ফ্রান্সের জাতীয় মানবাধিকার বিষয়ক কর্তৃপক্ষের এক রিপোর্টে দেখা গেছে ফ্রান্সে মুসলিম বিরোধিতা বাড়ছে। গত দুই বছর করোনা মহামারীতে মধ্যে কঠোর লকডাউনের মধ্যেও মুসলিমবিরোধী কর্মকাণ্ড বেড়েছে। এর পেছনের কারণ নিয়ে তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে উঠে এসেছে বেশ কিছু চাঞ্চল্যকর দিক। প্রশ্ন উঠছে- ইসলাম ও মুসলিমদের কি হুমকি হিসেবে দেখে ফ্রান্স? কিন্তু কেন? এর পরিণতিই বা কী?
২০২০ সালে ফ্রান্সের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা দফতরের প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ইসলাম, ইহুদি ও বর্ণবাদের বিরোধিতা বিষয়ক কর্মকাণ্ড ও হুমকির সাথে সংশ্লিষ্ট অভিযোগ এসেছে এক হাজার ৪৬১টি। ওই প্রতিবেদনে ইহুদি ও বর্ণবাদের বিরোধিতা বিষয়ক কর্মকাণ্ড ও হুমকির সংখ্যা কমলেও মুসলিম ও ইসলাম ধর্মের বিরোধীতা বেড়েছে ৫২ শতাংশ।
ফ্রান্স ছাড়তে চাইছে মুসলিমরা
ফ্রান্সে থামছে না মুসলিমবিদ্বেষী হামলা। দেশটির মুসলিম কমিউনিটিতে চাপা আতঙ্কের সৃষ্টি করছে। ইসলামিক কমিউনিটি সেন্টারের সামনে শূকরের মাথা ও চামড়া রেখে গেছে ইসলামবিদ্বেষীরা। ফ্রান্সে ইসলামবিদ্বেষী তৎপরতা উদ্বেগজনক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে।
তুরস্কের রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা আনাদুলু এজেন্সির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ফ্রান্সের দক্ষিণ-পশ্চিমে লট-ইট-গ্যারোন শহরের মুসলিম মালিকানাধীন একটি গ্রোসারি স্টোরে আগুন দেয়ায় পুরো স্টোরটি পুড়ে গেছে। এ সময় দেয়ালে হামলাকারীরা নিও-নাজিদের (নব্য নাৎসি) প্রতীক স্বস্তিকা একে দেয়। ইতোমধ্যে পাবলিক প্রসিকিউটর হামলার তদন্ত করছে।
এ ধরনের ঘটনা মুসলিম কমিউনিটিতে চাপা আতঙ্কের সৃষ্টি করছে। স্থানীয় সংবাদমাধ্যমকে মুসলিম কমিউনিটি নেতা আবদেললতিফ মেললৌকি দেশব্যাপী ইসলামবিদ্বেষী হামলা বৃদ্ধিতে সবার দৃষ্টি আকর্ষণের অনুরোধ করেছেন।
এর মাঝেই ফরাসি মুসলিমরা দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। এমনই খবর পাওয়া যাচ্ছে বিশ্বের বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে। ইতোমধ্যে ফরাসি মুসলিমদের দেশত্যাগের ঘটনা গণমাধ্যমে ব্যাপক প্রচার পেয়েছে। গত বুধবার লে জার্নাল দু দিমানচেতে প্রকাশিত একটি নিবন্ধে উল্লেখ করা হয়, ফ্রান্সে ইসলামবিদ্বেষ বৃদ্ধির ফলে শত শত ফরাসি মুসলিম এখন তুরস্কে বসবাসকেই পছন্দ করছেন।
