ফ্রান্সের ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি নির্বাচনে জিততে পারলো না প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রোর জোট। তারা সবচেয়ে বেশি আসন পেলেও পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠতা ধরে রাখতে পারেনি।
ম্যাক্রোর জোটের নাম হলো এনসেম্বল। এই মধ্যপন্থি জোটই আগে ক্ষমতায় ছিল। পার্লামেন্টেসংখ্যাগরিষ্ঠতার জন্য তাদের প্রয়োজন ছিল ২৮৯ আসন। কিন্তু ম্যাক্রোর জোট পেয়েছে ২৪৫টি আসন।
জ্যঁ লুক মেলাঞ্চের নেতৃত্বে জোট বেঁধেছেন সমাজবাদী, বামপন্থি ও গ্রিন পার্টি। তাদের বলা হচ্ছে নুপেস জোট। তারা ১৩১টি আসনে জিতেছেন। মেলাঞ্চ বলেছেন, এই ফলাফল দেখিয়ে দিচ্ছে, প্রেসিডেন্ট ব্যর্থ।
কট্টর দক্ষিণপন্থি ল্য পেন ছিলেন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ম্যাক্রোর মূল প্রতিদ্বন্দ্বী। তার নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল রেলি পার্টি ৮৯টি আসনে জিতেছে। আগের পার্লামেন্টে পেনের দল পেয়েছিল আটটি আসন। ফলে আসনপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে তারা বিপুল সাফল্য পেয়েছে এবং তৃতীয় স্থানে আছে।
এই নির্বাচনী ফলাফল পরিস্থিতিকে জটিল করে দিয়েছে। হাং পার্লামেন্ট হয়েছে, কেউই চূড়ান্ত সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাননি। ফলে রাজনৈতিক দিক থেকে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। এখন দল ও জোটগুলি ক্ষমতা ভাগাভাগি করতে পারে। সাবেক ফরাসি প্রেসিডেন্ট মিতেরঁর আমলে ১৯৮৮ থেকে ১৯৯১ পর্যন্ত এমনই হয়েছিল।
প্রসঙ্গত, গত এপ্রিলেই ম্যাক্রো দ্বিতীয়বারের জন্য ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন। কিন্তু কয়েক মাস পরেই পার্লামেন্ট নির্বাচনে সেই ম্যাক্রোই নিজের জোটকে জেতাতে পারলেন না।
রক্ষণশীল এলআর ৬১টি আসন পেয়েছে। তারাই কিং-মেকারের ভূমিকা নিতে পারে।
পার্লামেন্টে তার জোট ক্ষমতায় না এলে ম্যাক্রো তার সংস্কার কর্মসূচি রূপায়ণ করতে পারবেন না। অবসরের বয়স বাড়াতে পারবেন না। ফলে অনেক ক্ষেত্রেই তাকে বাধার মুখে পড়তে হবে।
ম্যাক্রোর মন্ত্রীরা বলেছেন, এই ফলাফল হতাশাজনক। তারা প্রথম স্থানে আছেন ঠিকই কিন্তু ফলাফল তাদের প্রত্যাশামতো হয়নি।
ম্যাক্রোর জোটের শরিক নেতা এবং স্বাস্থ্যমন্ত্রী, সমুদ্র বিষয়ক মন্ত্রী এবং পরিবেশমন্ত্রী পরাজিত হয়েছেন। সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং ম্যাক্রোর অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সহযোগী ক্রিস্টোফে ক্যাস্টানের হেরে গেছেন।
ফ্রান্সে ইসলাম সংস্কার করতে চেয়েছিলেন ম্যাক্রো
ফ্রান্সে ইসলাম ধর্মকে সংস্কার ও জঙ্গিবাদ মুক্ত করতে একটি নতুন কমিটি গঠন করেন প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রো। গত ৫ ফেব্রুয়ারি ফরাসি সরকারের গঠিত ওই কমিটিতে রয়েছেন- ধর্মবিশারদ, সাধারণ মানুষ ও নারী।
মার্কিন বার্তা সংস্থা এপির প্রতিবেদনে জানানো হয়, ফ্রান্সে ইসলামি জঙ্গিবাদের রক্তাক্ত ইতিহাস, সিরিয়ায় কয়েকশ নাগরিকের জিহাদের যোগদান এবং আফ্রিকায় জঙ্গিদের বিরুদ্ধে ফরাসি সৈন্যদের যুদ্ধের কারণে অধিকাংশই জঙ্গিবাদকে বিপজ্জনক মনে করেন।
যদিও সরকার সমালোচকরা ইসলাম ধর্মকে সংস্কারের উদ্যোগটিকে রাজনৈতিক চক্রান্ত বলে মনে করছিলেন। তাদের মতে, আগামী এপ্রিল মাসে অনুষ্ঠিত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রোর মধ্যপন্থি দলে ডানপন্থি ভোটারদের টেনে আনতেই উদ্যোগটি নেওয়া হয়েছে।
