পবিত্র শহর মক্কার পথে আলখাল্লা পোশাকে মোড়া শরীরটা অন্যান্য হজযাত্রীদের মধ্যে মিশে যায়। পোশাকের নিচে দলের অন্যান্য মুসলিমদের মতোই তার ছিল মুণ্ডিত মাথা এবং কোনরকমে রাখা দাড়ি। আরবিতে অনর্গল কথা বলতে পারতেন, আর মধ্যপ্রাচ্যের সংস্কৃতিটাও আয়ত্ত্ব করেছিলেন দারুণভাবে। এই যাত্রায় তিনি মুসলিমদের মতো প্রার্থনা করেছেন। কুরআন রাখার একটি সোনাখচিত হামাইলও ছিল তার সাথে। যদিও হামাইলের মধ্যে কোন পবিত্র গ্রন্থ ছিল না। তার বদলে হামাইলটিতে ঘড়ি, কম্পাস, অর্থ, ছুরি, পেন্সিল ও কাগজ ছিল। তবে কেউ এই য়ুরোপীয় চেহারার মানুষটাকে আলাদাভাবে লক্ষ্য করেনি। এই সময় তিনি নিজের নাম বলেন ‘মির্জা আবদুল্লাহ্ বাশরি’। এক সুফি দরবেশের ছদ্মবেশে তিনি আরবের ইয়াম্বুতে পৌঁছান। তার পরে ‘জাইর’ ছদ্মনামে মক্কা নগরীতে প্রবেশ করেন।
তিনি প্রথমে নাগর ব্রাহ্মণ হন, তার পর শিখ ধর্ম গ্রহণ করেন, পরে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হন এবং সুফিদের কাদিরিয়া সিলসিলার সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠে। এমনকি খৎনাও করান।
এই মানুষটার নাম স্যার রিচার্ড ফ্রান্সিস বার্টন। তিনি প্রথম অমুসলিম যিনি কিনা সফলভাবে মক্কায় হজ পালন করেন। ওই সময়ে ব্যাপারটা ছিল খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ সে সময় মক্কা ছিল অমুসলিমদের জন্য নিষিদ্ধ শহর। যদিও পরবর্তীতে তিনি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। তবে ওই সময়ে তার মক্কা যাওয়ার উদ্দেশ্য হজ করা ছিল না। তিনি সেখানে গিয়েছিলেন পশ্চিমা পাঠকদের কাছে মক্কাকে পরিচিত করতে। যাদের হজ সম্পর্কে কোনো ধারণা ছিল না সে সময়ে। যখন তিনি আরবে যান, প্রায় ১২ টি ভাষায় তিনি কথা বলতে পারতেন। পরবর্তীতে তিনি আরও ২০ টির বেশি ভাষা আয়ত্ত্ব করেন।
১৮২১ সালে ইংল্যান্ডের ডেভনের টোরকি নামের এক সমুদ্রশহরে স্যার রিচার্ড ফ্রান্সিস বার্টনের জন্ম। তার বাবা জোসেফ নেটারভিল বার্টন ছিলেন ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর এক আধিকারিক। যাকে অর্ধেক বেতনে অবসরে বাধ্য করা হয় ষষ্ঠ জর্জের সাথে রানী ক্যারোলিনের বিশ্বাসঘাতকতায় সাক্ষ্য দিতে অস্বীকৃতি জানানোয়। তার বাবা জন্মসূত্রে আইরিশ হলেও রিচার্ডের মা মার্থা বেকার ছিলেন ইংরেজ অভিজাত পরিবারের সন্তান। ১৮৬০ সালে আমেরিকা ভ্রমণ শেষে, এর পরের বছর রিচার্ড ইসাবেল আরুন্ডেলকে বিয়ে করেন।
