১৯৪৫ সালের ১৬ জুলাই, ভোর ৫টা ২৯ মিনিট ৪৫ সেকেন্ড। যুক্তরাষ্ট্রের নিউ মেক্সিকোর আলামোগর্ডোর মরুভূমি তখনো ঘুমচোখে। হঠাৎ করেই অন্ধকার আকাশ ফেটে বেরিয়ে এল এক ভয়াবহ আগুনের গোলা। সূর্যের মতো উজ্জ্বল সেই আলোর তীব্রতা মুহূর্তেই ছড়িয়ে পড়ল চারপাশে। তার সঙ্গে সাথে এল ভূকম্পনের মতো ঝাঁকুনি আর গর্জনের আওয়াজ, যা পাহাড় থেকে ফিরে ফিরে ধ্বনিত হচ্ছিল বারবার।
মানব ইতিহাসে এটাই ছিল প্রথম পারমাণবিক বিস্ফোরণ। কোডনেম ছিল ‘ট্রিনিটি’। দীর্ঘ গোপন গবেষণার পর ম্যানহাটান প্রজেক্টের বিজ্ঞানীদের তৈরি এই বোমাটি পরীক্ষামূলকভাবে ফাটিয়ে বিশ্বকে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছিল এক নতুন যুগে—পারমাণবিক যুগে।
বিস্ফোরণের মুহূর্তে বিজ্ঞানীরা কেউ হাসছিলেন, কেউ হতবাক, আবার কেউ নিঃশব্দ হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন মাটির ওপর। গ্যাজেট নামের বোমাটি সফলভাবে বিস্ফোরিত হয়েছে—এটা যেমন ছিল তৃপ্তির ব্যাপার, তেমনি ছিল ভয় আর আত্মগ্লানির শুরু। বিস্ফোরণের কিছুক্ষণ পরই প্রকল্প পরিচালক বেইনব্রিজ বলেছিলেন, “Now we are all sons of bitches.” আর প্রধান বিজ্ঞানী রবার্ট ওপেনহাইমার মুখে উচ্চারণ করেছিলেন ভগবদ্গীতার সেই বিখ্যাত লাইন: “এখন আমি মৃত্যু, বিশ্বের ধ্বংসকর্তা হয়ে উঠেছি।”
তবে সেটা তিনি সত্যিই ওই সময় বলেছিলেন কি না, সেটা নিশ্চিত নয়। কিন্তু যে অনুভূতি তখন চারপাশে ছড়িয়ে পড়েছিল, সেটা একটাই—মানবজাতি এখন এমন কিছু বানিয়ে ফেলেছে, যা নিজের ধ্বংস ডেকে আনতে পারে।
ম্যানহাটান প্রজেক্ট শুরু হয়েছিল ১৯৪২ সালে। লক্ষ্য ছিল—জার্মান না বানিয়ে ফেলার আগেই আমেরিকার হাতে পারমাণবিক অস্ত্র তুলে দেওয়া। প্রজেক্টটির সামরিক প্রধান ছিলেন জেনারেল লেসলি গ্রোভস। তিনি বৈজ্ঞানিক নেতৃত্বের জন্য বেছে নেন রবার্ট ওপেনহাইমারকে। লস আলামোসে গড়ে ওঠে পৃথিবীর সবচেয়ে গোপন ল্যাব, যেখানে বিশ্বের সেরা বিজ্ঞানীরা দিনরাত কাজ করছিলেন।
ইউরেনিয়াম দিয়ে তৈরি করা ‘লিটল বয়’ বোমাটি ছিল অনেক সরল, তাই সেটার পরীক্ষার দরকার হয়নি। ওটাই পরে ফেলা হয় হিরোশিমায়। কিন্তু প্লুটোনিয়াম দিয়ে বানানো বোমার গঠন এতটাই জটিল ছিল, যে সেটির কার্যকারিতা পরীক্ষার জন্যই ট্রিনিটি বিস্ফোরণ ঘটানো হয়।
এই প্লুটোনিয়াম বোমার নকশা ছিল ‘ইমপ্লোশন’ টাইপ। গোলাকার প্লুটোনিয়ামের চারপাশে রাখা হয় বিশেষ বিস্ফোরক, যেগুলো একযোগে ফাটিয়ে ভিতরের পদার্থকে একত্র করে তৈরি করা হয় সুপারক্রিটিক্যাল ভলিউম—যা ঘটায় চূড়ান্ত বিকট বিস্ফোরণ।
বিস্ফোরণের স্থান নির্ধারণ করা হয়েছিল মরুভূমির একদম ফাঁকা এলাকায়, যেখানে কেউ ছিল না, কেবল সাপ-বিচ্ছুর বসবাস। বিজ্ঞানীরা অস্থায়ী ঝুপড়িতে থাকতেন, আর দিনের পর দিন গোপনে কাজ চালাতেন। সেখানে উপস্থিত ছিলেন রিচার্ড ফাইনম্যান, ইমিলিও সেগ্রে, বেইনব্রিজসহ বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানীরা, যাঁদের অনেকেই পরে নোবেল পুরস্কার পান।