নিবন্ধে বলা হয়, উত্তর আফ্রিকার অনেক তরুণ উপসাগরীয় দেশগুলোয় বসবাস করছে। কিন্তু অর্থনৈতিকভাবে উন্নত, পশ্চিমা দেশের মুসলিমরা বসবাসের জন্য তুরস্ককেই অভিবাসন গন্তব্য হিসেবে নির্ধারণ করছেন।
ঠিক তেমন একজন ব্যক্তি হলেন ড. জাকি তুভাতি। ড. জাকি হলেন আলজেরিয়ান বংশোদ্ভূত একজন ফরাসি মুসলিম। পেশায় তিনি একজন চিকিৎসক। অ্যানেস্থেসিওলজিস্ট হিসেবে প্যারিসের হাসপাতালে কাজ করেন তিনি। ২০ বছর ধরে ফ্রান্সে বসবাস করছেন।
কিন্তু তার ধর্ম ও সংস্কৃতির কারণে ফ্রান্সে ক্রমাগত বৈষম্যের শিকার হতে হচ্ছে তাকে, তুরস্কের পত্রিকা ডেইলি সাবাহকে এমনটিই জানিয়েছেন ড. জাকি।
তাই তিনি তুরস্কে বসবাস করতে ইচ্ছুক। চিকিৎসা পেশা চর্চা করার জন্য তুরস্ক থেকে ফ্রান্সের ডিগ্রির সমতুল্য ডিগ্রি চান। তিনি তা অর্জনের জন্য এরই মধ্যে পড়াশোনা শুরু করেছেন। এ জন্য তাকে বেশ কিছু পরীক্ষা দিতে হবে। তুর্কি ভাষাও শেখা শুরু করেছেন। নিজের সন্তানদের ভর্তি করেছেন তুর্কি স্কুলে।
তিনি বলেন, আমি তুরস্ককে খুব ভালোবাসি। এটি একটি মুসলিম দেশ এবং আমি যা খুঁজছি তার সবকিছুই এর মধ্যে রয়েছে।
তবে ডা. জাকি তুরস্কে স্থায়ী হওয়ার আগে তিনি দেশটি ঘুরে এসেছেন। তিনি তুরস্কের সামাজিক পরিবেশ খুবই পছন্দ করেছেন।
তিনি বলেন, আমি তুরস্ককে খুব ভালোবাসি। এটি একটি মুসলিম দেশ এবং আমি যা খুঁজছি তার সবকিছুই এর মধ্যে রয়েছে।
আমি শুধু ভেবেছিলাম কোন দেশটি বেছে নেয়া উচিত। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো মুসলিম দেশ হওয়া। তা ছাড়া আমি একটি ভালো জীবন চাই। সে কারণেই আমি তুরস্ককে বেছে নিয়েছি।
ফ্রান্সে মুসলিমদের বর্তমান জীবনযাপন নিয়ে ড. জাকি বলেন, ‘ফ্রান্সে মুসলিম রীতিনীতি মেনে জীবনযাপন করা খুবই কঠিন। আমার জীবনে ধর্ম খুব গুরুত্বপূর্ণ। সে কারণেই আমি ফ্রান্স ছেড়ে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’
ফরাসি মুসলিমদের এই ক্রমাগত দেশত্যাগ নিয়ে ‘ফ্রান্স থেকে মুসলিমদের নীরব ফ্লাইট’ শিরোনামে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে নিউ ইয়র্ক টাইমসও। প্রতিবেদনে বলা হয়, ফ্রান্স ত্যাগকারী মুসলিমদের সংখ্যা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা এক গভীর সংকটকেই ইঙ্গিত করছে।
যে কারণে এই মুসলিম বিদ্বেষ
