বিশিষ্ট বিজ্ঞান লেখক ও ব্লগার অভিজিৎ রায়ের হত্যা মামলার পাঁচ আসামিকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন আদালত। এছাড়া এক আসামিকে দিয়েছেন যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। হত্যাকাণ্ডের দীর্ঘ ছয় বছর পর অবশেষে আজ মঙ্গলবার(১৬ ফেব্রুয়ারি) ঢাকার সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনালের বিচারক মজিবুর রহমান এ রায় ঘোষণা করেন।
মৃত্যুদণ্ড পাওয়া পাঁচ আসামি হলেন—আনসার আল ইসলামের সামরিক শাখার প্রধান ও সেনাবাহিনী থেকে চাকরিচ্যুত মেজর জিয়াউল হক ওরফে জিয়া, মোজাম্মেল হুসাইন ওরফে সায়মন ওরফে শাহরিয়ার, আবু সিদ্দিক সোহেল ওরফে সাকিব ওরফে সাজিদ ওরফে শাহাব, আরাফাত রহমান ওরফে সিয়াম ওরফে সাজ্জাদ ওরফে শামস, আকরাম হোসেন ওরফে হাসিব ওরফে আবির ওরফে আদনান ওরফে আবদুল্লাহ, তাকে মৃত্যুদণ্ডের পাশাপাশি ৫০ হাজার টাকা করে জরিমানা করা হয়েছে। তারা সবাই নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সদস্য বলে তদন্তকারীদের ভাষ্য।
আর অপর আসামি উগ্রপন্থি ব্লগার শফিউর রহমান ফারাবীকে রায়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি তারও ৫০ হাজার টাকা জরিমানা অনাদায়ে আরও দুই বছর কারাদণ্ড ভোগ করতে হবে বলে আদেশ দিয়েছে আদালত। হত্যাকাণ্ডে সরাসরি জড়িত না থাকলেও ফেইসবুকে পোস্ট দিয়ে অভিজিৎ রায়কে ‘হত্যার প্ররোচনা দিয়েছিলেন’ বলে তাকে এ মামলায় আসামি করা হয়।
আসামিদের মধ্যে জিয়া ও আকরামকে পলাতক দেখিয়েই এ মামলার বিচার কার্যক্রম চলে। বাকি চার আসামি রায়ের সময় আদালতে উপস্থিত ছিলেন।
অভিজিৎ হত্যা মামলায় আসামিপক্ষের আইনজীবী হিসেবে দায়িত্ব পালন করা খায়রুল ইসলাম লিটন ও মো. নজরুল ইসলাম বলেছেন, এ রায়ের বিরুদ্ধে তারা আপিল করবেন। অন্যদিকে রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি গোলাম সারোয়ার খান জাকির বলেছেন, এই রায়ে তারা সন্তুষ্ট।
রায় ঘোষণা উপলক্ষে আজ আদালত এলাকায় নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার করা হয়। কড়া নিরাপত্তার মধ্যে সকাল ১০টার দিকে কারাগার থেকে আদালতে আনা হয় আসামিদের। দুপুর পৌনে ১২টার দিকে তাঁদের হাজতখানা থেকে আদালতের কাঠগড়ায় তোলা হয়।
গত ৪ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রপক্ষ এবং আসামিপক্ষের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে রায় ঘোষণার জন্য এ তারিখ ঠিক করেন। মামলাটিতে চার্জশিটভূক্ত ৩৪ জন সাক্ষীর মধ্যে ২৮ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়। ২০১৯ সালের ১ আগস্ট পলাতক বরখাস্তকৃত মেজর সৈয়দ জিয়াউল হক জিয়াসহ ৬ আসামির বিরুদ্ধে চার্জ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন।
মামলার অভিযোগ থেকে জানা যায়, ব্লগার ও লেখক অভিজিৎ রায়কে ২০১৫ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি রাত সোয়া ৯টার দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) টিএসসি এলাকায় সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের পাশে জঙ্গিরা কুপিয়ে জখম করে। আহত অবস্থায় তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে নেয়া হলে ওইদিন রাত সাড়ে ১০টার দিকে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান।
এ ঘটনায় ২৭ ফেব্রুয়ারি অভিজিতের বাবা বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ অজয় রায় শাহবাগ থানায় একটি হত্যা মামলা করেন। ২০১৯ সালের ১৩ মার্চ ঢাকা মহানগর হাকিম সরাফুজ্জামান আনসারীর আদালতে ছয়জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট (অভিযোগপত্র) দাখিল করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের পরিদর্শক মনিরুল ইসলাম।
১১ এপ্রিল ঢাকার সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনালের বিচারক মো. মজিবুর রহমান ছয় আসামির বিরুদ্ধে চার্জশিট গ্রহণ করেন। ১ আগস্ট আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন ঢাকার সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনালের বিচারক মো. মজিবুর রহমান।
অভিযোগপত্রে বলা হয়, প্রযুক্তিগত তথ্যের ভিত্তিতে ২০১৭ সালের ৫ নভেম্বর আসামি আবু সিদ্দিক সোহেলকে রাজধানীর মোহাম্মদপুর এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। সোহেল অভিজিৎ হত্যাকাণ্ডে জড়িত ছিলেন। আদালতে তিনি ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন।
আদালতে জমা দেওয়া অভিযোগপত্রে বলা হয়, অভিজিৎ রায় হত্যাকাণ্ডে মোট ১২ জন জড়িত ছিলেন। তাদের মধ্যে শফিউর রহমান ফারাবী হত্যাকাণ্ডে প্ররোচনা জোগান। আসামিদের মধ্যে মুকুল রানা ‘বন্দুকযুদ্ধে’ মারা গেছেন।
দণ্ডিত আসামিদের মধ্যে জিয়া, সায়মন ওরফে শাহরিয়ার, আবু সিদ্দিক সোহেল ওরফে সাকিব, আকরাম হোসেন ওরফে হাসিবকে প্রকাশক ফয়সল আরেফিন দীপন হত্যা মামলার রায়েও মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে। গত ১০ ফেব্রুয়ারি জাগৃতি প্রকাশনীর প্রকাশক ফয়সাল আরেফিন দীপন হত্যা মামলায় আট আসামির মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেন আদালত। পাশাপাশি আসামিদের সবাইকে ৫০ হাজার টাকা করে অর্থদণ্ড দেন।
মৃত্যুদণ্ড পাওয়া আট আসামির অন্যান্যরা হলেন— মইনুল হাসান শামীম ওরফে সামির ওরফে ইমরান, আবদুর সবুর সামাদ ওরফে সুজন ওরফে রাজু ওরফে স্বাদ, খাইরুল ইসলাম ওরফে জামিল ওরফে জিসান, মোজাম্মেল হুসাইন ওরফে সায়মন ওরফে শাহরিয়ার, শেখ আব্দুল্লাহ ওরফে জুবায়ের ওরফে জায়েদ ওরফে জাবেদ ওরফে আবু ওমায়ের।এ মামলার মোট আট আসামির মধ্যে ছয়জন কারাগারে রয়েছেন।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৭৪৫
আপনার মতামত জানানঃ