দেশে ডেঙ্গু ও ডেঙ্গুর উপসর্গ নিয়ে আক্রান্তের সংখ্যা পাঁচ হাজার ছাড়িয়েছে। এর মধ্যে আগস্ট মাসেই এ সংখ্যা ২ হাজার ৫৩৪। এদিকে গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে আরও ২১৩ জন নতুন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। তাদের মধ্যে ঢাকায় ১৮৮ জন ও ঢাকার বাইরে ২৫ জন।
আজ বুধবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এ তথ্য জানিয়েছে। তারা বলেছে, বর্তমানে দেশের সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে ৯০৭ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি রয়েছে।
ঢাকার ৪১টি সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি থাকা ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা আজ পর্যন্ত ৮৪১। দেশের অন্যান্য বিভাগের হাসপাতালগুলোয় ভর্তি আছে আরও ৬৬ জন রোগী।
চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ১০ আগস্ট পর্যন্ত দেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ৫ হাজার ১৯২ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। এর মধ্যে আগস্ট মাসে এখন পর্যন্ত ভর্তি হয়েছে ২ হাজার ৫৩৪ জন। এ বছরে সুস্থ হয়ে হাসপাতাল ছেড়েছে ৪ হাজার ২৬৩ জন।
দেশে ডেঙ্গুর উপসর্গ নিয়ে এখন পর্যন্ত ২২টি মৃত্যুর তথ্য রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) কাছে এসেছে। পর্যালোচনা শেষে আইডিসিআর নিশ্চিত করবে আসলে এই মৃত্যুগুলো ডেঙ্গুতে ছিল কি না।
করোনার মধ্যে ডেঙ্গুর এই বিস্তার নিয়ে উদ্বেগে রয়েছে সরকার। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের মেয়র এডিস মশা নির্মূলে নানা পদক্ষেপ নিয়েছেন। নগরীর বিভিন্ন ভবনে অভিযান চালিয়ে এডিস বিস্তারের পরিবেশ থাকায় জরিমানা করা হয়েছে। সচেতনতা বাড়াতে প্রচারও চলছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানায়, ডেঙ্গু ভাইরাস ছড়ায় মশার মাধ্যমে। অন্য মশার সঙ্গে ডেঙ্গুর ভাইরাসবাহী এডিস মশার পার্থক্য আছে। মূলত এই মশার জন্ম হয় আবদ্ধ পরিবেশে। ফলে নাগরিকরা সচেতন না হলে এই রোগ প্রতিরোধ করা কঠিন।
২০১৯ সালে ডেঙ্গু রোগে ব্যাপক প্রাণহানি ও লক্ষাধিক মানুষ আক্রান্ত হওয়ার পর গত বছর সতর্ক অবস্থানে ছিল ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন। তারপরও ২০২০ সালে সারা দেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছিল ১ হাজার ৪০৫ জন, যাদের মধ্যে ৬ জন মারা যায়।
২০১৯ সালে ডেঙ্গুর ভয়াবহ বিস্তারে আক্রান্ত হয় ১ লাখের বেশি মানুষ। তাদের মধ্যে মৃত্যু হয় ১৭৯ জনের। গত বছর সংক্রমণের মাত্রা অনেকটা কম থাকলেও এ বছর পরিস্থিতি ক্রমেই খারাপের দিকে যাচ্ছে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কীটতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক কবিরুল বাশার অনলাইনভিত্তিক এক সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ‘আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাসে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা আরও বেড়ে যাবে। শহরের মানুষ ঈদের জন্য গ্রামের বাড়িতে যাওয়ায় ৬৪টি জেলায় ছড়িয়ে পড়ছে ডেঙ্গু। ঢাকা শহরের সরকারি-বেসরকারি স্থাপনা এখন লকডাউনের কারণে বন্ধ, এগুলো এডিস মশার প্রজননের বড় ক্ষেত্র।’
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক শারফুদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘ডেঙ্গু জ্বর প্রতিরোধে জরুরিভিত্তিতে মশা নিধন কার্যক্রম আরও জোরদার করতে হবে। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম বাড়াতে হবে, এডিস মশার উৎপত্তিস্থল ধ্বংস করতে হবে। এসব উদ্যোগ বাস্তবায়ন করলে ডেঙ্গুর প্রকোপ কমতে পারে।’
ডেঙ্গু পরিস্থিতি মহামারির দিকেই যাচ্ছে
আজ বুধবার সেন্টার ফর গভর্নেন্স স্টাডিজ (সিজিএস) কর্তৃক আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে কীটতত্ত্ববিদ ড. মঞ্জুর আহমেদ বলেছেন, ডেঙ্গু পরিস্থিতিকে এখনো মহামারি বলা যাচ্ছে না। তবে সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় এটি মহামারি হওয়ার পর্যায়ে আছে। করোনা মহামারির কারণে হাসপাতাল বা স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলো থেকে বিস্তারিত কোনো তথ্য না আসায় সঠিকভাবে বলা যাচ্ছে না।