নতুন এই কমিটির নাম ‘ফোরাম অব ইসলাম ইন ফ্রান্স’। এর সমর্থকরা বলেন, এর ফলে দেশ ও দেশে বসবাসরত ৫০ লাখ মুসলিমকে নিরাপত্তা ও বিদেশিদের প্রভাব থেকে রক্ষা এবং জনজীবনে সেকুলার মূল্যবোধ ঊর্ধ্বে তুলে ধরা ফ্রান্সে মুসলিমদের ধর্মচর্চা নিশ্চিত করবে।
ধর্মকে তাদের ফরাসি পরিচয়ের অংশ বলে মনে করা অনেক মুসলিমসহ এই কমিটির সমালোচকদের মতে, সরকারের এই সর্বশেষ উদ্যোগ হলো বৈষম্য প্রক্রিয়াকে প্রাতিষ্ঠানিকতা দেওয়ার আরেকটি পদক্ষেপ। যে বৈষম্য ব্যবস্থায় সহিংস হামলা চালানো গুটিকয়েকের জন্য পুরো সম্প্রদায়কে দায়ী করা হয়। তাদের প্রকাশ্য জীবনে আরেকটি বাধা হাজির করে।
বিশ্লেষকদের মতে, কমিটিটি গঠনে বিলুপ্ত হলো ২০০৩ সালে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও সাবেক প্রেসিডেন্ট নিকোলাস সারকোজি গঠিত ‘ফ্রেঞ্চ কাউন্সিল অব মুসলিম ফেইথ’। ওই কাউন্সিল সরকার ও ধর্মী নেতাদের মধ্যে আলোচনাকারী হিসেবে ভূমিকা রাখত। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী গেরাল্ড ডারমানিন জানান, এই মাসে ম্যাক্রো সরকার কাউন্সিলটিকে বিলুপ্ত ঘোষণা করেছে। কারণ একটি মুসলিম সম্প্রদায় ও ফরাসি সমাজে ভূমিকা রাখতে পারছিল না।
সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে ডারমানিন বলেছিলেন, ইসলামে বিদেশি প্রভাবের ইতি ঘটিয়ে আমরা একটি বিপ্লব ঘটাতে চাই। ফ্রান্সে ইসলাম বিদেশিদের ধর্ম নয়, কিন্তু একটি ফরাসি ধর্ম। যে ধর্মের বিদেশি অর্থ ও কোনো কর্তৃপক্ষের ওপর নির্ভর করা উচিৎ না।
ম্যাক্রোর ইসলাম সংস্কারের পরিকল্পনায় রয়েছে- তুরস্ক, মরক্কো বা আলজেরিয়া থেকে আনার বদলে ফ্রান্সে ইমামদের প্রশিক্ষণ দেওয়া। মুসলিম সম্প্রদায়ের অনেকেই পরিকল্পনাটিকে সমর্থন করছেন।
যদিও সামগ্রিকভাবে ফরাসি মুসলিমরা প্রকল্পটি নিয়ে বিভক্ত। প্যারিসের গ্র্যান্ড মসজিদে আগত মুসল্লিদের একাংশ সতর্কতার সঙ্গে পরিকল্পনাটিকে স্বাগত জানিয়েছেন। অন্যরা বলেছেন, তাদের ধর্মকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টার মাধ্যমে সরকার অনেক বাড়াবাড়ি করে ফেলছে। তারা শুধু ইসলাম ধর্মের জন্য এমন কিছু করছে, কিন্তু খ্রিস্টীয় ধর্মে এমন কোনো পরিবর্তন আনার সাহস করতে পারবে না সরকার।
ফরাসি মুসলিমরা দীর্ঘদিন যাবত প্রাত্যহিক জীবনে কলঙ্কবাদের অভিযোগ করে আসছেন। এর মধ্যে রয়েছে- পরিচয় যাচাইয়ে পুলিশি তল্লাশি থেকে শুরু করে কাজ খোঁজা। যখনই ফ্রান্সে বা বিদেশে জন্ম নেওয়া কোনো তরুণ দ্বারা জঙ্গিবাদী হামলা হয় মুসলিমরা সন্দেহে পড়েন এবং নিন্দিত হন।
ইউরোপে দ্বিতীয় বৃহত্তম ধর্ম ইসলাম। কিন্তু এই ধর্মের কোনো একক নেতা নেই এবং একাধিক মত প্রচলিত আছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে মধ্যপন্থি সালাফিবাদী থেকে শুরু করে ধর্মের কট্টর ব্যাখ্যাদানকারী মৌলবাদী গোষ্ঠী।
উল্লেখ্য, গত বছর ফরাসি পার্লামেন্টে একটি নতুন আইন অনুমোদিত হয়। এতে মসজিদ, স্কুল ও স্পোর্টস ক্লাবে নজরদারি শক্তিশালী করার কথা বলা হয়েছে। সরকার বলছে, ইসলামি জঙ্গিদের হাত থেকে ফ্রান্সের সুরক্ষা এবং সেক্যুলারবাদ ও নারীদের অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধার প্রসারের জন্য এটি প্রয়োজন। এই আইনটি মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে উদ্বেগের জন্ম দেয়। এর আওতায় বেশ কয়েকটি মসজিদ ও কমিউনিটি গ্রুপ বন্ধ করা হয়েছে।
এসডব্লিউ/এসএস/১৬২০
আপনার মতামত জানানঃ