পরীক্ষার আগের দিন রাতেই শুরু হয় ঝড়। সকালে যখন সব প্রস্তুতি শেষ, তখন বোমাটি ১০০ ফুট উঁচু টাওয়ারে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। সবাই নিরাপদ দূরত্বে। অনেকে বাজি ধরছিলেন, বিস্ফোরণ কতটা বড় হবে। কেউ কেউ ভেবেছিলেন হয়তো পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলটাই পুড়ে যাবে! বিস্ফোরণের আগে নির্দেশ ছিল—উপুড় হয়ে শুয়ে পড়তে, চোখ ঢেকে রাখতে, যাতে অতিবেগুনি রশ্মির ক্ষতি না হয়।
শেষে যখন কাউন্টডাউন শেষ হয়, তখন এক প্রচণ্ড আলোর ঝলকানি আকাশে ফুটে ওঠে, চারপাশ কাঁপিয়ে দেয় এক অদ্ভুত শক্তি। বিস্ফোরণের কেন্দ্রে আগুনের এক ভয়াবহ গোলা, তার চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে মাশরুম-আকৃতির মেঘ। এক সেনা কর্মকর্তা বলেন, বিস্ফোরণ দেখে এক সামরিক পুলিশ এতটাই ভয় পেয়ে গিয়েছিল যে মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছিল, যেন সে মৃত্যু নিজ চোখে দেখেছে।
বেইনব্রিজ জানান, তাঁর ঘাড়ের পেছনে এমন এক তাপ অনুভব করেছিলেন, যা গরম বাতাসের মতো অস্বস্তিকর ছিল। সুরক্ষিত গগলস খুলে যখন তিনি আকাশের দিকে তাকালেন, তখন দেখলেন—একটা বিশাল আগুনের গোলা ধোঁয়ার সঙ্গে ওপরে উঠছে। দৃশ্যটা এতটাই অলৌকিক আর ভয়ঙ্কর ছিল যে উপস্থিত কেউ তা কোনোদিন ভুলতে পারেননি।
এই ট্রিনিটি পরীক্ষার ক’দিন পরই, আগস্ট মাসে, হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে ফেলা হয় বোমা। লাখ লাখ মানুষের মৃত্যু, অসংখ্য শিশুর জন্মগত সমস্যা, এবং ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়া দুই নগরী—মানবসভ্যতা তখন পারমাণবিক শক্তির নির্মম বাস্তবতা উপলব্ধি করতে শুরু করে।
পরবর্তীতে প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যান যখন পটসডামে স্তালিন ও চার্চিলের সঙ্গে বৈঠকে ছিলেন, তখনই তিনি প্রথম পরীক্ষার সাফল্যের খবর পান। স্তালিন শুনে শুধু বলেছিলেন, “ভালো লাগল, আশা করি জাপানিদের বিরুদ্ধে কাজে দেবে।”
যুদ্ধ শেষ হয় ঠিকই, কিন্তু যুদ্ধের শেষ মানে শান্তি ছিল না। বরং শুরু হয় স্নায়ুযুদ্ধ, শুরু হয় পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির এক ভয়ংকর প্রতিযোগিতা। ওপেনহাইমার পরে পারমাণবিক প্রযুক্তির আন্তর্জাতিক নিয়ন্ত্রণ চাইলেও ততদিনে অনেক দেরি হয়ে গেছে।
মানুষ হয়তো হিটলারকে ঠেকাতে পারমাণবিক বোমা বানিয়েছিল, কিন্তু ইতিহাস প্রমাণ করেছে—এই শক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। বরং অস্ত্রের প্রতিযোগিতা, পরস্পরের ওপর চাপ সৃষ্টি, এবং ভয়ঙ্কর অনিশ্চয়তা—এই সবই হয়েছে পারমাণবিক যুগের উত্তরাধিকার।
আপনার মতামত জানানঃ