
ভারতের আদানি পাওয়ার কোম্পানি ও বাংলাদেশের বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) মধ্যে বকেয়া অর্থ নিয়ে নতুন করে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে। ৩১শে অক্টোবর পাঠানো এক চিঠিতে আদানি পাওয়ার স্পষ্টভাবে জানিয়েছে, চলতি মাসের ১০ই নভেম্বরের মধ্যে ৪৯৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার পরিশোধ না করলে ১১ই নভেম্বর থেকে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দেবে। কোম্পানির ভাইস চেয়ারম্যান অবিনাশ অনুরাগ চিঠিতে বলেন, বহুবার অনুরোধের পরও পাওনা মেটানো হয়নি, অথচ এর মধ্যে ২৬২ মিলিয়ন ডলারকে পিডিবি নিজেই বিরোধহীন পাওনা হিসেবে স্বীকার করেছে।
পিডিবির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, আদানির দাবিকৃত অর্থের পুরোটা তারা মেনে নিচ্ছে না। মূল বিতর্ক তৈরি হয়েছে কয়লার দাম নির্ধারণ নিয়ে। পিডিবির অভিযোগ, চুক্তির শর্তের জটিলতায় প্রতি টন কয়লায় বাংলাদেশের জন্য ১০ থেকে ১২ ডলার বেশি দাম পড়ছে, যা অন্যান্য কেন্দ্রের তুলনায় অস্বাভাবিক। বিষয়টি নিয়ে বারবার বৈঠক হলেও সমাধানে পৌঁছানো যায়নি। গত বছরও আদানি একইভাবে সরবরাহ বন্ধের হুমকি দিয়েছিল এবং তখন কয়েকদিনের জন্য আংশিকভাবে বিদ্যুৎ সরবরাহ কমিয়ে দেয়।
আদানি পাওয়ার তাদের চিঠিতে উল্লেখ করেছে যে, ২০১৭ সালের ৫ই নভেম্বর স্বাক্ষরিত পাওয়ার পারচেজ এগ্রিমেন্টের (পিপিএ) ১৩.২ ধারা অনুযায়ী, ক্রেতা অর্থ পরিশোধে ব্যর্থ হলে কোম্পানি বিদ্যুৎ সরবরাহ স্থগিত করার অধিকার রাখে। তাই সময়মতো অর্থ না পেলে তারা আইনগতভাবে সরবরাহ বন্ধ করতে বাধ্য হবে। আরও বলা হয়েছে, সরবরাহ বন্ধ থাকলেও ক্যাপাসিটি পেমেন্ট বা সক্ষমতা চার্জ পাওয়ার অধিকার কোম্পানির থাকবে, কারণ এটি চুক্তির বাধ্যবাধক অংশ।
অন্যদিকে, পিডিবি জানিয়েছে তারা সরকার গঠিত **‘বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তি পর্যালোচনা জাতীয় কমিটি’**র নির্দেশনা অনুযায়ী কাজ করছে। বিচারপতি মইনুল ইসলাম নেতৃত্বাধীন এই কমিটি ইতিমধ্যে একটি প্রাথমিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে (২রা নভেম্বর), যেখানে আদানির সঙ্গে চুক্তি অনুমোদন প্রক্রিয়ায় প্রশাসনিক ত্রুটি ও অসঙ্গতির কথা বলা হয়েছে। চূড়ান্ত প্রতিবেদন আগামী জানুয়ারিতে জমা দেওয়ার কথা রয়েছে।
এই ঘটনার ফলে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খাতের ওপর নতুন করে চাপ তৈরি হয়েছে। একদিকে দেশের জ্বালানি আমদানি ব্যয় ক্রমবর্ধমান, অন্যদিকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য বেসরকারি কোম্পানির ওপর নির্ভরশীলতা বাড়ছে। আদানির মতো বড় সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান বিদ্যুৎ বন্ধ করলে দেশের উত্তর ও পশ্চিমাঞ্চলে বড় ধরনের বিদ্যুৎ ঘাটতি দেখা দিতে পারে।
অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এই পরিস্থিতি প্রমাণ করে বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তিগুলোর পুনর্মূল্যায়ন ও স্বচ্ছতার প্রয়োজনীয়তা। তারা মনে করছেন, একতরফা শর্তে বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি করলে ভবিষ্যতে রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা বিপন্ন হতে পারে। সরকার যদি দ্রুত সমাধান না করে, তবে বিদ্যুৎ সরবরাহ ও আর্থিক দায়—দুটিরই ভার পড়বে সাধারণ মানুষের ওপর।
এই চিঠি ও প্রতিক্রিয়াগুলো দেখাচ্ছে যে বাংলাদেশ ও আদানি পাওয়ারের সম্পর্ক এখন এক সূক্ষ্ম সীমারেখায় দাঁড়িয়ে। ১০ নভেম্বরের আগে সমঝোতা না হলে, দেশ আবারও আংশিক বিদ্যুৎ সংকটে পড়তে পারে—যার প্রভাব পড়বে শিল্প থেকে শুরু করে সাধারণ জীবনযাত্রায়ও।
আপনার মতামত জানানঃ