
বাংলাদেশে কয়েক বছর ধরে ডেঙ্গু আর চিকুনগুনিয়া দুই ভাইরাসজনিত জ্বরই আলোচনায়। দুটিই এডিস মশার মাধ্যমে ছড়ায়, তাই উপসর্গের শুরুতে প্রায় এক রকম মনে হয় এবং অনেক রোগীর ক্ষেত্রে প্রথম পরীক্ষায় ডেঙ্গু নেগেটিভ এলেও কয়েক দিন পর চিকুনগুনিয়া ধরা পড়ে—বাস্তব অভিজ্ঞতায় এমন উদাহরণ অনেক। এই মিলের ভেতরেও কিছু স্পষ্ট পার্থক্য আছে, আছে শনাক্তকরণ ও চিকিৎসার ধরণে আলাদা গুরুত্ব। সাধারণ পাঠকের সুবিধার জন্য সহজ ভাষায় দুটো রোগকে পাশাপাশি বোঝার চেষ্টা করা যাক, যেন জ্বর হলে ভয় না পেয়ে সঠিক সময়ে পরীক্ষা ও চিকিৎসার পথে যাওয়া যায়।
প্রথমে বোঝা দরকার—দুটিই ভাইরাস, অ্যান্টিবায়োটিক কাজ করে না। ডেঙ্গু ভাইরাস চারটি সেরোটাইপে (DEN-1 থেকে DEN-4) দেখা যায়; কোন সেরোটাইপ প্রাধান্য পাবে তা সময়ের সঙ্গে বদলাতে পারে, ফলে উপসর্গের “প্যাটার্ন” বা তীব্রতা বছরভেদে ভিন্ন লাগে। চিকুনগুনিয়া ভাইরাসও এডিস মশাই ছড়ায়, কিন্তু শরীরে যে প্রতিক্রিয়া ঘটায় তার কেন্দ্রবিন্দু অনেক সময় জয়েন্ট বা গিরা—তাই একে অনেকেই “ল্যাংড়া জ্বর” বলে। একই মৌসুমে দুটোর প্রকোপ বাড়লে সন্দেহ আর বিভ্রান্তি স্বাভাবিক, কারণ জ্বর, মাথাব্যথা, অবসাদ, ক্ষুধামন্দা—সবই দুই রোগে মিলেমিশে থাকে।
উপসর্গের তফাৎ ধরার কৌশল হলো সময়রেখা ও মাত্রার দিকে খেয়াল রাখা। ডেঙ্গুতে সাধারণত তাপমাত্রা খুব বেশি থাকে, টানা কয়েক দিন জ্বর যায় না, চার-পাঁচ দিনের মাথায় শরীরে লালচে র্যাশ ছড়িয়ে পড়তে দেখা যায়—এটি তুলনামূলকভাবে বেশি ও স্পষ্ট। বমি বমি ভাব, বমি, চোখের পেছনে ব্যথা, শরীর ব্যথা ডেঙ্গুতেও থাকতে পারে, তবে জয়েন্ট-পেইনের তীব্রতা সাধারণত চিকুনগুনিয়ার মতো নয়। ডেঙ্গুর বড় ঝুঁকি আসে রক্তের প্লাটিলেট কমে যাওয়ায় ও “লিকেজ” সমস্যায়; ফলে নাক-মুখ দিয়ে রক্ত পড়া, মাড়ি থেকে রক্তক্ষরণ, কালশিটে দাগ, পেটব্যথা বা শক সিনড্রোম পর্যন্ত যেতে পারে—এগুলো সতর্কসংকেত। আবার “এক্সপ্যান্ডেড ডেঙ্গু” বলতে লিভার, হার্ট, কিডনি ইত্যাদি অঙ্গে প্রভাব পড়াও বোঝায়; এতে বাড়তি পর্যবেক্ষণ ও হাসপাতালে ভর্তি দরকার হতে পারে।
চিকুনগুনিয়াতে ছবি কিছুটা আলাদা। তীব্র জ্বর দিয়ে শুরু হলেও দুই-তিন দিনের পর তাপমাত্রা অনেক সময় কমে আসে বা ওঠানামা করে; কিন্তু জ্বর নেমে গেলেও গিরায়-গিরায় যন্ত্রণা রয়ে যায়, অনেকের হাত-পা ফুলে যায়, হাঁটা-চলা, ওঠা-বসা কষ্টকর হয়ে পড়ে। কাঁধ, কবজি, আঙুল, হাঁটু, গোড়ালি—প্রায় সব জয়েন্টে ব্যথা হতে পারে এবং পেশীতেও ব্যথা ছড়ায়। চিকুনগুনিয়ায় র্যাশ তুলনামূলক কম, প্লাটিলেট পতন