রবার্ট ক্লাইভ—এই নামটি উচ্চারণ করলেই ইতিহাসের পাতা কেঁপে ওঠে। কেউ বলেন তিনি লোভী লুটেরা, কেউ বলেন সাহসী সংস্কারক। কেউ তাকে মনে করেন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের স্থপতি, আবার কেউ ইতিহাসের এক অনিচ্ছাকৃত নায়ক। এ এক দ্বান্দ্বিক চরিত্র, যার জীবনের প্রতিটি ধাপে রয়েছে আলো ও অন্ধকারের স্পষ্ট দ্বন্দ্ব।
ক্লাইভ জন্মেছিলেন ইংল্যান্ডে, সাধারণ পরিবারে। বাবা-মা তাকে বেশিরভাগ সময় উপেক্ষাই করতেন। মামা-মামির আদরে তিনি বড় হন, কিন্তু সেই আদর যেন তাকে করেছিল জেদি, একরোখা ও হিংস্র। শৈশবে দোকানদারদের জানালা ভাঙার ভয় দেখিয়ে অর্থ আদায় করতেন বলে কথিত আছে। এমনকি আত্মহত্যার চেষ্টাও করেছিলেন একবার, যদিও সেই ঘটনার সত্যতা নিয়েও রয়েছে বিতর্ক।
তবে যা সত্যি, তা হলো—এই দুরন্ত তরুণ পরে হয়ে উঠেছিলেন ভারতের ইতিহাসে এক মোড় ঘুরিয়ে দেওয়া সৈনিক ও প্রশাসক। শুরুটা হয়েছিল মাদ্রাজে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একজন সাধারণ কেরানি হিসেবে। কিন্তু তার সাহস, কৌশল, ও নেতৃত্বগুণ তাকে পৌঁছে দেয় সেনা নেতৃত্বে। ২৬ বছর বয়সেই তিনি ফরাসি মিত্র চন্দা সাহেবের বিরুদ্ধে আরকটের যুদ্ধ জিতে ব্রিটিশদের আশ্চর্য করে দেন।
এই জয়ের মধ্য দিয়ে তার সামরিক প্রতিভা প্রতিষ্ঠিত হয়। এরপরেই বাংলার ইতিহাসে সবচেয়ে আলোচিত অধ্যায়—১৭৫৭ সালের পলাশীর যুদ্ধ। এই যুদ্ধ আসলে এক প্রতারণার নাটক। সিরাজউদ্দৌলার সেনাপতি মীরজাফর গোপনে ক্লাইভের সঙ্গে চুক্তি করেন। ফলে যুদ্ধের ময়দানে নবাবের সেনারা নিষ্ক্রিয় থাকে, আর ক্লাইভ সহজেই জিতে যান।
এই বিজয় ব্রিটিশ শাসনের সূচনাবিন্দু হিসেবে পরিচিত। কিন্তু এ শুধু সামরিক বিজয় ছিল না, ছিল এক বিশাল রাজনৈতিক পালাবদল। ক্লাইভ নবাবের কোষাগার লুট করেন না ঠিকই, কিন্তু ২ লাখ ৩৪ হাজার পাউন্ড নিয়ে নেন পুরস্কার হিসেবে। আজকের মূল্যে প্রায় ৩২ মিলিয়ন পাউন্ড। যদিও তিনি আরও নিতে পারতেন—এমন কথাও তিনি নিজেই বলেছেন, হয়তো আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্যই।
ক্লাইভ তখন বাংলার গভর্নর নিযুক্ত হন। প্রশাসন, রাজস্ব, বিচার—all under British control—তবে মুঘল সম্রাটের নামমাত্র ছায়াতলে। এই শাসনকে বলা হয় ‘দ্বৈত শাসন’। নবাব ছিলেন শুধু নামের, আসল ক্ষমতা ছিল কোম্পানির হাতে। স্থানীয় ব্যবসায়ী, জমিদার, এবং ধনী সম্প্রদায় ক্লাইভের শাসনে এক অনিশ্চয়তার মুখে পড়ে।