শুধু মানুষের ভাষা আর ধর্ম জেনে তিনি সন্তুষ্ট হননি। এরপর তিনি বানর পোষা শুরু করেন, এটা দেখতে যে বানরের ভাষা শেখা যায় কিনা।
১৮২৫ সালে তার পরিবার ফ্রান্সে চলে যায়। সেখানে রিচার্ড ফ্রেঞ্চ, ইটালিয়ান, নেয়াপোলিটান, ল্যাটিন, কিছুটা গ্রীক ও রোমানিয়া ভাষা শেখেন। এরপর ১৮৪০ সালে তিনি অক্সফোর্ডে ভাষা নিয়ে পড়াশোনা করেন। যদিও ১৮৪২ সালে নিষিদ্ধ ঘোড়দৌড় দেখতে যাওয়ার জন্য তাকে অক্সফোর্ড থেকে বের করে দেয়া হয়। মামুলি জীবন রিচার্ডের বিশেষ অপছন্দ ছিল। তিনি বাবার মতোই যোদ্ধা হতে চাইতেন। তিনি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সেনাদলে যোগ দেন এই আশায় যে, ইঙ্গ-আফগান যুদ্ধে তাকে পাঠানো হবে। কিন্তু ততো দিনে সেই যুদ্ধ শেষ হয়ে গিয়েছে। কিন্তু বার্টন সেই সময়ে পৌছে গিয়েছেন ভারতে। সেখানে তিনি ভারতীয় ভাষাগুলোর দখল নেন। পাশাপাশি পার্সিয়ান ও আরবি ভাষায়ও দক্ষতা অর্জন করেন।
ভারতে তিনি নানা ধর্ম সম্পর্কে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। তিনি প্রথমে নাগর ব্রাহ্মণ হন, তারপর শিখ ধর্ম গ্রহণ করেন, পরে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হন এবং সুফিদের কাদিরিয়া সিলসিলার সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠে। এমনকি খৎনাও করান তিনি। ইসলামে তার জ্ঞান এমন জায়গায় পৌঁছয় যে, তিনি সম্পূর্ণ কুরআন মুখস্থ বলতে পারতেন। শুধু মানুষের ভাষা আর ধর্ম জেনে তিনি সন্তুষ্ট হননি। এরপর তিনি বানর পোষা শুরু করেন, এটা দেখতে যে বানরের ভাষা শেখা যায় কিনা।
১৮৫৪ সালে সোমালিল্যান্ডে আরজিএস’র পৃষ্ঠপোষকতায় পরিচালিত এক অভিযানে তিনি জন হ্যানিং স্পেক ও উইলিয়াম স্ট্রোয়ানের দলে যুক্ত হন। এই অভিযানের শেষে দলটি ‘নীলের উৎস সন্ধানে’ আরও এক অভিযানে যায়।
এরপর ১৮৫১ সালে তিনি ইংল্যান্ডে ফিরে যান এবং ভারতের উপর চারটি বই লেখেন। ১৮৫৩ সালে ‘দ্য রয়েল জিওগ্রাফিকাল সোসাইটি’র (আরজিএস) অনুমতি নিয়ে তিনি মধ্যপ্রাচ্যে অনুসন্ধানে বের হন। এর মধ্যেই ছিল তার ঐতিহাসিক মক্কা যাত্রা। মক্কাযাত্রায় তার লেখা জার্নালের নাম ছিল ‘পার্সনাল ন্যারেটিভ অব অ্যা পিলগ্রিমেজ টু আল- মদিনা এন্ড মক্কা’। যা কিনা ১৮৫৫ সালে প্রকাশিত হয় এবং তাকে বিখ্যাত করে দেয়। তিনি প্রথম মিশরে থাকাকালীন সন্ধান পান আরব্য রজনীর গল্পমালার। তিনি সেগুলি সংগ্রহ করতে শুরু করেন এবং ১৭ খণ্ডে ‘দ্য বুক অব দ্য থাউজ্যান্ড অ্যান্ড ওয়ান নাইটস’ নামে তা প্রকাশিত হয় (১০ খণ্ড মূল ও তার সংযোজন আরও সাত খণ্ড)। তিনিই বাৎস্যায়ন বিরচিত ‘কামসূত্র’ প্রথম ইংরেজিতে অনুবাদ করেন। আরবের কামশাস্ত্র (শেখ নেফাজি বিরচিত) ‘সুরভিত উদ্যান’ বা ‘দ্য পারফিউমড গার্ডেন’ও তারই অনুবাদে য়ুরোপে বিখ্যাত হয়েছে। তিনি তার ভ্রমণের উপর ৩০ টিরও বেশি বই লিখেছেন।
