গত বছরের জানুয়ারির চেয়ে চলতি বছরের জানুয়ারিতে দেশে দ্বিগুণ ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত ও মৃত্যু হয়েছে। রোগতত্ত্ব ও জনস্বাস্থ্যবিদরা আশঙ্কা করছেন, বছরের শুরুতে যে পরিসংখ্যান প্রকাশ পাচ্ছে তাতে গত বছরের তুলনায় পরিস্থিতির ‘ভয়ংকর’ রূপ প্রকাশ পাচ্ছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারিতে সারা দেশে ১ হাজার ৫৫ জন ডেঙ্গু রোগী চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। এর মধ্যে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছে ১৪ জন। আর ফেব্রুয়ারির শুরু থেকে গতকাল পর্যন্ত হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে ১৬৯ জন, যার মধ্যে দুজনের মৃত্যু হয়েছে।
অন্যদিকে গত বছরের জানুয়ারিতে ৫৬৬ জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল। মারা গিয়েছিল ছয়জন। আর ১১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ৭৮ জন নতুন করে শনাক্ত হয় এবং দুজনের মৃত্যু হয়।
বাংলাদেশে ডেঙ্গু পরিস্থিতি আগের চেয়ে ভালো হওয়ার সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না বলে মন্তব্য করেছেন রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) প্রধান পরামর্শক ডা. মুশতাক হোসেন। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ মানুষের আয়ত্তের মধ্যে। জলবায়ুর পরিবর্তনে পরিস্থিতি কিছুটা প্রভাবিত হচ্ছে।
তবে অন্যান্য বিষয়ের ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশ পিছিয়ে রয়েছে। অনেক দেশে রোগী বেশি থাকলেও আমাদের দেশের মতো এত মৃত্যু নেই। মৃত্যু ঠেকাতে রোগী ও রোগ ব্যবস্থাপনার কথা দীর্ঘদিন ধরে বলা হচ্ছে। শুধু পানির পাত্র উল্টে দিলেই চলবে না। সার্বিক বর্জ্য ও পানি ব্যবস্থাপনা ঠিক নেই। গত বছরের চেয়েও এ বছর ডেঙ্গু ভয়াবহভাবে বৃদ্ধি পাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিচ্ছে।’
এ রোগতত্ত্ববিদের মতে, ডেঙ্গু রোগ ও রোগী ব্যবস্থাপনার কোনো কার্যক্রমই বিজ্ঞানসম্মতভাবে হচ্ছে না। সব কার্যক্রম হাসপাতালভিত্তিক। জনগোষ্ঠীকে সম্পৃক্ত করে কমিউনিটিভিত্তিক কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে। প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানগুলোয় ডেঙ্গু শনাক্তের ব্যবস্থা রাখতে হবে। প্রাদুর্ভাব বাড়লে হাসপাতালগুলোর মেঝেতে রোগী রাখতে হয়। চিকিৎসা কেন্দ্রের মেঝেতে রোগীকে রাখা অর্থাৎ ওই রোগ নিয়ন্ত্রণের বাইরে গেছে, যেমনটি গত বছর হয়েছিল।
বিষয়টি জনস্বাস্থ্যের জরুরি অবস্থা (পাবলিক হেলথ ইমার্জেন্সি)। তবে দেশের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বিষয়টি কখনই স্বীকার করে না। প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও বিশেষায়িত স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানগুলো সঠিকভাবে কাজে লাগাতে হবে। রোগী শনাক্ত হওয়া মানেই তাকে মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে, এ ধারণা ভুল। যাদের অবস্থা সংকটাপন্ন তাদেরই টারশিয়ারি পর্যায়ের হাসপাতালে আনতে হবে। বাকিদের সঠিকভাবে পর্যবেক্ষণে রেখে চিকিৎসা দিতে হবে।
