। ধর্ষণ শেষে অনেক নারীর স্তুন তারা কেটে ফেলে। হত্যার পর অনেকের মৃতদেহ বিকৃত করতেও কসুর করেনি সেনারা।
বিবৃতিতে উল্লেখিত ৫৬ লাখ ৩০ হাজার নিহতের মধ্যে ১৯৫৪ সাল থেকে ১৯৬২ সাল পর্যন্ত আলজেরিয়ার স্বাধীনতা সংগ্রামে শহীদ ১৫ লাখ মানুষ রয়েছেন।
এ ছাড়া রয়েছেন আলজেরিয়ার মরুভূমিতে ফ্রান্সের পারমাণবিক পরীক্ষার পর পরিত্যক্ত খনি ও তেজস্ক্রিয়তায় নিহত ব্যক্তিরা।
ইতিহাসবিদ মোহাম্মদ আল-আমিন দ্য নিউ আরবকে বলেন, ‘আলজেরিয়া সরকারের ধারণা, ১৩২ বছরের ফরাসি ঔপনিবেশিক আমলে ১ কোটির কাছাকাছি মানুষ নিহত হতে পারে।’
ফ্রান্সের ইতিহাসবিদদের ভাষ্য, আলজেরিয়ার আট বছরের স্বাধীনতা যুদ্ধে উভয়পক্ষ থেকে চার লাখ মানুষের মৃত্যু হয়। অন্যদিকে আলজেরিয়ার বিশেষজ্ঞদের দাবি, ওই সময় প্রায় ১৫ লাখ আলজেরিয়ান নিহত হন।
আলজেরিয়ার প্রেসিডেন্ট কার্যালয়ের বিবৃতিতে আরও বলা হয়, ‘ঔপনিবেশিক বাহিনী ও তাদের অপরাধ কেউ ক্ষমা করবে না।’
গত সপ্তাহে একসময় ফ্রান্সের দখলে থাকা আলজেরিয়া, মরক্কো ও তিউনিসিয়ায় ভিসা সংখ্যা কমানোর ঘোষণা দেয় ফরাসি সরকার। ওই ঘোষণার পর ফরাসি রাষ্ট্রদূতকে ডেকে পাঠায় আলজেরিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
জানা যায়, ১৯৩৯ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে জেনারেল শার্ল দ্য গলের আহ্বানে আলজেরিয়ার তরুণরা ফ্রান্সের পক্ষে অক্ষশক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধে যোগ দেয়।১৯৪৫ সালে নাৎসি বাহিনীর বিরুদ্ধে ফ্রান্স ও মিত্র বাহিনী জয় লাভ করে। বিজয় উদযাপনের জন্য ৮ মে আলজেরিয়ার সেফিত শহরে জমায়েত হয় তরুণরা। সেখানে সাল বোউজিত নামে এক কিশোর স্বাধীন আলজেরিয়ায় পতাকা নিয়ে এলে আলজেরীয়দের অনেকেই স্বাধীনতার স্বপক্ষে স্লোগান দেয়া শুরু করে। এসময় সেখানে জেনারেল দুঁভালের নেতৃত্বে ফরাসি সেনারা গুলি চালালে ওই কিশোর নিহত হয়। মুহূর্তে পুরো এলাকায় তাণ্ডব শুরু করে ফরাসি সেনারা। ওই দিন সেতিফে এক হাজার আলজেরীয় নিহত হয়। সেতিফের পাশের শহর গুয়েলমাতে একই দিন বিক্ষোভ মিছিল বের করে আলজেরীয়রা। সেখানেও গুলি চালায় ফরাসি সেনারা।
এর ফলে শহর দুটিতে ফরাসি বসতি স্থাপনকারীদের সঙ্গে দাঙ্গায় জড়িয়ে পড়ে আলজেরীয়রা। ইউরোপীয় ইতিহাসবিদদের মতে, দাঙ্গায় ১০৩ জন ফরাসি নাগরিক নিহত হয়েছে। তবে আলজেরীয়রা বলেছে, নিহত ফরাসির সংখ্যা সর্বসাকুল্যে ১২। এর প্রতিক্রিয়ায় আলজেরিয়াজুড়ে হত্যার উৎসবে মেতে ওঠে ফরাসি সেনারা। আলজেরীয়দের দমনের জন্য তাৎক্ষণিক যে গণহত্যা চালানো হয়, তাতে নিহত হয় প্রায় ৪৫ হাজার লোক।
ব্রিটিশ ঐতিহাসিক অ্যালিস্টার হর্ন তার বিখ্যাত অ্য সেভেজ ওয়্যার অব পিস বইতে লিখেছেন, অভিযান চলাকালে নৃশংসভাবে আলজেরীয় নারীদের ধর্ষণ করে ফরাসি সেনারা। ধর্ষণ শেষে অনেক নারীর স্তুন তারা কেটে ফেলে। হত্যার পর অনেকের মৃতদেহ বিকৃত করতেও কসুর করেনি সেনারা। এই গণহত্যার পর আলজেরিয়ার জনগণের স্বাধীনতার আন্দোলন জোরদার হয়। ১৯৫৪ সালে ফরাসি ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে আলজেরীয়দের গণজাগরণ শুরু হয়। শেষ পর্যন্ত ১৯৬২ সালে ফরাসিরা আলজেরিয়াকে স্বাধীনতা দিতে বাধ্য হয়।
একটি প্রজম্ম ভুল করলে আরেকটি প্রজম্ম ক্ষমা চাইবে— সভ্যতার আলো মানুষকে তাই শিক্ষা দিয়েছে। কিন্তু নিজেদের স্বার্থ রক্ষার বেলায় যারা মানবাধিকারের তুবড়ি ছুটাতে দক্ষ সেই ফরাসিরা কিন্তু আজও আলজেরিয়ায় চালানো গণহত্যার বিষয়ে ক্ষমা চায়নি। ২০১২ সালে ফরাসি প্রেসিডেন্ট ফ্রাঁসোয়া ওঁলাদ আলজেরিয়ার জনগণের ওপর চালানো ‘হত্যাযজ্ঞের’ কথা স্বীকার করেছেন। তবে ওই নির্মমতার জন্য ফ্রান্সের পক্ষ থেকে ক্ষমা চাননি তিনি!
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৯৫৭
আপনার মতামত জানানঃ