গত এক দশকে গোটা বিশ্বে ধূমকেতুর গতিতে উত্থান ঘটেছে ‘উবার’ সংস্থার। বর্তমানে বিশ্বের ৭২টি দেশে ছড়িয়ে পড়েছে উবারের ব্যবসা। সব মিলিয়ে এখন সংস্থার মূল্য ৪৪০০ কোটি মার্কিন ডলার।
তবে, উবারের এই বিস্ময়কর উত্থান কিন্তু একেবারেই সোজা পথে নয়। বরং, সংস্থার এই ব্যপ্তির পিছনে রয়েছে আইন ফাঁকি দেওয়া, রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে যোগসাজশ করা, আইনের ফাঁক খুঁজে তার সুযোগ নেওয়া। এমনকি, তাদের নিজেদের ক্যাব-চালকদের নিরাপত্তার বিনিময়েও তারা সংস্থার ব্যবসা বাড়াতে চেয়েছে।
সম্প্রতি, উবারের অভ্যন্তরীণ কিছু নথি ফাঁস হয়েছে। সামনে এসেছে তাদের এক ভয়ঙ্কর রূপ। ফাঁস হওয়া হাজার হাজার নথিতে দেখা গেছে, উবার কিভাবে শীর্ষ রাজনীতিবিদদের সঙ্গে দরকষাকষি করেছে এবং বিচার এড়াতে তারা কতদূর গেছে। দেখা গেছে, ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ এবং সাবেক ইইউ কমিশনার নিলি ক্রসের মতো নেতাদের কাছ থেকে উবার ব্যাপক সহায়তা পেয়েছে।
আরও দেখা গেছে, অভিযানকারী পুলিশকে কম্পিউটার অ্যাক্সেস করা থেকে বিরত রাখতে ট্যাক্সি কোম্পানির সাবেক শীর্ষ কর্মকর্তা কিভাবে ‘কিল সুইচ’ ব্যবহারের নির্দেশ দিয়েছিলেন।
দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে নয়াদিল্লিতে এক ২৫ বছর বয়সী তরুণীকে ধর্ষণ করেছিল উবার চালক। সেই ক্ষেত্রে প্রকাশ্যে দুঃখপ্রকাশ করলেও, নেপথ্যের ইমেল বলছে অভিযুক্ত ড্রাইভারের দায় নেয়নি উবার।
ওই ঘটনায় উবার সংস্থার ভারতীয় শাখায় আতঙ্ক তৈরি হয়েছিল। কীভাবে বিষয়টি সামাল দেওয়া হবে, তাই নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছিল শীর্ষ কর্তাদের মধ্যে। তারা চালকের দায় না নিয়ে, ভারতের তথ্যভাণ্ডারের ত্রুটিকে দায়ী করতে চেয়েছিল।
বলেছিল, বাণিজ্যিক লাইসেন্স দেওয়ার সময়, সরকার ভালভাবে চালকদের ব্যাকগ্রাউন্ড পরীক্ষা করেনি। উবারের কমিউনিকেশন হেড, নাইরি হাউরদাজিয়ান এক সহকর্মীকে ইমেল পাঠিয়ে বলেছিলেন, ‘মনে রাখবেন যে সবকিছু আমাদের নিয়ন্ত্রণে নেই। কখনও কখনও আমাদের সমস্যা হবে। কারণ, আমাদের অনেক কাজই অবৈধ’।
পাশাপাশি, সরকারি তদন্তের হাত থেকে বাঁচতে তারা ব্যবহার করত ‘কিল সুইচ’। কী এই কিল সুইচ? সরকারের যাতে তাদের প্রধান ডেটা সিস্টেম থেকে তথ্য সংগ্রহ করতে না পারে, তার জন্য উবার সংস্থা তাদের সফটওয়্যারটি বন্ধ করে দিত। উবার-এর অফিসে অভিযান হবে, এরকম জানতে পারলেই সংস্থার পক্ষ থেকে সংস্থার তথ্য-প্রযুক্তি কর্মীদের সফটওয়্যারটি বন্ধ করে দেওয়ার নির্দেশ পাঠানো হত। ফলে, তাদের অফিসে হানা দিয়েও, কর্তৃপক্ষ কোনও প্রমাণ সংগ্রহ করতে পারত না।
দ্য গার্ডিয়ান-এর মতে ভারত, ফ্রান্স, নেদারল্যান্ডস, বেলজিয়াম, হাঙ্গারি এবং রোমানিয়ায় অবস্থিত উবারের বিভিন্ন কার্যালয়ে পুলিশি অভিযানের সময় অন্তত ১২ বার এই কৌশল প্রয়োগ করা হয়েছে। ২০১৪ সালে এবং ২০২১ সালে, উবারের বেঙ্গালুরু অফিসে দুবার অভিযানের সময় এই কৌশল প্রয়োগ করা হয়েছিল।
‘উবার ফাইলস’ নামে উবারের লক্ষাধিক গোপন নথি ফাঁস করেছে ইন্টারন্যাশনাল কনসোর্টিয়াম অব ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিস্ট (আইসিআইজে) নামের একটি সংস্থা। ২০১৩ সাল থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত উবারের লক্ষাধিক গোপন নথি রয়েছে ‘উবার ফাইলসে’। সোমবার এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে বিবিসি।