সরকারের তথ্য অনুযায়ী, দেশে প্রথম ২০০০ সালে ডেঙ্গুকে গুরুত্ব দেয় সরকার। বিশ্বে ১৭৮০ সালে প্রথম ডেঙ্গু দেখা দেয়। এরপর ১৯৫০ সালে এশিয়ার থাইল্যান্ড ও ফিলিপাইনে ডেঙ্গু সংক্রমণ ছড়ায়। ১৯৬৩ সালে কলকাতা ও ১৯৬৪ সালে ঢাকায় সংক্রমণ ঘটায় ডেঙ্গু। সে সময় ডেঙ্গুকে ঢাকা ফিভার নামে অভিহিত করা হয়। ২০০০ সালে বাংলাদেশে ডেঙ্গু ভাইরাসে আক্রান্ত সাড়ে পাঁচ হাজার রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়।
এর মধ্যে ৯৩ জনের মৃত্যু হয়। ২০২২ সালে ৬১ হাজার রোগীর মধ্যে ২৮১ জনের মৃত্যু হয়। ২০১৯ সালে এক লাখের বেশি ডেঙ্গু রোগী পাওয়া যায় আর মারা যায় ১৬৪ জন। ২০০০ থেকে ২০২২ সাল—এ ২৩ বছরে ডেঙ্গু রোগীর মোট সংখ্যা ছিল ২ লাখ ৪৪ হাজার ২৪৬। এর মধ্যে মারা গেছে ৮৫০ রোগী। ২০২৩ সালে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছিল সর্বোচ্চ। ওই বছর হাসপাতালে ভর্তি হয় ৩ লাখ ২১ হাজারের বেশি রোগী। এর মধ্যে ১ হাজার ৭০৫ জনের মৃত্যু হয়।
সরকারের তথ্য বলছে, চলতি বছরের শুরু থেকে গতকাল পর্যন্ত মোট ১ হাজার ২২৪ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে এসেছে। এর মধ্যে ৪২১ জন রাজধানীতে চিকিৎসাধীন ছিল। আর রাজধানীর বাইরে সারা দেশে চিকিৎসা নিয়েছে ৮০৩ জন। মৃতদের ১০ জন রাজধানী ও ছয়জন রাজধানীর বাইরে বিভিন্ন এলাকার বাসিন্দা। বিভাগভিত্তিক হিসেবে ঢাকা বিভাগে ১৭০ জন, ময়মনসিংহে ১৯, চট্টগ্রামে ৩৩৫, খুলনায় ৮৫, রাজশাহীতে ৩২, রংপুরে ১৩, বরিশালে ১৪৩ ও সিলেট বিভাগে ছয়জন। আর রাজধানীর বাইরে মৃত ছয়জনের মধ্যে চট্টগ্রাম জেলায় দুই ও বরিশালে চারজন চিকিৎসাধীন ছিল।
ডেঙ্গুবিষয়ক যে পরিসংখ্যান সরকার প্রকাশ করছে তা নিয়ে শুরু থেকেই বিতর্ক রয়েছে। বিশেষজ্ঞরা জানান, সরকারের এ তথ্য আংশিক। মূলত নির্ধারিত কিছু সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতাল থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে ওই পরিসংখ্যান তৈরি করা হয়। এর বাইরে সারা দেশে বহু হাসপাতালে রোগী থাকলেও তাদের তথ্য নেয়া হয় না। অনেকে আক্রান্ত হয়ে বাড়িতে থাকছে, মারা যাচ্ছে সে বিষয়টি পর্যবেক্ষণের বাইরে থাকছে।
জাতীয় প্রতিষেধক ও সামাজিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের (নিপসম) কীটতত্ত্ব বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ড. মো. গোলাম ছারোয়ার বণিক বার্তাকে বলেন, ‘২০০০ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত দেশে যে-সংখ্যক ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছিল তার চেয়ে অনেক বেশি শনাক্ত হয়েছে ২০২৩ সালে। এ বছর আগের ২২ বছরের চেয়ে বেশি মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। গত বছর স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখা একটি সার্ভে করেছিল।