এর কারণ খুঁজতে যেয়ে একটা প্রশ্ন সামনে এসেছে। ইসলাম ও মুসলিমদের থ্রেট মনে করে কি ফ্রান্স? মনে হয়, ভয়ংকর থ্রেট মনে করে তারা। কারণ ফ্রান্সে হুহু করে বাড়ছে মুসলমানদের সংখ্যা। ফ্রান্সের মোট জনসংখ্যা যেখানে প্রায় ৭ কোটি, সেখানে প্রায় ৭০ থেকে ৮০ লাখ মুসলমানের বাস।
মুসলমানদের জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে বিপাকে রয়েছে স্থানীয় ফরাসিরা। ফ্রান্স সরকার বৃহত্তম জনগোষ্ঠীকে খুশি করার জন্য, ভোটার বাড়ানোর জন্য, অভিবাসীদের কোনঠাসায় রাখার জন্য মুসলিম বিদ্বেষমূলক অবস্থান নিয়েছে।
এ অবস্থান রাজনৈতিক ও ক্ষমতাকেন্দ্রিক। এ অবস্থান সাংস্কৃতিকও। শুধু ফ্রান্স নয়, ইউরোপ, আমেরিকা, কানাডা সব উন্নত দেশেই আগে ছিল সাদা-কালো ভেদাভেদ, পাশাপাশি এখন ধর্মীয় বিভেদ সৃষ্টি করা হচ্ছে জোরালোভাবে। এ এক অশনিসংকেত।
ফ্রান্সের কথায় আসা যাক। সেখানে ধর্মীয় ও জনসংখ্যার ভিত্তিতে দ্বিতীয় বৃহত্তম জাতিগোষ্ঠী হচ্ছে মুসলিমরা। অনেকে উদ্বিগ্ন যে মুসলমানদের সংখ্যা আগামী ৫০ বছরে কয়েকগুণ বাড়বে। কেননা স্থানীয়দের চেয়ে মুসলমানদের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কয়েকগুণ বেশি। এ ছাড়াও অভিবাসী মুসলমান যেমন বাড়ছে, তেমনই বাড়ছে কয়েক শতাব্দী ধরে বাস করা মুসলমানদের সংখ্যা।
লক্ষণীয় ব্যাপার ফ্রান্সে মুসলমানদের অধিকাংশই আলজেরিয়া, তিউনিসিয়া, মরক্কোসহ আফ্রিকান বিভিন্ন দেশের অভিবাসী। দেশগুলো একসময় ছিল ফ্রান্সেরই কলোনি। কয়েক শতাব্দী ধরেই কলোনি দেশ ও আফ্রিকা থেকে মুসলমানরা পাড়ি জমাচ্ছে ফরাসি দেশে। ফরাসি ভাষাই গ্রহণ করছে তারা। কিন্তু বাপ-দাদার ধর্ম ছাড়তে পারছে না অভিবাসী মুসলমানরা।
ফরাসি সংস্কৃতিও পুরোপুরি গ্রহণ করতে পারছে না তারা। অভিবাসী মুসলমানদের নিজস্ব সংস্কৃতির সঙ্গে ফরাসিদের নিজস্ব সংস্কৃতির দ্বন্দ্ব যখন শুরু হয়, মুসলমানদের সংখ্যা যখন বৃদ্ধি শুরু হয়, তখন থেকেই শুরু হয় ফ্রান্সে মুসলিম বিদ্বেষ। এ বিদ্বেষ শুধু ধর্মীয় নয়, ক্ষমতা, রাজনীতি ও সংস্কৃতিরও দ্বন্দ্ব।
গবেষকেরা বলছেন, ২০৫০ সাল নাগাদ ইউরোপ, আমেরিকা ও কানাডায় অন্যতম বৃহত্তম শক্তি হয়ে উঠতে পারে মুসলমানরা। মুসলমানদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাল্টে দিতে পারে হিসাব-নিকাশ। এ কারণে শুধু ফ্রান্স নয়, উন্নত সব দেশেই মুসলিম বিদ্বেষ ছড়ানো হচ্ছে পরিকল্পিতভাবেই। কড়াকড়ি করা হচ্ছে নাগরিকত্ব আইন, বিভিন্ন হয়রানিমূলক বিধিনিষেধ আরোপ করা হচ্ছে অভিবাসীদের।
এসডব্লিউ/এসএস/১২৪৫
আপনার মতামত জানানঃ