[জেনারেল সামি সাদাত আফগান জাতীয় সেনাবাহিনীর কমান্ডার ছিলেন। তিনি আফগানিস্তানের জাতীয় সেনাবাহিনীর ২১৫ মাইওয়ান্দ সৈন্যদলের কমান্ডার হিসেবে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে তালিবানের বিপক্ষে সম্মুখ লড়াইয়ে ১৫ হাজার আফগান সেনার নেতৃত্ব দিয়েছেন। আফগান বিশেষ বাহিনীর নেতৃত্বও তাকে দেওয়া হয়; তবে ততোদিনে দেরী হয়ে যায়। নিউইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত কমান্ডার সামি সাদাতের এই আর্টিকেলটি অনুবাদ করেছেন সরকার শুভ্র। ]
সামি সাদাত
গত সাড়ে ৩ মাস ধরে আমি তালিবানের দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে দিন রাত লড়াই করেছি, বিরতিহীন, দক্ষিণ আফগানিস্তানের হেলমন্দ প্রদেশে। বারবার আক্রমণের শিকার হয়েও, তালিবানদের জয়যাত্রার মুখে লাগাম টেনে রেখেছিলাম; মারাত্মক ক্ষয়ক্ষতির মুখোমুখি হয়েও। এরপর আমাকে কাবুলে ডাকা হয় আফগানিস্তানের বিশেষ বাহিনীর নেতৃত্ব দিতে। কিন্তু ততোক্ষণে দেরী হয়ে যায়; এর মধ্যেই তালিবান শহরটাতে প্রবেশ করে ফেলে।
আমি ক্লান্ত। আমি হতাশ। আমি ক্রুদ্ধ।
গত সপ্তাহে প্রেসিডেন্ট বাইডেন বলেছিলেন, ‘যদি আফগান বাহিনী নিজেদের জন্য যুদ্ধ করতে না চায়, তাহলে মার্কিন সেনাবাহিনী তাদের হয়ে যুদ্ধ করতে পারে না; তাদের হয়ে যুদ্ধে মরতে পারে না।’
এটা সত্য যে আফগান বাহিনী যুদ্ধ করার ইচ্ছা হারিয়ে ফেলেছিল। কিন্তু এর পেছনে কারণ হিসেবে ছিল আমেরিকান অংশীদারদের হঠাৎ সেনা সরিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত এবং গত কয়েক মাস যাবৎ মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের অসম্মানজনক এবং বিশ্বাসঘাতকতাপূর্ণ বক্তব্য। আফগান বাহিনীরও দোষ আছে। এর নিজস্ব কিছু সমস্যাও আছে— পক্ষপাত, আমলাতন্ত্র। তবে দিনশেষে আমরা নিজেদের মধ্যকার বিবাদ মিটিয়ে নিয়েছিলাম কারণ আমাদের যুদ্ধে আমাদের সঙ্গীরা, অংশীদাররাও তাদের মধ্যকার নিজ নিজ বিবাদ মিটিয়ে নিয়েছিল।
এটা আমাকে কষ্ট দিচ্ছে যে মি. বাইডেন এবং পশ্চিমারা শুধু আফগান বাহিনীকে দোষ দিচ্ছে। কিন্তু এর পেছনে ঘটে যাওয়া কারণকে কেউ সামনে আনছে না। কাবুল এবং ওয়াশিংটনের রাজনৈতিক বিভেদ আফগান বাহিনীকে দুর্বল করে দিয়েছে এবং যুদ্ধে আমাদের সক্ষমতাকে সীমাবদ্ধ করে দিয়েছিল। বছরের পর বছর ধরে আমেরিকা থেকে যুদ্ধক্ষেত্রে প্রাপ্ত লজিস্টিক্যাল (সামরিক রসদ) সাপোর্ট না পাওয়া আমাদের বিকলাঙ্গ করে দিয়েছিল। আর ছিল আমেরিকান এবং আফগান নেতাদের সুস্পষ্ট নেতৃত্বের অভাব।
এটা বিশ্বাসঘাতকার বড় একটা ঘটনা। মি. ঘানির হুট করে পালিয়ে যাওয়া অবস্থা উত্তরণের জন্য তালিবানের সাথে অন্তর্বর্তী চুক্তির সব সম্ভাবনা শেষ করে দেয়। এই চুক্তি সম্ভব হলে আমরা কাবুলের নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে পারতাম এবং নিরাপদের সবাইকে সরিয়ে নিতে পারতাম। কাবুল বিমানবন্দরে আফগান নাগরিকদের এই চরম দুর্দশার মুখোমুখি হতে হতো না।