তারই শাসনামলে শুরু হয় ব্রিটিশ কর্মচারীদের সীমাহীন লোভের যুগ। স্থানীয়দের বাণিজ্য দখল করে নেয় কোম্পানির লোকেরা। দেশীয় উৎপাদকরা বাধ্য হন কম দামে পণ্য দিতে, আদালত, পুলিশ, সবখানে ব্রিটিশ কর্মচারীরা আধিপত্য বিস্তার করে। বাংলার অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য একচেটিয়া দখলে নেয়া হয়, যা পরবর্তীকালে অর্থনৈতিক পতনের বড় কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
তবে ক্লাইভ এই দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেননি—এই দাবিও ইতিহাসে রয়েছে। দ্বিতীয় দফায় ভারত ফিরে তিনি এই অনাচারের বিরুদ্ধে দাঁড়ান। দুর্নীতিবাজ অফিসারদের কঠোরভাবে দমন করেন। উপহার গ্রহণ নিষিদ্ধ করেন, সরকারি বেতনে লবণের একচেটিয়া ব্যবসা চালু করে সরকারি কর্মকর্তাদের জীবনযাপন মানোন্নয়ন করেন। তিনি নিজে মীরজাফরের উইলে নিজের নামে থাকা বিপুল অর্থ কোম্পানির তহবিলে দিয়ে দেন। যুদ্ধাহতদের জন্য।
এমনকি তিনি নিজের ব্যক্তিগত লাভের আশাকে অগ্রাহ্য করে রাজত্ব গ্রহণে অপারগতা জানান। তিনি চাননি নবাব হোক, বরং ব্রিটিশ সরকারের সরাসরি প্রশাসন প্রতিষ্ঠিত হোক। তবু ক্লাইভই সেই মানুষ, যার মাধ্যমে কোম্পানি বাংলার প্রকৃত শাসক হয়ে ওঠে। ১৭৬৫ সালের পর মুঘল সম্রাট শাহ আলম তাকে ‘দিওয়ানি’ দেন—অর্থাৎ রাজস্ব আদায়ের পূর্ণ অধিকার। এ ছিল এক নিঃশব্দ অভ্যুত্থান।
তবে ইতিহাস তার প্রতিদান দেয়নি উদারভাবে। ইংল্যান্ডে ফিরে ক্লাইভ দেখতে পান, রাজনীতি তাকে হজম করতে পারছে না। তিনি সংসদ সদস্য হন, কোম্পানির বিরুদ্ধে দুর্নীতি তদন্ত কমিটিতে কাজ করেন, দুর্নীতির বিরুদ্ধে ভাষণ দেন। কিন্তু তার শত্রুরা তখনও সক্রিয়। ক্লাইভকে বানানো হয় বলির পাঁঠা—বাংলার দুর্নীতির, দুর্ভিক্ষের, লোভের প্রতীক। অথচ সেই লোভের বিরুদ্ধে তিনিই ছিলেন একজন কঠোর যোদ্ধা।
তার শেষ জীবন ছিল মানসিক অবসাদে ভরা। যাকে একসময় ‘স্বর্গপ্রদত্ত জেনারেল’ বলা হতো, সেই ক্লাইভ হয়ে উঠেন উপহাসের পাত্র। একসময়ের জাতীয় বীর হেরাক্লিস, শেষ জীবনে যেন এক নির্বাসিত রাজা। আত্মহননের পথ বেছে নেন তিনি, ইতিহাসে রেখে যান এক প্রশ্ন—তিনি কি ছিলেন লোভী সাম্রাজ্যবাদী, না সময়ের শিকার এক সংস্কারক?
রবার্ট ক্লাইভকে ঘিরে প্রশ্নগুলো আজও রয়ে গেছে। ইতিহাস হয়তো তাকে পুরোপুরি খলনায়ক কিংবা মহানায়ক, কোনোটাই বানাতে পারেনি। তিনি সেই বিরল চরিত্র, যিনি যুদ্ধ, রাজনীতি, এবং শাসনের তিন পর্বেই গুরুত্বপূর্ণ; একইসঙ্গে শ্রদ্ধেয় ও সমালোচিত। তিনি যেমন পলাশীর মাঠে বিজয় এনেছিলেন, তেমনি দুর্নীতির বিরুদ্ধে একমাত্রিক লড়াইও করেছিলেন।
তবে সত্যি কি ইতিহাস তাকে ন্যায়বিচার দিয়েছে? নাকি জয়ী হয়েও ক্লাইভ ইতিহাসের পরাজিত এক চরিত্র হয়ে রয়ে গেলেন? এ প্রশ্নের উত্তর সময়ের কাছেই ঋণ রাখল ভবিষ্যৎ ইতিহাস।
আপনার মতামত জানানঃ