এতে যে ভয়াবহতা উঠে এসেছিল, তার রেশ জানুয়ারিতেও চলছে। এডিস মশা এখন শুধু শহরেই সীমাবদ্ধ নয়, ৬৪টি জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলেও দেখা যাচ্ছে। ডেঙ্গু ভাইরাস এডিস মশার শরীরে ভার্টিক্যাল ট্রান্সমিশনের মাধ্যমে পরবর্তী বংশধরের মধ্যে সফল ট্রান্সমিশন হচ্ছে। গ্রামে যেসব মশা অসংক্রমিত ছিল তারা এখন সংক্রমিত হয়েছে। রোগী কমাতে হলে মশা কমাতে হবে। এজন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা রয়েছে। সেটি মানা হচ্ছে কিনা তা দেখা জরুরি। মশা প্রজনন সক্ষমতা, প্রজননস্থল পরিবর্তন হয়েছে।’
স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ জানায়, ডেঙ্গুকে যথাযথ গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। চিকিৎসার জন্য সুনির্দিষ্ট গাইডলাইন রয়েছে, যার আলোকে সারা দেশে চিকিৎসা দেয়া হয়। সরকারের স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানগুলো প্রস্তুত রয়েছে।
দ্রুত ছড়িয়ে পড়া একটি সংক্রামক রোগের বিষয়ে কর্মকৌশলে ঘাটতি রয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জনস্বাস্থ্য বিষয়ক কমিটির সদস্য ও পাবলিক হেলথ অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট (ইলেক্ট) অধ্যাপক ডা. আবু জামিল ফয়সাল। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘গত কয়েক দশকে দেশে ডেঙ্গু প্রাদুর্ভাব বেড়েছে।
এ নিয়ে এখনো দীর্ঘমেয়াদি ও কার্যকর পদক্ষেপের ঘাটতি দেখা যাচ্ছে। বর্তমানে যে পরিস্থিতি রয়েছে তাতে গত বছরের তুলনায় ডেঙ্গু যে আরো ভয়াবহ হবে না, তার নিশ্চয়তা নেই। বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ এ রোগকে সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণের কার্যক্রম নেই। স্থানীয় সরকার বিভাগ ও স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সমন্বয় জরুরি। এলাকাভিত্তিক রোগ ও রোগী ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা কাটাতে জনস্বাস্থ্যের বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দিতে হবে। দেশে ডেঙ্গু অন্যতম সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে।’
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) জানায়, ডেঙ্গু ভাইরাসজনিত রোগে প্রতি বছর ৪০ কোটি মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে। পৃথিবীর প্রায় অর্ধেক মানুষ এখন ডেঙ্গুর ঝুঁকিতে রয়েছে। গ্রীষ্মমণ্ডলীয় ও উপগ্রীষ্মমণ্ডলীয় জলবায়ুতে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব বেশি। এসব অঞ্চলের বেশির ভাগই শহর ও উপশহর। ডেঙ্গু অনেক ক্ষেত্রে উপসর্গবিহীন বা হালকা অসুস্থতা তৈরি করে। তবে প্রায়ই এ ভাইরাসে সৃষ্ট জ্বর মৃত্যুর কারণ হয়ে ওঠে। ডেঙ্গুর নির্দিষ্ট চিকিৎসা নেই। প্রাথমিকভাবে শনাক্তকরণ ও উপসর্গ অনুযায়ী চিকিৎসা রোগীকে সুস্থ করে ও মৃত্যুহার কমায়।
দেশের ডেঙ্গু পরিস্থিতির সার্বিক বিষয়ে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী অধ্যাপক ডা. সামন্ত লাল সেন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ শুধু স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কাজ নয়। আমরা যথাযথ চিকিৎসা নিশ্চিত করতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি। রোগটি নিয়ন্ত্রণে আমরা স্থানীয় সরকারের সঙ্গে সমন্বিত কাজ করছি।’
আপনার মতামত জানানঃ