বিরল, রক্তক্ষরণের ঝুঁকি নেই বললেই চলে, শক সিনড্রোমও খুবই অস্বাভাবিক। অনেকের ত্বক কালচে হতে পারে বা খোসা উঠতে পারে—এটি ডেঙ্গুতে দেখা যায় না। সবচেয়ে বিরক্তিকর দিক হলো ব্যথা দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে; অনেক রোগী কয়েক সপ্তাহ এমনকি মাসখানেক ধরে ব্যথায় কাতর থাকেন, কাজের সক্ষমতা কমে যায়, মন-মেজাজ খারাপ থাকে, ক্লান্তি কাটে না।
পরীক্ষার সময় ও ধরন আলাদা হওয়ায় ভুল বোঝাবুঝি হয় বেশি। জ্বরের প্রথম দুই-তিন দিনে ডেঙ্গুর জন্য এনএস১ অ্যান্টিজেন বা পিসিআর পরীক্ষায় ভাইরাস ধরা পড়ার সম্ভাবনা বেশি। সময় পেরিয়ে গেলে এনএস১ আর পজিটিভ নাও আসতে পারে—তখন আইজিএম/আইজিজি অ্যান্টিবডি টেস্টে ধরা পড়ে আগের সংক্রমণ বা সাম্প্রতিক ইনফেকশন। অন্যদিকে চিকুনগুনিয়ার আইজিএম সাধারণত জ্বর শুরু হওয়ার পাঁচ থেকে সাত দিন পর পজিটিভ হয়; খুব তাড়াতাড়ি করলে নেগেটিভ আসার সুযোগ থাকে। পিসিআরে ভাইরাসের আরএনএ পাঁচ-সাত দিনের মধ্যে ধরা পড়তে পারে। এই সময়সূচি মাথায় না রাখলে “ডেঙ্গু নেগেটিভ—নিশ্চিন্ত” ভেবে বসে থাকা ঠিক নয়, আবার উপসর্গ অনুযায়ী চিকুনগুনিয়াও যথাসময়ে পরীক্ষা করা দরকার। চিকিৎসকেরা এই টাইমিং বিবেচনায় রেখে টেস্ট প্রেসক্রাইব করেন; তাই নিজে নিজে বারবার টেস্ট না করে উপসর্গের দিনলিপি নিয়ে ডাক্তার দেখানোই উত্তম।
চিকিৎসার মূলনীতি—দুটিতেই সাপোর্টিভ কেয়ার, অর্থাৎ শরীরকে সময় দেওয়া, তরল-খাবার-ইলেক্ট্রোলাইটে ঘাটতি না হতে দেওয়া, জ্বর কমাতে প্যারাসিটামল ব্যবহার, বিশ্রাম। ডেঙ্গুতে ব্যথানাশক হিসেবে এনএসএআইডি—যেমন আইবুপ্রোফেন, ডাইক্লোফেনাক—এড়িয়ে চলাই নিরাপদ, কারণ প্লাটিলেট ও রক্তক্ষরণের ঝুঁকি বাড়তে পারে। চিকুনগুনিয়াতে, ডেঙ্গু নিশ্চিতভাবে নাকচ হলে, চিকিৎসক ব্যথা নিয়ন্ত্রণে সীমিত সময়ের জন্য ব্যথানাশক দিতে পারেন; তীব্র জয়েন্ট-পেইনে ফিজিওথেরাপি বা কোমল রেঞ্জ-অফ-মোশন অনুশীলনও উপকারী হতে পারে, তবে সবকিছুই চিকিৎসকের পরামর্শে। ডেঙ্গুতে সতর্কচিহ্ন দেখা দিলে—অতিরিক্ত দুর্বলতা, বারবার বমি, পেটব্যথা, রক্তক্ষরণ, অস্থিরতা, কম প্রস্রাব—দেরি না করে হাসপাতালে যেতে হয়; প্রয়োজনে আইভি ফ্লুইড, পর্যবেক্ষণ, ল্যাব মনিটরিং লাগে। চিকুনগুনিয়ায় জীবনঝুঁকি সাধারণত নেই, তবু দীর্ঘস্থায়ী ব্যথা ও কর্মক্ষমতা-হ্রাসের জন্য মানসিক চাপ বাড়তে পারে—ধাপে ধাপে ব্যথা-নিয়ন্ত্রণ, বিশ্রাম-ওয়ার্ক-ব্যালান্স, হালকা ব্যায়াম ও পর্যাপ্ত ঘুম কাজে আসে।
