দুর্ভিক্ষের মুখে আফগানিস্তান। ডব্লিউএফপি’র প্রতিবেদন বলছে, আফগানিস্তানের ৩ কোটি ৮০ লাখ মানুষের মধ্যে এক কোটি ১৪ লাখই কোনোমতে খেয়ে বা না খেয়ে দিন পার করছে। অপুষ্টিতে ভুগছে ২০ লাখেরৱ বেশি শিশু। আশ্রয়হীন পাঁচ লাখ ৭০ হাজারের বেশি, যাদের প্রায় ৮০ শতাংশই নারী ও শিশু।
আফগানিস্তান থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সেনা প্রত্যাহারের এক বছরেরও বেশি সময় পর তালেবান আফগানিস্তান জুড়ে ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করে। কিন্তু তালেবান সরকারের স্বীকৃতি না মেলায় বৈশ্বিক উন্নয়ন সহায়তা ও বিদেশের ব্যাংকে গচ্ছিত রিজার্ভ স্থগিত হয়ে আছে। এ অবস্থায় দেশটির অর্থনীতি ভয়াবহ আর্থিক মন্দার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।
সন্ত্রাস দমনের নামে যুক্তরাষ্ট্র জাতিসংঘকে এড়িয়ে আফগানিস্তান দখল করে নিয়েছিল। এরপর ২০টি বছর তাদের সমর্থিত সরকার বসিয়ে সে দেশে শান্তি ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চালায় এই পরাশক্তি। তাতে ব্যর্থ হলে শেষ পর্যন্ত তালেবানের সঙ্গে সমঝোতা করে সৈন্য প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়।
তাৎপর্যের বিষয় হলো, পরবর্তী সময়ে সেই যুক্তরাষ্ট্রের অনুরোধেই বিভিন্ন দেশের সরকার আফগানিস্তানের আন্তর্জাতিক ব্যাংক অ্যাকাউন্ট স্থগিত করে রাখে। একই সঙ্গে পশ্চিমা দেশগুলো আফগানিস্তানে কোটি কোটি ডলারের সহায়তা বন্ধ করে দেয়। একইসঙ্গে আফগানদের সঙ্গে সব ধরনের ব্যবসা-বাণিজ্যও বন্ধ রেখেছে তারা।
আফগানিস্তানে অবস্থানকালে বিগত ২০ বছরে যুক্তরাষ্ট্র ও তাদের মিত্ররা মিলে সন্ত্রাসবিরোধী যেসব আইনকানুন করেছিল, সেসবের দোহাই দিয়ে এসব ব্যবস্থা আফগানিস্তানের ওপরই চাপিয়ে দিয়েছে। ফলে অর্থ সংকট যেমন বেড়েছে, তেমনই তীব্র খাদ্য ঘাটতি দেখা দিয়েছে দেশটিতে।
সম্প্রতি ফুড অ্যান্ড এগ্রিকালচার অর্গানাইজেশন (এফএও) এবং বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) প্রকাশিত প্রতিবেদনে পাকিস্তান ও আফগানিস্তানকে ‘দুর্ভিক্ষের প্রাথমিক সতর্কতামূলক হট স্পট’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে।
আফগানিস্তানভিত্তিক খামা প্রেস বলছে, প্রতিবেশী দেশ হিসেবে পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের অবস্থা খুবই নাজুক। দেশ দুটিতে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংকটের অবনতি অব্যাহত রয়েছে। এমনটা চলতে থাকলে আগামী মাসগুলোতে খাদ্য নিরাপত্তা আরও তীব্রতর হবে, যা দেশ দুটিকে আরও বাজে পরিস্থিতির দিকে নিয়ে যাবে।
খরা, সংঘাত এবং অর্থনৈতিক দৈন্য- এসব কিছুর মিলিত প্রভাব আফগান জনগণের জীবিকা ও খাদ্যের ওপর ব্যাপকভাবে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। আফগানিস্তানে প্রতি তিনজনে একজন মানুষ খাদ্যাভাবে ভুগছে বলে ধারণা করছে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক সংস্থা। এ অবস্থায় সেখানে বড় ধরনের মানবিক সংকট দেখা দেয়ার আশঙ্কা রয়েছে বলে সতর্ক করেছে সংস্থাটি।
ইন্টারন্যাশনাল কমিটি অফ দ্য রেডক্রস (আইসিআরসি) এক প্রতিবেদনে বলেছে, ‘গত দুই বছরে আফগানিস্তানে বেকারের সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। অন্যান্য মানবিক সংকটের পাশাপাশি এই বেকারত্ব আফগানিস্তানে লক্ষাধিক মানুষের জীবনকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। এর মধ্যে প্রতিবন্ধীরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।’
আইসিআরসি আফগানিস্তানে বিনিয়োগ শুরু করার জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এবং উন্নয়ন সংস্থাগুলোর প্রতি আহ্বান জানিয়েছে।
কাবুলভিত্তিক টোলো নিউজের প্রতিবেদনের উদ্ধৃতি দিয়ে অর্থনীতিবিদ দরিয়া খান বাহির বলেছেন, এই সাহায্যের একটি বড় অংশ মানুষের জন্য কর্মসংস্থানের পরিবেশকে অনুকূল করতে এবং তাদের অর্থনৈতিক সমস্যা কমানোর জন্য বৃহৎ অবকাঠামোগত ও অর্থনৈতিক প্রকল্পের জন্য ব্যবহার করা প্রয়োজন।
আফগানিস্তানের সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক অংশীদার পাকিস্তান। স্বভাবতই পাকিস্তানের রাজনৈতিক টালমাটাল ও অর্থনৈতিক মন্দার প্রভাব কাবুলেও পড়ছে। ২০ বছরের মধ্যে এই প্রথম বড় একটা বড় সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে দেশটি।
বিশ্বব্যংকের প্রতিবেদনে পূর্বাভাস দেয়া হয়েছে, প্রয়োজনীয় খাদ্যের যোগান দিতে না পারায় আফগানিস্তান দুর্ভিক্ষের মতো গুরুতর ঝুঁকির সম্মুখীন হতে পারে। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে দেশটির লক্ষাধিক পরিবারের কাছে আরেকটি কঠোর শীত মোকাবেলা করার কোনো উপায় নেই।
তীব্রভাবে খাদ্য-অনিরাপদ আফগানদের মাঝে মাসিক খাদ্য ও পুষ্টি সহায়তা চালিয়ে যেতে ডব্লিউএফপি’র জরুরিভাবে ১ দশমিক ১ বিলিয়ন ডলার প্রয়োজন। এই সহায়তার জন্য আইসিআরসি’র পক্ষ থেকে বিশ্ববাসীর কাছে আবেদন জানানো হয়েছে।
ডব্লিউএফপি’র প্রতিবেদন অনুযায়ী, আফগানিস্তানের ৩ কোটি ৮০ লাখ মানুষের মধ্যে এক কোটি ১৪ লাখই কোনোমতে খেয়ে বা না খেয়ে দিন পার করছে। অপুষ্টিতে ভুগছে ২০ লাখের বেশি শিশু। দেশটিতে বর্তমানে আশ্রয়হীন মানুষের সংখ্যা পাঁচ লাখ ৭০ হাজারের বেশি, যার প্রায় ৮০ শতাংশই নারী ও শিশু।
জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থাটি আরও বলছে, এ বছরের শেষ নাগাদ দেশটিতে আরও অন্তত পাঁচ লাখ মানুষ আশ্রয়হীন হয়ে পড়বে।
এসডব্লিউএসএস/১৩৫০
আপনার মতামত জানানঃ