এসব নথি ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম গার্ডিয়ান, আন্তর্জাতিক কনসোর্টিয়াম অব ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিস্ট এবং আরও কয়েকটি সংবাদমাধ্যমের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। এসব নথিতে প্রথমবারের মতো দেখা গেছে, ইউরোপের ট্যাক্সি শিল্পে বিঘ্ন ঘটাতে বন্ধু রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে বছর জুড়ে লবিং করেছে উবার। এই প্রচারণায় কোম্পানিটি ৯ কোটি ডলার খরচ করেছে।
বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়, ফাঁস হওয়া গোপন নথির সংখ্যা ১ লাখ ২৪ হাজার। এর মধ্যে ৮৩ হাজার ইমেইল কনভারসেশন ও ১ হাজার অন্যান্য কনভারসেশন রয়েছে।
ফাঁস হওয়া গোপন নথিতে বিশ্বের শীর্ষ রাজনীতিকদের বিরুদ্ধে উবারকে গোপনে অনৈতিক সহায়তা দেওয় বিষয়টি উঠে এসেছে। ফাঁস হওয়া নথি পর্যালোচনায় দেখা যায়, শীর্ষ রাজনীতিকরা গোপনে উবারকে অনৈতিক সুবিধা দিয়েছেন। উবারও বিভিন্ন বিষয়ের বিচার এড়াতে তদবির করেছে।
ফাঁস হওয়া নথিতে উঠে এসেছে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের সাবেক কমিশনার নিলি ক্রোসের মতো নেতাদের নাম। তারা গোপনে উবারকে অনৈতিক সহায়তা দিয়েছেন।
ট্যাক্সি খাতকে ক্ষতিগ্রস্থ করে ইউরোপের বাজারে ব্যবসা সম্প্রসারণ করতে পছন্দের নেতাদের সহায়তা নিয়েছিল উবার। ফ্রান্সের ট্যাক্সি চালকেরা উবারের বিরুদ্ধে রাজপথে সহিংস বিক্ষোভ করলে বর্তমান প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ উবারের বিতর্কিত বস ট্রাভিস কালানিককে আশ্বস্ত করেন যে, তিনি কোম্পানির পক্ষে আইন সংস্কার করবেন।
অর্থমন্ত্রী থাকাকালীন ফ্রান্সে সংস্থার ব্যবসা বৃদ্ধিতে অবৈধভাবে সহায়তা করেছিলেন ম্যাক্রোঁ, ফাঁস হওয়া নথিগুলি থেকে এমনটাই জানা গিয়েছে। এমনকি, ম্যাক্রোঁ না কি ফরাসি মন্ত্রিসভায় বিরোধী পক্ষের সঙ্গে একটি গোপন ‘চুক্তি’ পর্যন্ত করেছিলেন। এছাড়াও, আপাতদৃষ্টিতে সংস্থার বৃদ্ধির জন্য জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ স্কোলজ, মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গেও ঘনিষ্ঠতা বাড়িয়েছিলেন কালানিক।
ফাঁস হওয়া নথিতে আরও দেখা গিয়েছে, দাঙ্গা-হিংসার মতো ঘটনাকেও উবার তাদের ব্যবসা বৃদ্ধির কাজে লাগিয়েছিল। এর জন্য নিজেদের চালকদেরই নিরাপত্তাকে উপেক্ষা করেছিল সংস্থা। প্যারিসে ট্যাক্সি ধর্মঘট এবং তাকে কেন্দ্র করে দাঙ্গাহাঙ্গামার সময়, একের পর এক উবারচালক হামলার মুখে পড়েছিলেন। সংস্থার প্রাক্তন সিইও কালানিক অন্যান্য কর্তাদের বলেছিলেন, ‘আমার মতে এটা (চালকদের উপর হামলা) সংস্থার জন্য অত্যন্ত মূল্যবান… এই হিংসা সংস্থার সাফল্যকে নিশ্চিত করবে।’
উবারের নিষ্ঠুর ব্যবসায়িক নীতি নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হয়েছে। তবে এই প্রথমবারের মতো এই ব্যাপকতার গভীরতা এবং লক্ষ্য অর্জনে তারা কতদূর যেতে পারে তা স্পষ্ট হয়েছে।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের সাবেক কমিশনার নিলি ক্রোস তার মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই উবারের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার বিষয়ে কথা বলেছিলেন এবং গোপনে উবারের পক্ষে তদবির চালিয়েছিলেন। এটি ইউরোপীয় ইউনিয়নের নীতি বহির্ভূত।
ওই সময়ে উবার কেবল বিশ্বের দ্রুত বাড়তে থাকা কোম্পানি ছিল না, সবচেয়ে বিতর্কিত কোম্পানিও ছিল। যৌন হয়রানি, তথ্য চুরি, আদালত অবমাননার মতো অভিযোগ ছিল কোম্পানিটির বিরুদ্ধে। এসব ঘটনার জেরে ২০১৭ সালে সরে যেতে বাধ্য হন ট্রাভিস কালানিক।
এসডব্লিউ/এসএস/২০২৫
আপনার মতামত জানানঃ