পরিবার-সমাজে দুই রোগ একসঙ্গে বাড়লে গৃহস্থালি ব্যবস্থাপনায় কয়েকটি সহজ অভ্যাস বড় পার্থক্য গড়ে। এডিসের প্রজননস্থল—ঘরের ভিতর-বাহিরের ছোট পাত্র, ড্রাম, ফুলের টবের থালা, জমে থাকা পানি, ফেলে রাখা টায়ার—সপ্তাহে অন্তত একদিন খালি করে শুকিয়ে রাখা; দরকার হলে ঢাকনা লাগানো। সকালের পর ও সন্ধ্যার আগে মশার কামড় বেশি—এই সময় হাত-পা ঢাকা পোশাক, বাচ্চাদের জন্য নিরাপদ রিপেলেন্ট, দরজা-জানালায় মশারি/স্ক্রিন কাজে লাগে। জ্বর এলে নিজে সিদ্ধান্ত নিয়ে গা-গরম ব্যথানাশকে না গিয়ে তাড়াতাড়ি প্যারাসিটামল ও তরল শুরু করুন, বিশ্রাম নিন, এবং প্রথম ২৪–৪৮ ঘণ্টার মধ্যে চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলুন; তিনি উপসর্গ দেখে কোন দিনে কোন টেস্ট উপযুক্ত তা বলে দেবেন। ঘরে কারও ডেঙ্গু ধরা পড়লে অন্যদেরও “প্রোটেক্টিভ” আচরণ—মশা থেকে বাঁচা, মশারি ব্যবহার—আরও কড়াকড়িভাবে চালু রাখতে হবে। কারণ জ্বরের প্রথম দিনগুলোতে রোগীর রক্তে ভাইরাসের মাত্রা বেশি থাকে; সেই রোগীকে কামড়ানো মশা অন্যকে সংক্রমিত করতে পারে।
ইতিহাস-পরিপ্রেক্ষিতেও কিছু কথা প্রযোজ্য। দেশে ডেঙ্গু বহু আগেই এসেছে এবং ২০০০ সালের পরে বড় বড় ঢেউয়ে ক্ষতি করেছে; সেরোটাইপের পালাবদল, নগরায়নের ধরণ, জলবায়ু ও নগর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতায় ঘাটতি মিলিয়ে এডিসের প্রজনন নিয়ন্ত্রণ কঠিন হচ্ছে। চিকুনগুনিয়া ২০০৮ সালে প্রথম শনাক্ত হলেও ২০১৭ সালে বড় প্রাদুর্ভাব দেখে সবাই চোখ খুলে বুঝেছে—শুধু ডেঙ্গু নয়, এডিস-জোনোসিসের বড় চিত্রটাই বিবেচনায় নিতে হবে। কোনো এক বছরের সাফল্য পরের বছর নিশ্চয়তা নয়; তাই পৌর-পর্যায়ে সারাবছর ধরে সোর্স-রিডাকশন, লার্ভিসাইডিং, হটস্পট ম্যাপিং, নাগরিক অংশগ্রহণ—এসব ধারাবাহিকভাবে চালাতে হবে।
ব্যক্তিগত ও পারিবারিক পর্যায়ে খাবার-পানীয় নিয়েও সচেতনতা দরকার। ডেঙ্গু-চিকুনগুনিয়া—দুটিতেই ডিহাইড্রেশন সহজে হয়, কারণ জ্বরে শরীরের চাহিদা বাড়ে; তাই পর্যাপ্ত পানি, ওরস্যালাইন, ডাবের পানি, স্যুপ, ফলের রস—যা রোগীর মানায়—দিনভর ছোট ছোট ভাগে দিন। বাচ্চারা খেতে না চাইলে তরল দিয়ে ন্যূনতম ক্যালরি ও লবণ-চিনি-ইলেক্ট্রোলাইট নিশ্চিত করা জরুরি। জ্বর কমে গেলেই শারীরিক পরিশ্রমে ঝাঁপিয়ে পড়া ঠিক নয়—বিশেষত চিকুনগুনিয়ায় জয়েন্ট বিশ্রামের সময় না পেলে ব্যথা লম্বা হতে পারে। কর্মক্ষেত্রে ধীরে ধীরে ফিরুন, ভারী কাজ আগে না করাই ভালো, প্রয়োজনে ফিজিওথেরাপিস্টের পরামর্শ নিন।