‘ঢাকায় ডেঙ্গু পরিস্থিতি এবং ডেঙ্গু মহামারি প্রতিরোধে করণীয়’ শীর্ষক এই সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। এতে সিজিএস-এর নির্বাহী পরিচালক জিল্লুর রহমানের সঞ্চালনায় বক্তব্য দেন সিজিএসের চেয়ারম্যান ও কীটতত্ত্ববিদ ড. মঞ্জুর আহমেদ চৌধুরী এবং মেডিকেল কীটতত্ত্ববিদ ও আইইডিসিআরের সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা তৌহিদ উদ্দিন আহমেদ, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. জিএম সাইফুর রহমান।
এ সময় সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দিয়ে বক্তারা বলেন, ডেঙ্গুর বর্তমান পরিস্থিতি মহামারির দিকেই যাচ্ছে।
সংবাদ সম্মেলনের শুরুতেই ড. মঞ্জুর আহমেদ চৌধুরী ডেঙ্গি মহামারির শঙ্কার কথা জানিয়ে বলেন, চলমান কোভিড-১৯ মহামারির সময়ে আরেকটা ডেঙ্গু মহামারি হলে দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ভেঙে পড়বে। এই মহামারি প্রতিরোধে কর্তৃপক্ষের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন তিনি। লার্ভা নিধন না করে পূর্ণাঙ্গ এডিস মশা নিধনের প্রতি জোর দিতে বলেছেন তিনি। বিশ্বের অন্যান্য দেশ এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এডিস মশার বিস্তার রোধে যেসব কার্যক্রম গ্রহণ করার দিকে নজর দিয়েছে, সেগুলো আমাদের দেশে প্রয়োগের জন্য তিনি বিশেষ আহ্বান জানান।
এডিস নিধনের চলমান পদ্ধতি ‘অবৈজ্ঞানিক’
এডিস নিয়ন্ত্রণে সিটি করপোরেশন বা সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন উদ্যোগ নেয়ার কথা বলা হচ্ছে। তবে রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইসিডিআর) সাবেক মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও কীটতত্ত্ববিদ ড. তৌহিদ উদ্দিন আহমেদ মনে করছেন, এসব উদ্যোগ ‘অবৈজ্ঞানিক’।
এডিস নিয়ন্ত্রণে সিটি করপোরেশন বা সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন উদ্যোগ নেয়ার কথা বলা হচ্ছে। তবে রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইসিডিআর) সাবেক মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও কীটতত্ত্ববিদ ড. তৌহিদ উদ্দিন আহমেদ মনে করছেন, এসব উদ্যোগ ‘অবৈজ্ঞানিক’।
ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ে বুধবার সকালে সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজের (সিজিএস) এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এমন মন্তব্য করেন।
তৌহিদ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘এডিস মশা নিধনে সরকার ও সিটি করপোরেশন যে উদ্যোগ নিয়েছে তা সঠিক নয়। সরকাকে অনুরোধ করব, মশা নিধনে সঠিক পদক্ষেপ নিতে। করোনার মধ্যে ডেঙ্গু কিন্তু ভয়াবহ আকারে দেখা দিচ্ছে। আমার পরিবারেও একজন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছে। সে করোনা আক্রান্ত হওয়ার ভয়ে চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে ভর্তি হতে ভয় পাচ্ছে।’
প্রচলিত উদ্যোগের সমালোচনা করে তিনি বলেন, ‘তিন দিনে এক দিন জমা পানি ফেলে দিন, এমন স্লোগান নিয়ে এডিস মশা নিধন করা যায়নি। বাস্তবে আট থেকে ১০ দিনের আগে একটি মশা বংশবিস্তার করতে পারে না। এ কারণে বিশ্বের সব দেশে সাত দিনে এক দিন পানি জমে থাকা পানি ফেলে দেয়ার কথা বলা হয়।’
মশা নিধনে নেয়া বিভিন্ন পদক্ষেপের সমালোচনা করে তিনি বলেন, ‘বর্তমান পরিস্থিতিতে লার্ভা নয়, অ্যাডাল্ট (বয়ঃপ্রাপ্ত) মশা নিধনে সিটি করপোরেশনকে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাতে হবে।’
ড. তৌহিদ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘বর্তমানে মশার লার্ভা মারার যে ব্যাপক প্রচেষ্টা দেখা যাচ্ছে, তা এই মুহূর্তে দরকার নেই। লার্ভা নিধনে নিয়মিত কর্মসূচি চালিয়ে গেলেই হবে। বর্তমানে অ্যাডাল্ট মশা মারার চেষ্টা করতে হবে।
‘বারবার নির্মাণাধীন ভবনের কথা বলা হচ্ছে, কিন্তু নির্মাণাধীন ভবনে ফাইন করে চলে আসা হচ্ছে, অথচ সেখানকার অ্যাডাল্ট মশাগুলোর কী হবে? সেখানে যদি মশা মারার ব্যবস্থা গ্রহণ না করা হয়, তাহলে অ্যাডাল্ট মশা তো থেকেই যাবে। এ জন্য ঢাকা শহরে নির্মাণাধীন ভবনে ফগিংয়ের মাধ্যমে অ্যাডাল্ট মশা মারার ব্যবস্থা সিটি করপোরেশনকে করতে হবে। প্রয়োজনে বাড়ি বাড়ি যেতে হবে। এখন সমস্ত প্রচেষ্টা এবং অর্থ অ্যাডাল্ট মশা মারার জন্য ফগিংয়ে খরচ করতে হবে।’
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/২২৪০
আপনার মতামত জানানঃ