আমি আফগান সেনাবাহিনীর একজন তিন-তারাপ্রাপ্ত জেনারেল। এগারো মাস ধরে মাইওয়ান্দের ২১৫ সৈন্যদলের কমান্ডার হিসেবে দক্ষিণপশ্চিম আফগানিস্তানের ১৫ হাজার সেনাকে তালিবানে বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছি। যুদ্ধে আমি শতশত কর্মকর্তা এবং সেনা হারিয়েছি। এজন্য আমি এতোটা ক্লান্ত এবং হতাশ। আমি আফগান সেনাবাহিনীর সম্মান রক্ষার্থে বাস্তব চিত্র তুলে ধরতে চাই এখানে। আমি এখানে আফগান সেনাবাহিনীকে ভুলের দায় থেকে মুক্তি দিতে চাইছি না। কিন্তু সত্য হচ্ছে, আমাদের অনেকেই সাহসের সাথে সম্মানের সাথে যুদ্ধ করেছে। এবং পরাজিত হয়েছে আমেরিকান এবং আফগান নেতৃত্বের কাছে।
দুই সপ্তাহ আগে, তালিবানের দখল থেকে আফগানিস্তানের দক্ষিণের শহর লস্কর গাহ-এর নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে নিতে যুদ্ধ চলাকালীন প্রেসিডেন্ট আশরাফ ঘানি আমাকে আফগানিস্তানের বিশেষ বাহিনীর কমান্ডার ঘোষণা করেন; দেশের সবথেকে এলিট যোদ্ধাদের বাহিনী। আমি অনিচ্ছা সত্ত্বেও আমার সেনাদের ছেড়ে আগস্ট মাসে কাবুলে পৌঁছাই। যুদ্ধের প্রস্তুতি নিই; জানতাম না পরিস্থিতি ইতিমধ্যে কতোটা খারাপ। মি. ঘানি আমাকে কাবুলের নিরাপত্তার অতিরিক্ত দায়িত্বও দেন। কিন্তু আমি সেই দায়িত্ব পালনের সুযোগই পাইনি। তালিবান খুব নিকটে পৌঁছে যায় এবং মি. ঘানি দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান।
এটা বিশ্বাসঘাতকার বড় একটা ঘটনা। মি. ঘানির হুট করে পালিয়ে যাওয়া অবস্থা উত্তরণের জন্য তালিবানের সাথে অন্তর্বর্তী চুক্তির সব সম্ভাবনা শেষ করে দেয়। এই চুক্তি সম্ভব হলে আমরা কাবুলের নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে পারতাম এবং নিরাপদের সবাইকে সরিয়ে নিতে পারতাম। কাবুল বিমানবন্দরে আফগান নাগরিকদের এই চরম দুর্দশার মুখোমুখি হতে হতো না।
মি. বাইডেন ১৬ আগস্ট বলেছিলেন, ‘আফগান বাহিনী পরাজিত হয়েছে। কিছুক্ষেত্রে যুদ্ধ করার চেষ্টাও করেনি।’ তার এই বক্তব্যের প্রতিবাদ জানাই আমি। আমরা সাহসের সাথে যুদ্ধ করেছি, শেষ অব্দি যুদ্ধ করেছি। গত ২০ বছর ধরে যুদ্ধে আমরা ৬৬ হাজার সেনা হারিয়েছি। যা কিনা আমাদের সেনাবাহিনীর এক পঞ্চমাংশ।
তাহলে আফগান সেনাবাহিনী পরাজিত হলো কেন? এর তিনটি কারণ আছে।
প্রথমত, আমেরিকার সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে দোহায় তালিবানের সাথে করা শান্তি চুক্তি আমাদের ব্যাকফুটে নিয়ে যায়। এটা এই অঞ্চলে আমেরিকার স্বার্থ ফুরিয়ে যাওয়ার ইঙ্গিত ছিল। দ্বিতীয়ত, আমরা যুদ্ধক্ষেত্রে প্রয়োজনীর রসদ এবং অর্থ সাহায্য পাইনি। তৃতীয়ত, মি. ঘানির সরকারের দুর্নীতি; যা সেনাবাহিনীর জেষ্ঠ্য নেতৃত্ব অব্দি পৌঁছে গিয়েছিল এবং এটাই দীর্ঘদিন ধরে আমাদের সেনাবাহিনীকে অথর্ব করে রেখেছিল।