মানসিক স্বাস্থ্যের কথাও বলতে হয়। টানা ব্যথা, দুর্বলতা, কাজ করতে না পারা, রাতে ঘুমের ব্যাঘাত—এসব থেকে অনেকের মন খারাপ, উদ্বেগ, অস্থিরতা বেড়ে যায়। পরিবার-সহকর্মীদের বোঝাপড়াই এখানে শক্তি—“নাটক করছে” এমন মন্তব্য নয়, বরং নির্দিষ্ট সময় বিশ্রাম, হালকা স্ট্রেচিং, গরম/ঠাণ্ডা সেঁক, ব্যথা-ডায়েরি রাখা ইত্যাদি উৎসাহ দিন। ওয়েলনেস চেকলিস্ট রাখলে রোগী ও চিকিৎসক বুঝতে পারেন কোন কাজ করলে ব্যথা বাড়ে, কোনটিতে নিয়ন্ত্রণে থাকে।
সবশেষে, কোন লক্ষণে দ্রুত হাসপাতালে যাবেন—এটা সবার জানা জরুরি। ডেঙ্গুতে টানা বমি, পেটব্যথা বা ডান পার্শ্বে তীব্র ব্যথা, রক্তক্ষরণ, অতিরিক্ত ক্লান্তি-অস্থিরতা, প্রস্রাব খুব কম হওয়া, শ্বাসকষ্ট, মাথা ঘোরা—এসব বিপদসংকেত। চিকুনগুনিয়ায় জীবনঝুঁকি বিরল, তবু যদি শ্বাস নিতে কষ্ট, বুকব্যথা, অস্বাভাবিক দুর্বলতা বা স্নায়বিক লক্ষণ দেখা দেয়, কিংবা পূর্ব-বিদ্যমান রোগ (হার্ট-কিডনি-লিভার) থাকলে দেরি করবেন না। গর্ভবতী, বয়স্ক, ডায়াবেটিস/কিডনি/হৃদরোগী—এই গ্রুপে কোনো সংক্রমণেই বাড়তি সতর্কতা দরকার।
এই দুই রোগের বিরুদ্ধে “ওষুধ” বা “ম্যাজিক কিউর” এখনো হাতে নেই, তাই প্রতিরোধ-চর্চার ধারাবাহিকতা আর সময়মতো সঠিক পরীক্ষা-চিকিৎসাই ভরসা। রুটিন ছোট কাজগুলো—পানি জমতে না দেওয়া, সপ্তাহে একদিন ১০ মিনিটের “ড্রাই ডে”, বালতি-টব-ফ্রিজের ট্রে খালি করা, ট্যাংকের ঢাকনা ঠিকমতো লাগানো, নির্মাণস্থলে পানি জমা দেখলে কর্তৃপক্ষকে বলা, বাসার বারান্দা-ছাদ পরিষ্কার রাখা—এসবই বড় ফল দেয়। স্কুল-অফিস-কমিউনিটিতে সচেতনতার ছোট সভা, কাউন্সিলের সাথে সমন্বয়, রোগীর পাশে থাকা—একসঙ্গে করলে শহরের রোগবাহক কমে আসবে।
ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়ার মিল থাকলেও পার্থক্যগুলো ধরতে শেখা দরকার—ডেঙ্গুতে রক্তক্ষরণ/শকের ঝুঁকি বেশি, র্যাশ বেশি দেখা যায়, প্লাটিলেট কমে; চিকুনগুনিয়ায় দীর্ঘস্থায়ী তীব্র জয়েন্ট-পেইন প্রাধান্য পায়, প্লাটিলেট সাধারণত ঠিক থাকে, জীবনঝুঁকি কম কিন্তু কর্মক্ষমতা নষ্ট করে। পরীক্ষার টাইমিং আলাদা—ডেঙ্গু তুলনামূলক তাড়াতাড়ি, চিকুনগুনিয়া পাঁচ-সাত দিনের পর ধরা পড়তে স্বচ্ছন্দ। চিকিৎসা সাপোর্টিভ, তবে ডেঙ্গুতে ব্যথানাশক ব্যবহারে কড়াকড়ি, চিকুনগুনিয়ায় ব্যথা-ম্যানেজমেন্টে ডাক্তার নির্দেশনা অনুযায়ী এগোনো যায়। মশা নিয়ন্ত্রণ, ব্যক্তিগত সুরক্ষা, পর্যাপ্ত তরল, বিশ্রাম, সতর্কসংকেতে দ্রুত হাসপাতালে যাওয়া—এসব সহজ নিয়মই আমাদের ও আমাদের পরিবারের নিরাপত্তার মূল চাবিকাঠি। আজ যদি সবাই নিজের ঘর-বারান্দা-অফিসে ১০ মিনিট সময় দিই, কাল শহর কিছুটা হলেও এডিস-মুক্ত হবে; আর সেই ছোট কাজটাই হয়তো আমাদের এক বা একাধিক পরিবারের সদস্যকে অনর্থক কষ্ট থেকে বাঁচাবে।
আপনার মতামত জানানঃ