
বাংলাদেশে বর্ষা মানেই শুধু বৃষ্টি নয়, বরং এক অদৃশ্য আতঙ্কের নাম—ডেঙ্গু। প্রতিবছর এই সময় ঘুরেফিরে আসে ডেঙ্গু জ্বর, আর তার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ে মানুষের দুর্ভোগ, হাসপাতালের ভিড়, ও মৃত্যু সংবাদ। ২০২৫ সালেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। বরং এবছর যেন নতুন করে আমাদের মনে করিয়ে দিচ্ছে, কতটা উদাসীন আমরা নিজের জীবনের সুরক্ষা নিয়ে, আর কতটা অকার্যকর ও দায়িত্বহীন আমাদের স্বাস্থ্য ও স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাপনা।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ৩ জুলাই পর্যন্ত দেশে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১১ হাজার ৪৫৬ জনে। এই অল্প সময়েই প্রাণ হারিয়েছেন ৪৫ জন। শুধু গত ২৪ ঘণ্টায় আক্রান্ত হয়েছেন ৩৫৮ জন এবং মারা গেছেন ১ জন। ভয়াবহ তথ্য হলো—বরিশাল বিভাগেই এক দিনে আক্রান্ত হয়েছেন ১৫০ জন, যা দেশের অন্য যেকোনো অঞ্চলের তুলনায় সবচেয়ে বেশি। রাজধানী ঢাকাতেও পরিস্থিতি উদ্বেগজনক, ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটিতে আক্রান্ত হয়েছেন মোট ৭৮ জন।
চট্টগ্রামে ৩২, খুলনায় ১৪, রাজশাহীতে ২৯, ময়মনসিংহে ৫, রংপুরে ৩ এবং সিলেটে ২ জনের আক্রান্ত হওয়ার খবরে প্রমাণ হয়—ডেঙ্গু এখন শুধু শহরের সমস্যা নয়, বরং সারাদেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়া এক মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি। অথচ আমরা কী করছি?
সত্য হলো, আমরা কিছুই করছি না। বরং বছর ঘুরে এলেও পুরনো ভুলগুলোই বারবার করা হচ্ছে। বর্ষা এলেই বাড়ে মশা, জমে থাকে পানি, ড্রেনেজ ব্যবস্থা হয় অচল, আর নগরবাসী বাঁচার চেষ্টা করে ‘মশারি টাঙিয়ে’ বা ‘মশার ধূপ জ্বালিয়ে’। অথচ যাদের দায়িত্ব ডেঙ্গু মোকাবেলায় সমন্বিত পদক্ষেপ নেওয়া, সেই কর্তৃপক্ষেরা সভা আর প্রেস বিজ্ঞপ্তি দিয়েই দায়িত্ব সেরে নিচ্ছেন।
ঢাকা শহরে প্রতিদিনের বাস্তবতা হলো—বর্জ্য ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা, জলাবদ্ধতা ও অপরিচ্ছন্ন পরিবেশ। স্থানীয় সরকার মশা নিধনে স্প্রে করছে বলে দাবি করলেও বাস্তবে তা এতটাই সীমিত, যে জনগণ স্প্রের গন্ধে নয়, বরং মৃত্যুভয়ে শিউরে উঠছে। নাগরিকদের মধ্যে কোনো সচেতনতা তৈরির কার্যকর উদ্যোগ নেই, নেই কোনো এলাকাভিত্তিক জরিপ বা ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা শনাক্তের প্রকল্প। বরিশালের মতো জায়গায় যেখানে একদিনেই ১৫০ জন আক্রান্ত হচ্ছেন, সেখানে কি বিশেষ কোনো অভিযান শুরু করা হয়েছে? উত্তর—না।
সবচেয়ে দুঃখজনক হলো, দেশের সাধারণ মানুষ এই সংকটকেও ভাগ্যের খেলা ভেবে নিচ্ছেন। হাসপাতালগুলোতে জায়গার অভাব, চিকিৎসার ঘাটতি, আর প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা যেন নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। রোগীর পরিবারগুলো দিশেহারা, আবার কেউ কেউ হয়তো আর চিকিৎসার সুযোগই পাচ্ছেন না। কিন্তু এসব সমস্যা যেন আর কাউকে নাড়ায় না—না মিডিয়াকে, না প্রশাসনকে, না রাজনীতিকদের।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দেওয়া তথ্যে দেখা গেছে, আক্রান্তদের মধ্যে ৫৯ দশমিক ১ শতাংশ পুরুষ এবং ৪০ দশমিক ৯ শতাংশ নারী। অর্থাৎ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হচ্ছে সব বয়সের, সব শ্রেণির মানুষ। এই তথ্যও বোঝায়, এটি আর কোনো নির্দিষ্ট শ্রেণির সংকট নয়, বরং একটি জাতীয় দুর্যোগ। অথচ ডেঙ্গুকে এখনো “বাল্য অসুখ” বা “তেমন কিছু না” ভেবে চুপ করে থাকেন অনেকে, যার ফলশ্রুতিতে মৃত্যুর সংখ্যা কেবল বাড়তেই থাকে।
চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসেই ১১ হাজার ৪৫৬ জন আক্রান্ত, ৪৫ জন মৃত্যুবরণ করেছেন—এটা কোনো ছোটখাটো তথ্য নয়। এর মানে প্রতি সপ্তাহে গড়ে প্রায় ৪৩০ জন নতুন করে আক্রান্ত হচ্ছেন, আর প্রতি চার দিনে একজন করে মানুষ মারা যাচ্ছেন। যদি এই গতিতে চলতে থাকে, তবে বছর শেষে কতজন আক্রান্ত হবেন বা কতজন মৃত্যুবরণ করবেন, তার হিসেব করতেও শিউরে উঠতে হয়।
বিশেষজ্ঞরা বারবার বলে আসছেন, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে হলো সম্মিলিত সচেতনতা, নগর ব্যবস্থাপনায় ব্যাপক সংস্কার, ও জনগণের অংশগ্রহণ। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমাদের দেশে এসব কেবল ‘বক্তব্যের বিষয়’। মাঠপর্যায়ে নেই কোনো স্থায়ী ও কার্যকর ব্যবস্থা। নেই গবেষণা বা তথ্যভিত্তিক পরিকল্পনা। নেই কোনো শক্তিশালী পর্যালোচনা।
এই পরিস্থিতিতে প্রশ্ন জাগে—আর কত মৃত্যু হলে আমরা সজাগ হবো? আর কত হাসপাতাল ভরে উঠলে আমরা বলবো, “এবার কিছু করা দরকার”? আর কত শিশুর মৃত্যু দেখলে আমরা নিজেদের গা-ঝাড়া দেব?
ডেঙ্গু শুধু একটি রোগ নয়, এটি একটি আয়নার মতো—যেখানে দেখা যায় রাষ্ট্রের ব্যর্থতা, নাগরিক সমাজের উদাসীনতা, এবং একটি ভঙ্গুর ব্যবস্থাপনার নগ্ন চেহারা। আর তাই ডেঙ্গু নিয়ে শুধু সংবাদে আতঙ্ক নয়, দরকার সচেতনতা, কার্যকর ব্যবস্থা ও জবাবদিহি। না হলে প্রতিবছরের মতো এ বছরও আমরা শুধু সংখ্যার খাতা খুলে মৃত্যু গুনে যাবো।
চাইলে এই ফিচারটা আরও বড় বা সংযোজিত করতে পারি, কিংবা উপসংহারে সমাধানের সুপারিশও যোগ করতে পারি। জানালে সাথে সাথে করব।
আপনার মতামত জানানঃ