ট্রাম্প-তালিবান চুক্তি আজকের পরিস্থিতি তৈরির জন্য মূখ্য ভূমিকা পালন করেছে। এরপর পরই আমেরিকা এবং সহযোগী সেনাবাহিনী তালিবানের বিরুদ্ধে লড়াই কমিয়ে আনে। আফগান নিরাপত্তা বাহিনীতে মার্কিন বিমান বাহিনীর অংশগ্রহণের নিয়ম এক রাতেই বদলে যায়। যা তালিবনাদের উৎসাহিত করেছিল। তারা জয়ের সুযোগ পেয়েছিল এবং বুঝতে পেরেছিল তাদের শুধুই আমেরিকানদের আফগান ত্যাগ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। এর পূর্বে তালিবান আফগান বাহিনীর বিরুদ্ধে কোনও তাৎপর্যপূর্ণ যুদ্ধে জয়লাভ করেনি। ওই চুক্তির পর? প্রতিদিন ডজন ডজন সেনা নিহত হতে শুরু করে আমাদের।
তারপরেও আমরা যুদ্ধ চালিয়ে গেছি। এরপর মি. বাইডেন গত এপ্রিল মাসে নিশ্চিত করেন যে তিনি ট্রাম্পের সিদ্ধান্তে অটল থাকবেন এবং আমেরিকান সেনাদের সরিয়ে নিতে শুরু করেন। মূলত তখন থেকেই আমাদের পরাজয়ের শুরু।
আফগান সেনারা মার্কিন সেনাবাহিনীর মডেলের (উচ্চ প্রযুক্তিগত বিশেষ পরিদর্শন দল, হেলিকপ্টার এবং বিমান বাহিনী) ভিত্তিতে আমেরিকানদের দ্বারা প্রশিক্ষিত। যখন আমাদের বিমান সাহায্য পাওয়া বন্ধ হয়ে গেল এবং সামরিক রসদ গোলাবারুদ ফুরিয়ে আসতে শুরু করল, আমরা তালিবানদের কাছে পরাজিত হতে থাকলাম।
পুরো যুদ্ধেই আমাদের বোমা নিক্ষেপক বিমান (বোম্বারু বিমান), জঙ্গি বিমান এবং যাতায়াতের বিমান সরবরাহের দেখভাল করেছে ঠিকাদাররা। জুলাই মাসেই সহযোগী ১৭ হাজার ঠিকাদারদের অধিকংশই আফগান ত্যাগ করে। এর ফলে সামান্য কোনো যান্ত্রিক গোলযোগ হলেই আফগান বাহিনীর জঙ্গি বিমান, ব্ল্যাক হক হেলিকপ্টার আর সি-১৩০ পরিবহন বিমানগুলো মেরামতের অভাবে পড়ে থাকতে শুরু করে।
ঠিকাদাররা তাদের মালিকানাধীন সফটওয়্যার এবং অস্ত্র ব্যবস্থাও তাদের সাথে নিয়ে যায়। তারা নিজেরা আমাদের হেলিকপ্টার মিসাইল-ডিফেন্স সিস্টেম সরিয়ে ফেলে। আমরা যান, অস্ত্র এবং সেনাদের ট্র্যাক করার জন্য যে সফটওয়্যারের উপর নির্ভর করতাম তাও নিয়ে যায়। শত্রুর অবস্থান সম্পর্কে তাৎক্ষণিক তথ্য পাওয়ার সুযোগও আর ছিল না।
আমাদের আকাশপথে আক্রমণ করার উপায় এবং লেজার গাইডেড অস্ত্রও তখন ছিল না। আমরা তখন শুধু স্নাইপারস এবং বিস্ফোরক ডিভাইস দিয়েই যুদ্ধ চালিয়ে গেছি। যেহেতু আমরা যুদ্ধক্ষেত্রর হেলিকপ্টারের অভাবে পুনরায় সাহায্য পাঠাতে পারতাম না; সেনারা প্রয়োজনীয় সামরিক সরঞ্জামের অভাবে ভুগতো সম্মুখ লড়াইয়ে। তালিবান অনেক ঘাঁটির দখল নিয়ে নেয়। এরপর পুরো সেনাবাহিনী আত্মসমর্পণ করে।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/১৯৩৭
আপনার মতামত জানানঃ