১৮৫৪ সালে সোমালিল্যান্ডে আরজিএস’র পৃষ্ঠপোষকতায় পরিচালিত এক অভিযানে তিনি জন হ্যানিং স্পেক ও উইলিয়াম স্ট্রোয়ানের দলে যুক্ত হন। এই অভিযানের শেষে দলটি ‘নীলের উৎস সন্ধানে’ আরও এক অভিযানে যায়। কিন্তু অভিযানে দলটি আক্রমণের শিকার হয়। স্ট্রোয়ান মারা যান। স্পেক ও রিচার্ড উভয়ই আহত হন। রিচার্ড গালে বর্ডার আঘাত পান। যখন সুস্থ হন, ক্রিমিয়ান যুদ্ধে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করেন।
১৮৮৬ সালে স্বয়ং রানি ভিক্টোরিয়া তাকে নাইট উপাধি দিলেও, তার বিরুদ্ধে ‘অশালীনতা’ ও ‘পর্নোগ্রাফি’ লেখার অভিযোগ আনে ভিক্টোরীয় সমাজ। এমনকি রিচার্ডের স্ত্রী ইসাবেল আরুন্ডেল স্বামীর বেশ কিছু পাণ্ডুলিপি পুড়িয়ে ফেলেন।
এরপর ১৮৫৭ সালে তিনি আফ্রিকায় স্পেকের সাথে যুক্ত হয়ে দ্য গ্রেইট লেকস অব আফ্রিকা অনুসন্ধানে যান। তারা টাঙ্গানিকা হ্রদে পৌঁছান কিন্তু এরপর রিচার্ড ম্যালেরিয়ায় প্রায় মারাই যাচ্ছিলেন। ১৮৬০ সালে এই সংক্রান্ত জার্নালে তিনি স্পেকের দাবি তুলে ধরেন যে, তিনি নীলের উৎস খুঁজে পেয়েছেন।
ইটালির ত্রিয়েস্তে বাসকালে ১৮৯০ সালে রিচার্ড হৃদরোগে মারা যান। রিচার্ড ভিক্টোরীয় ইংল্যান্ডের কড়া রক্ষণশীল সমাজে বহু বাগড়া দেয়া কাজ করেছেন। ছাড়ও পাননি। ১৮৮৬ সালে স্বয়ং রানি ভিক্টোরিয়া তাকে নাইট উপাধি দিলেও, তার বিরুদ্ধে ‘অশালীনতা’ ও ‘পর্নোগ্রাফি’ লেখার অভিযোগ আনে ভিক্টোরীয় সমাজ। এমনকি রিচার্ডের স্ত্রী ইসাবেল আরুন্ডেল স্বামীর বেশ কিছু পাণ্ডুলিপি পুড়িয়ে ফেলেন। বিশেষজ্ঞরা অনুমান করেন, তার মধ্যে ‘দ্য পারফিউমড গার্ডেন’র মূল পাণ্ডুলিপিও ছিল। জানা যায়, সেই সব পুড়িয়ে দেওয়া পাণ্ডুলিপির মধ্যে মধ্যপ্রাচ্যে সমকামিতা এবং অসমবয়সি পুরুষদের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক নিয়ে বিস্তারিত বিশ্লেষণ ছিল। কিন্তু সমকালীন ইংল্যান্ডে এ সব লেখার অর্থ ছিল নিশ্চিত কারাদন্ড। ইসাবেলা হয়তো ভয় পেয়েই স্যার রিচার্ড ফ্রান্সিস বার্টনের সমাজ বদলে দেয়া ওই কাজগুলো পুড়িয়ে দিয়েছিলেন।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/১০১৫
আপনার মতামত জানানঃ